বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক : ছোট দু-একটা বিষয়, একটু ভাবা যায় কি

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টানা ১৩ বছর ক্ষমতায় থাকা সবচেয়ে বেশি কাউকে যদি নিশ্চিন্তে রেখে থাকে, তবে তা ভারতের বিস্তীর্ণ উত্তর-পূর্বাঞ্চল। কেন ও কী কারণে, সেই বিস্তারিত ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার মন্তব্য, ‘শেখ হাসিনার জন্য আসাম নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারছে’, সেই ব্যাখ্যার হ্রস্বতম নির্যাস। শান্তি, সৌভ্রাতৃত্ব ও সুস্থিতির চেয়ে দামি কিছু হয় না।

নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ায় ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আজ যে অগ্রগতি সম্ভবপর হচ্ছে এবং সেই সঙ্গে নিশ্চিন্ত নিশিযাপন, সেই কৃতিত্ব শেখ হাসিনারই। কৃতিত্বের দাবিদার ভারতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বও। কেননা, তালি এক হাতে বাজে না। হাসিনাকে বিশ্বাস করে, ভরসা রেখে, সঙ্গী করে দলমত-নির্বিশেষে ভারতের রাজনৈতিক নেতারা পারস্পরিক প্রগতি, উন্নয়ন, আস্থা ও বিশ্বাসের সাম্পান ভাসিয়েছেন। সম্পর্কের যে ‘সোনালি অধ্যায়’ সূচিত, তা আরও সুদূরপ্রসারী হবে পারস্পরিক স্বার্থেই। শেখ হাসিনার সফরকে ভারত এই চোখেই দেখছে।

সম্পর্ক থাকলে টানাপোড়েনও থাকে। কিন্তু দুই দেশের নেতৃত্ব টানাপোড়েনকে কখনো লাগামছাড়া হতে দেয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, কেউ এমন কিছু করেনি, যা পারস্পরিক স্বার্থপরিপন্থী ও মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হওয়ার মতো। সেই জন্য জল, স্থল, অন্তরিক্ষে সহযোগিতার ক্ষেত্র দিন দিন বেড়ে চলেছে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ-পূর্ববর্তী অবস্থানে ফিরে যাওয়ার লক্ষ্যে দ্রুত ধাবিত হচ্ছে দুই পক্ষ। পারস্পরিক পাওয়ার ক্ষেত্রে দুই পক্ষ সমান সন্তুষ্ট নয়। কিন্তু তা নিয়ে কেউ অসহায় বিলাপে কালক্ষেপণ করেনি। রাষ্ট্র পরিচালনার মূল বীজমন্ত্র ‘এনগেজমেন্ট’। শেখ হাসিনার বাংলাদেশ ও নরেন্দ্র মোদির ভারত সেই বীজমন্ত্র আঁকড়ে এগিয়ে চলেছে। অপ্রাপ্তিবোধের হতাশা ও বেদনার চেয়ে প্রাপ্তির ঘর তাই বেশি।

হতাশা ও বেদনাজনিত অভিমান অবশ্যই বাংলাদেশের বেশি। সম্পর্কের শুভ্রতা ও ধারাবাহিকতার এক যুগ অতিক্রান্ত অথচ তিস্তা চুক্তি অধরা। কবে কীভাবে জট খুলবে, জানা নেই। আশ্বাসটুকু ছাড়া বাংলাদেশের পাওনার ঘর এখনো শূন্য। এত বন্ধুত্ব সত্ত্বেও সীমান্ত হত্যা কেন শূন্যতে নামছে না, সেই ধাঁধাও উত্তরহীন। রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশ অভিমানী কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ঘাত-প্রতিঘাতও অনস্বীকার্য।

হতাশা ও বেদনাজনিত অভিমান অবশ্যই বাংলাদেশের বেশি। সম্পর্কের শুভ্রতা ও ধারাবাহিকতার এক যুগ অতিক্রান্ত অথচ তিস্তা চুক্তি অধরা। কবে কীভাবে জট খুলবে, জানা নেই। আশ্বাসটুকু ছাড়া বাংলাদেশের পাওনার ঘর এখনো শূন্য। এত বন্ধুত্ব সত্ত্বেও সীমান্ত হত্যা কেন শূন্যতে নামছে না, সেই ধাঁধাও উত্তরহীন। রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশ অভিমানী কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ঘাত-প্রতিঘাতও অনস্বীকার্য। পারস্পরিক বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রেও ছোট-বড় অভিযোগ, দাবি ও পাল্টা দাবি অব্যাহত। এই জাতীয় টানাপোড়েন সত্ত্বেও দুই দেশের বিচক্ষণ নেতৃত্ব আলোচনায় কখনো ইতি টানেননি। টানেননি বলেই দীর্ঘ ১২ বছর পর দুই দেশের যুগ্ম নদী কমিশনের বৈঠক বসেছে। শুধু তিস্তায় আটকে না থেকে ১৮টি অভিন্ন নদ-নদীর পানিবণ্টন ও অববাহিকার যৌথ ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। যতটা গতিশীল হওয়া প্রয়োজন, আলোচনায় ততটা গতি সঞ্চারিত হচ্ছে না। কিন্তু থমকে থাকার চেয়ে বল গড়ানো তো ভালো। কে বলতে পারে, এভাবে আগামী দিনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে না?

আরও পড়ুন

যেকোনো দুই স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হয় দুটি স্তরে। একটি সরকারের সঙ্গে সরকারের, অন্যটি জনগণের সঙ্গে জনগণের। দুই স্তরেই সম্পর্কের স্থায়িত্ব ও সাফল্য নির্ভর করে আন্তরিকতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর। সরকারের সঙ্গে সরকারের সম্পর্কে একধরনের আনুষ্ঠানিকতা থাকে। আমলাতান্ত্রিক বাহুল্য ও জটিলতা থাকে। তুলনায় জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক অনাবিল। আন্তরিক। মানবিক। আনুষ্ঠানিকতার বন্ধনহীন। দুই সম্পর্ক তখনই দৃঢ় ও দীর্ঘমেয়াদি হয়, যখন দুই দেশের জনগণ বুঝতে পারে, তাতে উভয়ের মঙ্গল হচ্ছে। উভয়েই লাভবান হচ্ছে। সম্মানিত বোধ করছে।

সম্পর্কের ক্ষেত্রে সম্মান একটা বড় বিষয়। অনেক জটিলতা নিমেষে কেটে যায় সম্পর্ক যখন পারস্পরিক সম্মানের খিলানে প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই কোন যুগে রাজ কাপুরের শ্রী ৪২০ সিনেমায় গীতিকার শৈলেন্দ্র লিখেছিলেন ‘মেরা জুতা হ্যায় জাপানি/ ইয়ে পাতলুন ইংলিশস্তানি / সরপে লাল টোপি রুশি / ফির ভি দিল হ্যায় হিন্দুস্তানি’। শঙ্কর-জয়কিষণ দিয়েছিলেন অমর সুর। ওই একটি গান সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতীয় জনগণের সম্পর্কের সেতুবন্ধের কাজ করেছিল। সোভিয়েত সফরকালে দেখেছি ‘সরপে লাল টোপি’ ভারতীয়দের ওই দেশে সম্মান ও ভালোবাসার কোন চূড়ায় বসিয়ে দিয়েছে। আজ এত দশক পরও উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, কিরগিজস্তান, তুর্কমেনিস্তান, ইউক্রেনে রাজ কাপুরের (পাশাপাশি হিন্দি সিনেমা ও তাঁর গান) অশরীরী উপস্থিতি বিস্ময়কর! জনগণের সঙ্গে জনগণের এই আত্মিকতাই সম্পর্কের ভিত। খুব স্বল্পায়েসে তা লালন করা যায়।

এই আত্মিকতা ও একাত্মতার ক্ষেত্রে কয়েকটি চৌকাঠ মাঝেমধ্যে অলঙ্ঘনীয় প্রাচীর হয়ে ওঠে। অসন্তোষের জন্ম দেয়। ঐতিহাসিক কারণে দুই বন্ধুপ্রতিম দেশের একাংশের মনে দ্বেষের যে বীজ রোপিত, দুরভিসন্ধি মতলবিরা সুযোগ পেলেই যাতে জল-হাওয়া-রোদ্দুরের জোগান দেয়, তাদের নিরুৎসাহ করতে এই চৌকাঠগুলোর অপসারণ জরুরি। কিছুকাল আগেও এ দেশে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশি নাগরিকদের ধর্মের নিরিখে বিভাজন করা হতো। ভিসা উত্তীর্ণ হলে পর্যটকের জরিমানার অঙ্ক নির্ধারিত হতো ধর্মের আধারে। তা নিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে জমা পড়ত বিস্তর অভিযোগ। সাবেক হাইকমিশনার প্রয়াত মোয়াজ্জেম আলীর নিরলস প্রচেষ্টায় সেই বৈষম্য দূর হয়েছে। কিন্তু বিশেষ করে স্থলবন্দরের চেকপোস্টগুলোর অব্যবস্থা, ইমিগ্রেশন, কাস্টমস ও সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় কর্মীদের ব্যবহার সম্পর্কিত যেসব ‘অভিযোগ’ দুই দেশে নিত্যদিন পল্লবিত হয়ে চলেছে, তার সরলীকরণে দুই দেশের সরকারের আরও যত্নবান হওয়া দরকার। এসব এলাকাই সম্পর্কজনিত প্রথম ধ্যানধারণার উৎসস্থল।

দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নতিতে পর্দার আড়ালে যাঁরা সচেষ্ট, সেই সরকারি কর্তাদের কেউ কেউ এই জাতীয় ‘ছোটখাটো’ বিষয়কে ‘গুরুত্ব’ দিতে আগ্রহী। তাঁরা মনে করেন, হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের মিলনে এগুলো বড় প্রতিবন্ধক। যেমন তাঁদের বোধগম্য হয় না, চিকিৎসার জন্য আসা বাংলাদেশি নাগরিকদের বেসরকারি হাসপাতালে কেন ভারতীয়দের তুলনায় দেড় থেকে দুই গুণ বেশি অর্থ খরচ করতে হয়? কেন কাজে আসা বাংলাদেশি নাগরিকদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে খাতা খুলতে হলে ‘ফরেন রিজিওনাল রেজিস্ট্রেশন অফিস’ (এফআরআরও)-এর অনুমোদন বাধ্যতামূলক? তাঁরা আরও ‘অসম্মানিত’ বোধ করেন, যখন দেখেন ওই নিয়ম শুধু আরেকটি দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য! পাকিস্তান! দিল্লিসহ বেশ কিছু রাজ্যে বাংলাদেশ পাসপোর্টধারীদের হোটেলে স্থান পাওয়া ইদানীং দুরূহ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বাতিল হচ্ছে আগাম বুকিংও। এ এক অলিখিত নির্দেশ এবং এই নির্দেশ শুধু বাংলাদেশ ও পাকিস্তানিদের জন্য! বাংলাদেশ এখনো ‘হাই রিস্ক’ দেশ!

যে দেশ ভারতের ‘সবচেয়ে বড় বন্ধু ও বিশ্বস্ত প্রতিবেশী’, তারা সমমর্যাদাপ্রত্যাশী। হয়তো নিতান্তই তুচ্ছ এই চাহিদা, কিন্তু হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের মিলনে জরুরি ও সুদূরপ্রসারী।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি