গার্মেন্টসের দেশে তুলার আবাদ নেই কেন

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) তথ্যানুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩৯ হাজার ৩১৮ কোটি টাকায় ১৮ লাখ ৩৩ হাজার টন তুলা আমদানি হয়েছে। একই সময়ে ৪৪ হাজার ৬২৮ কোটি টাকায় ১২ লাখ ৯৫ হাজার টন সুতা আমদানি করা হয়। এতে তুলা ও সুতা বাবদ বাংলাদেশের খরচ হয় প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা, মানে ৯ বিলিয়ন ডলারের মতো।

২০২২-২৩ অর্থবছর নিয়ে ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাগ্রিকালচার (ইউএসডিএ) এক পূর্বাভাসে জানিয়েছিল, সেই অর্থবছরে ১১ কোটি ৪৪ লাখ বেল (১ বেল = ৪৮০ পাউন্ড) তুলা উৎপাদিত হবে এবং সেই সময়ে বাংলাদেশ আমদানি করবে ৭৯ লাখ বেল। এর আগের অর্থবছরে বাংলাদেশ ৮৫ লাখ ২০ হাজার বেল তুলা আমদানি করেছিল। পরবর্তী হিসাবটি খুঁজে পাইনি। এক বছর আগের অর্থবছরের পূর্বাভাস হলেও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।

দেশের পণ্য রপ্তানি আয়ের শীর্ষ খাত তৈরি পোশাক শিল্পের সুতা ও কাপড়ের একটা বড় অংশ সরবরাহ করে টেক্সটাইল বা বস্ত্র খাত। পশ্চিমা বিশ্বে বাংলাদেশের অন্যতম পরিচয় পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসাবে। এ দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের বয়স প্রায় চার দশক পেরিয়েছে। তাহলে এখনো কেন আমরা তুলা আমদানির ওপর নির্ভরশীল? অথচ আমাদের ইতিহাস কিন্তু পুরো উল্টো কথায় বলছে।

২.

বলা হয়, মানুষের চাষের ক্ষমতা তুলার জৈবিক ইতিহাসকে পাল্টে দিয়েছে, উনিশ শতকে যা বেড়ে তুলার সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আমেরিকান ইতিহাসের অধ্যাপক ভেন বেকার্ট তাঁর ‘এম্পায়ার অব কটন: এ গ্লোবাল হিস্ট্রি’তে জানাচ্ছেন, ‘পাঁচ হাজার বছর আগে ভারতীয় উপমহাদেশ তুলাকে সুতায় রূপান্তর করার কাজটি করে প্রথম।...মহেঞ্জোদারোর পাশে মেহেরগড়ের তুলার বীজের বয়স প্রায় সাত হাজার বছর।’

ভেন বেকার্ট আরও বলেন, ভারতীয় মিহি কাপড়ের গুণাগুণ আজ প্রায় উপকথাসুলভ—তেরো শতকে ভারতে আসা ইউরোপীয় মুসাফির মার্কো পোলোর ৯০০ বছর আগে হেরোডোটাস (৪৮৪-৪২৫ খ্রি.পূ.) করমণ্ডল (ভারত মহাসাগরীয়) উপকূলের কাপড় সম্পর্কে বলেছেন, ‘সবচেয়ে চমৎকার ও সুন্দর তুলা, যা বিশ্বের কোথায় পাওয়া যেত না।’ ৬০০ বছর পরে লিডসের তুলাবিশেষজ্ঞ এডওয়ার্ড বেইনস বলবেন, ‘এত তুলনাহীন নিখুঁত, তার মধ্যে মসলিন সম্ভবত আসমানের পরি বা অতিমানবীরা বানাত এবং সেগুলো যেন হাওয়ায় বোনা।’

মানবসভ্যতার আদিকাল থেকে উনিশ শতক অবধি ভারত উপমহাদেশের কারিগরেরা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি কাপড় উৎপাদনকারী শিল্প চালিয়েছেন। বিশ্ব মানচিত্রে পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশ নামের তিনটি দেশের কৃষকেরা খাদ্যশস্যের পাশাপাশি তুলাও চাষ করতেন। তুলো থেকে সুতা তৈরি করে কাপড় উৎপাদন করতেন নিজেদের জন্য আর কিছুটা স্থানীয় বাজারের জন্য।

ঊনবিংশ শতক অবধি দক্ষিণ এশিয়ায় যত কাপড় উৎপাদিত হতো, অধিকাংশই চাষি আর কারিগর নিজেরাই ব্যবহার করতেন। নিজেরা গাছ লাগাতেন, তুলা থেকে বীজ ছাড়ানোর জন্য রোলার জিন যন্ত্র ব্যবহার করতেন, বো ব্যবহার করে তুলা থেকে নানা মিশ্রণ, গাঁট ও অন্যান্য নোংরা বের করতেন, চরকা দিয়ে সুতা উৎপাদন করতেন এবং দুটি গাছে টাঙানো তাঁত দিয়ে কাপড় তৈরি করতেন।—কথাগুলো ভেন বেকার্টেরই।

পাটে কয়েক বছর আগেও আমরা বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছি। বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে বাংলাদেশের বদলে ভারতে পাটকল গড়ে উঠেছে। পাটকলের সংখ্যা কমতে কমতে এক-চতুর্থাংশ। কাঁচা পাট এখন মূলত রপ্তানিই হয়। গত বছরের চেয়ে এ বছর পাটের দাম অর্ধেকে নেমেছে। বিদেশিরা কেনা না–কেনার ওপর দাম ঠিক হচ্ছে। অথচ পোশাকপণ্যে এখন দুনিয়ায় আমরা দ্বিতীয়। আর তুলার দেশ হয়ে তুলা আমদানিতেও আমরা দ্বিতীয়।

তুলা উৎপাদন এবং পোশাক তৈরি শিল্প এশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও আফ্রিকায় মূলত চাষির কয়েক খণ্ড জমি ও কারিগরের বাড়ির কারখানানির্ভর ছিল। তুলা থেকেই রাজস্ব দিতেন। অন্যান্য শস্যের পাশাপাশি তুলার আবাদ করতেন। গুজরাটে ধানের সঙ্গে, মধ্য এশিয়ায় ধান, গম ও যবের সঙ্গে তুলা চাষ করা হতো। আঠারো শতকের আগে কোথাও শুধুই তুলার চাষ হতো না।

কৃষিনির্ভর সমাজগুলোয় যেহেতু বছরের নানা সময় শ্রমের চাহিদার হেরফের হয় এবং তুলা যেহেতু গাছ থেকে তুলে কয়েক মাস রেখে দেওয়া যায়, তাই চাষ না হওয়া মৌসুমে চাষি ও কারিগরেরা সুতা তৈরি ও কাপড় বোনার কাজটা করতে পারেন। ফলে তুলার উৎপাদন থাকলে বছরের ফাঁকা সময়টি কর্মমুখর হয়ে উঠতে পারে, এমনকি সুতা পাকানোর কাজটি রান্না করা, বাচ্চা দেখভালের সময়ও করা যায়। এভাবে রাতদিন উৎপাদনে যুক্ত থাকার সুযোগ হয়। আমাদের পরিসংখ্যানে গৃহভিত্তিক উৎপাদন হিসাবের মধ্যেই থাকে না। ফলে তার শক্তির জায়গাটা টেরই পাওয়া যায় না।

১৬৫০ থেকে ১৭৫০—এই ১০০ বছরে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোই বাংলা থেকেই ৩ লাখ গজ থেকে ৩ কোটি গজ কাপড় রপ্তানি করেছে। এই বিপুল উৎপাদন কীভাবে সামাল দিল?

ডাচ কোম্পানিবিষয়ক গবেষক ওম প্রকাশ বলছেন, এতে বাংলায় ১ লাখ কারিগরকে কাজ করতে হয়েছিল। খাদ্যশস্যের জমি না কমিয়েই তুলা চাষের জমি বাড়াতে হয়েছে, বাড়াতে হয়েছে দক্ষতার গুণগত মানও। ১৭৫৭–এর আগে বাংলার তাঁতিরা দাদন ফিরিয়ে দিতে পারতেন। মূল্য নির্ধারণ করতেন নিজেরাই। তখন তাঁরা কাপড়ের দামের এক-তৃতীয়াংশ পেতেন আর আঠারো শতকের শেষের দিকে তা নেমে আসে মাত্র ৬ শতাংশে।

আরও পড়ুন

তাঁতিদের স্বর্ণযুগের কথা গল্পগাথায় ঢুকে গেল। ভেন বেকার্ট বলছেন, উপমহাদেশে ব্রিটিশদের রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধির একটাই ফল, তাঁতিরা ক্রমে দর–কষাকষির সঙ্গে কাপড়ের মূল্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হারাল।

পাটে কয়েক বছর আগেও আমরা বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছি। বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে বাংলাদেশের বদলে ভারতে পাটকল গড়ে উঠেছে। পাটকলের সংখ্যা কমতে কমতে এক-চতুর্থাংশ। কাঁচা পাট এখন মূলত রপ্তানিই হয়। গত বছরের চেয়ে এ বছর পাটের দাম অর্ধেকে নেমেছে। বিদেশিরা কেনা না–কেনার ওপর দাম ঠিক হচ্ছে। অথচ পোশাকপণ্যে এখন দুনিয়ায় আমরা দ্বিতীয়। আর তুলার দেশ হয়ে তুলা আমদানিতেও আমরা দ্বিতীয়।

অ্যাটলাস বিগ ডটকমের মতে, তুলা উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান ৪০তম। তাদের তালিকায় ভারত প্রথম, দ্বিতীয় চীন এবং তারপর যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের অবস্থান। তবে ইনডেক্স মুন্ডি ডটকমের মতে, বাংলাদেশ ৩২তম। শীর্ষে চীন, তারপর ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিল।

অন্যদিকে আমদানিতে বাংলাদেশ প্রথম সারিতে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টা ডটকমের তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি তুলা আমদানি করে চীন। তারপরই বাংলাদেশ। অর্থাৎ তৈরি পোশাক রপ্তানিতেও আমরা যেমন দ্বিতীয়, তুলা ও সুতা আমদানিতেও দ্বিতীয়।

দেশে বছরে ৭৫ থেকে ৮০ লাখ বেল আঁশ তুলার চাহিদা। সেখানে বোর্ড প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পরও উৎপাদিত হয় চাহিদার মাত্র ৩ থেকে ৪ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪৩ হাজার হেক্টর জমিতে ১ লাখ ৬৫ হাজার বেল আঁশ তুলা উৎপাদিত হয়। পাঁচ বছর পর ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ৪৫ হাজার হেক্টর জমিতে ১ লাখ ৯৫ হাজার বেল আঁশ তুলা উৎপাদন করা হয়। কর্মকর্তারা বলছেন, তুলা চাষ সম্প্রসারণ ও উৎপাদন ধীরগতিতে বাড়ছে।

মসলিনের দেশে তুলা খাতে বরাদ্দ দেখেই বোঝা যায়, স্বনির্ভর অর্থনীতি আমরা কতটা গড়তে চাই। ২০২০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কৃষিমন্ত্রী তুলা ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে চাহিদার প্রায় ২০ শতাংশ তুলা উৎপাদনের কর্মকৌশল নাকি হাতে নেওয়া হয়েছে।

প্রাথমিকভাবে চাষ উপযোগী জমি নির্ধারণ করা হয়েছে ২ দশমিক ৫ লাখ হেক্টর এবং তুলার উন্নত জাত ও হাইব্রিড জাত তৈরির জন্য নেওয়া হয়েছে গবেষণা প্রকল্প। একনেকে তা পাসও হয়েছে। বিটি তুলার ট্রায়াল সম্পন্ন করে ইতিমধ্যে অনুমোদন পেয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু যে তুলার জন্য বাংলা বিশ্বখ্যাত, তার জন্য কোনো গবেষণা নেই। ইংল্যান্ডের কারখানার জন্য কম কাউন্টের তুলার উৎপাদন দরকার ছিল। তাই বাংলার উন্নত তুলার আবাদ ধ্বংস করে মার্কিন ও মিসরীয় তুলার আবাদ শুরু করা হয়। কিন্তু বাংলার ঘরে ঘরে নারী-পুরুষেরা কাপড় তৈরি করতেন যে তুলা থেকে, যে তুলার জোরে বাংলা শিল্পোন্নত দেশ ছিল, বাংলার মাটি যে তুলার উপযোগী, সেই তুলা ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা কোথায়?

তুলাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক তন্তুর গবেষণা, সংরক্ষণ, অবকাঠামো উন্নয়ন ও তুলা চাষ সম্প্রসারণের জন্য একটি মেগা প্রকল্প তৈরির কাজ শুরু করেছে তুলা উন্নয়ন বোর্ড। সব কার্যক্রম সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশেই ২০ লাখ বেল তুলা উৎপাদন ২০৪১ সালের মধ্যেই সম্ভব হবে।

সামাজিক বিভাজন প্রকাশে কাপড় যেমন বড় ভূমিকা পালন করে, তুলার উৎপাদনও আসলে তা–ই। বলা হয়, সারা দুনিয়াকে তুলার নরম কাপড় পরা শিখিয়েছি আমরা। তার আগে পশম ও লিনেনের মোটা কাপড়ে হাঁসফাঁস করেছে তারা। সেই আমরা আজ বিদেশ থেকে তুলা আমদানি করি কোন যুক্তিতে?