বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি। প্রতিবছর বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও নদীভাঙনে প্রায় সাত লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। ভিটেমাটি হারানো এসব মানুষের বড় একটি অংশ আশ্রয় নেয় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মতো উপকূলীয় নগরগুলোর প্রান্তিক এলাকায়। কিন্তু এই অভিবাসন শুধু বসত বদলের গল্প নয়, এটি দারিদ্র্য, অনিরাপদ শ্রম এবং শিশুশ্রমের এক নির্মম চক্র তৈরি করছে।
জলবায়ুজনিত দুর্যোগে বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলো তাদের ঘরবাড়ি, জমি ও জীবিকাই শুধু হারায় না, তাতে ভেঙে পড়ে সামাজিক বন্ধন, তৈরি হয় গভীর মানসিক চাপ ও অনিশ্চয়তা। আয় কমে যাওয়ায় অনেকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ নিতে বাধ্য হয়। চট্টগ্রামে জলবায়ু অভিবাসীদের ৬০ শতাংশের বেশি বসবাস করছে নগরের প্রান্তে গড়ে ওঠা দরিদ্র বস্তিতে, যেখানে নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার অভাব প্রকট। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। উপকূলীয় বস্তিগুলোতে ১০-১৭ বছর বয়সী উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে জলবায়ু-বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলোর শিশুরা মূলত দুটি খাতে বেশি নিয়োজিত—শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং ধাতব কারখানা বা মেটাল ফ্যাক্টরি সেক্টর। এগুলো সরকারিভাবে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হিসেবে চিহ্নিত।
শুঁটকি ও ধাতব কারখানায় শিশুদের ভারী বোঝা বইতে হয়, ধারালো যন্ত্র ব্যবহার করতে হয়, তারা বিষাক্ত রাসায়নিকের সংস্পর্শে আসে, দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করে আর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ঝুঁকিতে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের নেওয়া অগ্রিম ঋণের কারণে শিশুরা জড়িয়ে পড়ে বাধ্যতামূলক শ্রমে। ফলে তারা স্কুলছুট হয়, হারায় খেলাধুলা ও স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার সুযোগ। এক অর্থে, দেশ হারাচ্ছে তার ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের সম্ভাবনা।
পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে প্রায় ৩৫ লাখ শিশু শ্রমে যুক্ত, যার মধ্যে ১০ লাখের বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। শুঁটকি খাতে শিশুশ্রমিকদের বড় অংশই মেয়েশিশু, আর ধাতব কারখানায় বেশি কাজ করে ছেলেশিশুরা। এসব শিশুর ৭৫ শতাংশ স্কুলের বাইরে, অনেকে কখনো স্কুলেই যায়নি।
শিশুশ্রম–বিরোধী আইন ও নীতির ঘাটতি নেই। বাংলাদেশ শিশুশ্রম নিষিদ্ধকরণে আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুমোদন করেছে, জাতীয় কর্মপরিকল্পনা রয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে শিশুশ্রমমুক্ত দেশের লক্ষ্যও নির্ধারিত। কিন্তু বাস্তবতা হলো—জলবায়ু বাস্তুচ্যুতি ও জীবিকার সংকটকে আলাদাভাবে বিবেচনায় না নিলে এই লক্ষ্য অর্জন খুব কঠিন হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত শুধু পরিবেশগত নয়, এটি সামাজিক ও নৈতিক সংকটও তৈরি করছে। ব্যাপারটি আবারও স্পষ্ট হয়ে উঠল চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত একটি গোলটেবিল বৈঠকে। ‘জলবায়ু পরিবর্তনে বাস্তুচ্যুত পরিবার ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুশ্রম নিরসন’ শীর্ষক এই বৈঠকে উঠে আসে—কীভাবে জলবায়ুসংকট ধীরে ধীরে শহরের বস্তি, কারখানা ও শুঁটকিমহালের ভেতর দিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গ্রাস করছে। ইয়াং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশন (ইপসা) ও একটি ইংরেজি দৈনিকের যৌথ উদ্যোগে, চট্টগ্রাম ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির সহযোগিতায় আয়োজিত এই বৈঠকে নীতিনির্ধারক, গবেষক, শিক্ষক, প্রশাসনের কর্মকর্তা, উন্নয়নকর্মী ও সাংবাদিকেরা একমত হন যে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলোর শিশুরা আজ সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে।
গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থাপিত তথ্যে জানা যায়, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও নদীভাঙনে প্রতিবছর প্রায় সাত লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। এসব পরিবার জীবিকার সন্ধানে শহরমুখী হয়ে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মতো উপকূলীয় নগরে এসে আশ্রয় নিচ্ছে দরিদ্র বস্তিতে। সেখানে মৌলিক সেবার অভাব, অনিরাপদ কর্মসংস্থান এবং দারিদ্র্যসহ নানা কারণে শিশুশ্রমকে প্রায় অনিবার্য করে তুলছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়রও এই সংকটের কথা স্বীকার করলেন। তিনি বললেন, নগরীর ফুটপাতে জলবায়ু বাস্তুচ্যুত পরিবার ও তাদের শিশুদের উপস্থিতি এখন নিত্যদিনের দৃশ্য। এসব শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িয়ে পড়ছে, কেউ কেউ কিশোর গ্যাং ও অপরাধের দিকেও ধাবিত হচ্ছে।
বৈঠকে অন্যান্য বক্তা ও বিশেষজ্ঞরাও এ কথা স্বীকার করেছেন যে শিশুশ্রম শুধু দারিদ্র্যের ফল নয়, এটি জলবায়ু পরিবর্তনের এক নীরব কিন্তু ভয়াবহ সামাজিক পরিণতি। জলবায়ু-বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলোর জন্য নিরাপদ বাসস্থান, সম্মানজনক জীবিকা ও শিশুবান্ধব সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত না করা গেলে শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্য অধরাই থেকে যাবে।
বৈঠকে জলবায়ু বিশেষজ্ঞ মো. শামসুদ্দোহা কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের জাতীয় জলবায়ু অভিযোজন পরিকল্পনাগুলো মানুষকেন্দ্রিক নয়। সেখানে নারী, শিশু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিষয়গুলো উপেক্ষিত। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শিশুদের বিকাশ ব্যাহত হলে তা “ইন্টার জেনারেশনাল লস”-এ রূপ নেয়, যার প্রভাব পড়ে পরবর্তী প্রজন্মের ওপরও।’
এই প্রেক্ষাপটে ইপসাসহ কিছু বেসরকারি সংগঠন ভূমিকা রাখছে। তারা সীমিত পরিসরে জলবায়ু-বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলোর শিশুদের স্কুলে ফিরিয়ে আনা, কারিগরি প্রশিক্ষণ, বিকল্প জীবিকার সুযোগ তৈরি এবং নীতিগত সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে তারা ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমের চক্র ভাঙার চেষ্টা করছে। শিক্ষা, দক্ষতা উন্নয়ন ও সামাজিক সুরক্ষাকে একসঙ্গে যুক্ত করার এই উদ্যোগ ভবিষ্যতের জন্য একটি কার্যকর মডেল হতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে বাস্তুচ্যুত শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে ঠেলে দেওয়া মানে তাদের ওপর অবিচার করা। তাই প্রয়োজন খাতভিত্তিক উদ্যোগ, শক্তিশালী সামাজিক সুরক্ষা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, যাতে জলবায়ুসংকটে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো সম্মানজনক ও নিরাপদ জীবিকার পথে ফিরতে পারে, আর শিশুরা ফিরে পায় তাদের হারিয়ে যাওয়া শৈশব।
ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম অফিসের বার্তা সম্পাদক