১.
দেখেন, প্রতিটি কাজেই অভিজ্ঞতা লাগে, পূর্ব জানাশোনা লাগে, চর্চা লাগে। দেশ চালাতে গেলে তো এই জিনিসটা সবচেয়ে বেশি লাগে। দেশ চালাতে গেলে আপনি তো অল্প কয় ধরনের মানুষ ডিল করবেন না, ডিল করবেন ভালো–খারাপ সব মিলিয়ে নানা ধরনের মানুষ, যারা অনেক আগে থেকে সময় নিয়ে সিস্টেমে বসে আছে, বসে ছিল।
আমলা ডিল করতে হবে, যারা দেশের মানুষকে সার্ভেন্ট ভাবে। ভাবার কথা মালিক। এই আমলার দল নিজের যোগ্যতা, সামাজিক স্ট্যাটাস আর ক্ষমতার দাপট নিয়ে চলে, এমন একটা সিস্টেম তৈরি করেছে, সিস্টেমের মধ্যে গেছে যে যারা জানে, দেশ চালাতে তাদেরই লাগবে।
পুলিশকে ডিল করতে হবে। যে পুলিশ বাহিনী দুর্নীতি, জবাবদিহিহীনতার ভেতর দিয়ে একটা বড় সময় পার করেছে। যারা জনগণ, আন্দোলন এবং এই সবকিছুকে ভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী, গুলির যোগ্য।
সেনাবাহিনীকে ডিল করতে হবে। ডিল করতে হবে চোর, ছেঁচড়, গুন্ডা, বদমাশ। বড়লোক, ব্যবসায়ী, মুনাফাখোরের সঙ্গে আঁতাত করে চলতে হবে, যাতে কখনো তাঁদের কাজে আসা যায়, আর বেশির ভাগ সময় তাঁদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া যায়।
এই যে এত পদের লোক ডিল করার যে কলা, সেটা তো শিখতে শিখতে গড়ে ওঠে। নতুন একদল লোককে এই দায় দিয়ে দিলে, সেখানে দায় ও দরদের আলাপ হবে শুধু, দায়িত্ব পালনটা আর হবে না। দায়িত্ব পালন না হলে তো পালনবাদও হবে না। তাই না?
৫ আগস্টের পর আমরা একটা সুযোগ পেয়েছিলাম, এই পুরো ব্যবস্থাটাকে বদলে ফেলার, ভেঙে ফেলার, ছুড়ে ফেলে দেওয়ার। কিন্তু শিক্ষার্থীরা সেটা করতে পারে নাই, করে নাই। নানা দিকের চাপে, সেই চাপ সামলে কিছু ক্ষমতায় গেছে, বসছে। আর কিছু হয়েছে সমন্বয়ক, এর মধ্যে কিছু হয়েছে সুবিধাভোগী। সুড়সুড় করে সিস্টেমে ঢুকে গেছে।
অথচ যে সময় দেশের মানুষ এই ছেলেমেয়েদের এত চরম ক্ষমতা দিয়েছিল, একটু লোভটা সামলাতে পারলেই, দেশটা গড়ে তোলা যেত নতুন করে। তাঁরাই পারতেন, যাঁদের সেই সময় কিছু মাত্রাতেও দেশ চালানোর অভিজ্ঞতা আছে—আমলা ও পুলিশ সামলেছেন। যাঁদের তৃণমূলে লোক আছে, তাঁদের রাজি করিয়ে একটা অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠা করা। এবং একই সঙ্গে আগের আমলের সবকিছু ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া, সংবিধান, আমলাতন্ত্রসহ আরও যা কিছু। কিন্তু করেন নাই।
তারপর দেশ চালাতে শুরু করল এমন কিছু মানুষ নিয়ে যাঁদের নিদেন কোনো চর্চা নাই, ছিল না দেশ চালানোর অভিজ্ঞতা। যাঁরা এনজিও চালিয়ে অভ্যস্ত, যেখানে তাঁরাই ছিলেন সর্বেসর্বা, তাঁদের কথাতেই সব চলে, ওঠে, বসে। অফিস পলিটিকসেরও ওপরে তাঁরা ছিলেন, প্রায় প্রত্যেকেই। ফলে নিদেন যে পলিটিকস, সেটাও তো তাঁদের ছোঁয় নাই। তাঁরা ক্ষমতায় গিয়ে তাই পলিটিকস না দেখে কী দেখবেন, বুঝলেন না।
জনতুষ্টি বুঝলেন না। বুঝলেন না, ক্ষমতা চালানোর কায়দাকানুন। ফলে পারলেন না শহীদের হিসাব করতে। পারলেন না দ্রব্যমূল্য কমাতে, পারলেন না আদর্শভিত্তিক কাজিয়া থামাতে; মাজার-মন্দির ভাঙা বন্ধ করতে পারলেন না, পারলেন না আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে। মানুষ যেই কারণে তাঁদের ক্ষমতা দিল, সেসব সামলাতে পারলেন না। অথচ শুরু করলেন, নিজেদের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটাতে।
একই সঙ্গে তাঁদের এই রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাকে জনতার আকাঙ্ক্ষা বলে মনে করে নিলেন, ভেবে নিলেন, প্রকাশ করতে থাকলেন। নিয়ে নিলেন জুলাই অভ্যুত্থানের একচ্ছত্র অধিকার, যেন জুলাইয়ের একমাত্র স্টেক তাঁদেরই। তাঁরা ছাড়া আর কেউ আন্দোলন করে নাই, নামে নাই, আহত হয় নাই, শহীদ হয় নাই।
অথচ গোটা জুলাইয়ে দেখেছি, আন্দোলন তো ছাত্রদের থাকে নাই শেষ পর্যন্ত। এই আন্দোলন ছড়িয়ে গণমানুষের হয়ে উঠেছে, ছাত্র নামল, চাকরিজীবী নামল, রিকশাওয়ালা নামল, ডাক্তার নামল, চৌকিদার নামল, পুলিশের ছেলে নামল, সচিবের ছেলে নামল। ময়লাওয়ালা নামল। প্রতিটা পর্যায়ের মানুষ রাস্তায় নামল, গুলিও খেল। ‘স্যার, একটা গুলি করি। খালি একটাই যায়। বাকিডি আর যায় না।’
এই যে যাঁরা আন্দোলনে গেছেন, যত যা মানুষ, যত ধরনের মানুষ, সেখানে কি এক রাজনৈতিক ইচ্ছার লোক কেবল ছিল? না তো, সেখানে ইসলামপন্থী ছিলেন, বামপন্থী ছিলেন, সেখানে নানা আইডিয়ার, আদর্শের মানুষ ছিলেন, যাঁরা সবাই নিজেদের মতো করে ক্ষমতা চান, দেশ চান। বিএনপি ছিল, জামায়াত ছিল। কিন্তু সেই সময়ে সবাই এক হয়ে গিয়েছিলেন, কেবলই হাসিনার পতনের জন্য।
এই সবার তো রাজনৈতিক লক্ষ্য আর অভীষ্ট এক ছিল না। কিন্তু সেই সময়ে সবাই এক হয়ে গিয়েছিলেন। সেই সময়টাতে এক হয়ে ক্ষমতা দিয়েছিলেন এই সমন্বয়কদের হাতে, যাতে মধ্যবর্তী একটা সময়ে তাঁরা সরকার সামলাতে পারেন। কিন্তু এঁরা এখন ভেবেই নিচ্ছেন, সেই সময়ের সবারই একই রাজনৈতিক অভীষ্ট ছিল। কেউ এটা না ভাবলে যেন তিনি জুলাইয়ের দুশমন।
২.
আমাদের উচিত ছিল একটা আনন্দময় ও শান্তির দেশের দিকে যাত্রা করা। যেখানে কোনো ধরনের অন্যায় থাকবে না, জবাবদিহি থাকবে, কারও দাদাগিরি থাকবে না।
আমরা গেল ১৫ বছর যা যা দুঃসময়ের মধ্যে দিয়ে গেছি, সেসবের পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে, সেটা নিশ্চিত করাও তো ছিল আমাদের একান্ত কর্তব্য। সেখানে নির্বাচন ছিল পয়লা নম্বরে। নির্বাচন ছাড়া তো আসলে জবাবদিহি নিয়ে আসা সম্ভব না। একটা অনির্বাচিত সরকার কি আদতেও দীর্ঘমেয়াদি কোনো সংস্কার করতে পারে রাষ্ট্রে?
সেই ক্ষমতা বা অধিকার তাদের থাকে? যখন সে আগের সিস্টেমেই ঢুকে গিয়ে নিজেকে মানিয়ে নেয়, আঁটিয়ে নেয়, সিস্টেমের একটা অংশ হয়ে ওঠে। সিস্টেমের অংশ হয়ে ওঠার পর সেটার সংস্কারে মন দেয়। সিস্টেম তো সংস্কার চাইবে না। কারণ, এই গোটা সিস্টেম সুবিধাভোগী হয়ে আছে।
এরা জানে, জনতার চেয়ে তাদের দাম, কথা বেশি মানা হয়, হতো, হচ্ছিল। জানে, একটু এদিক-ওদিক করা গেলেই ভগবানের মতো ওপরে ওঠা যায়, যেখানে কেউ তাকে ধরতে পারে না, ছুঁতে পারে না, জবাবদিহির দরকার পড়ে না। এখন এই সিস্টেমকে কাবু করতে না পেরে এই সরকার আফসোস করতে শুরু করেছে।
কদিন আগে উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, বিএনপিকে নাকি আহ্বান করা হয়েছিল জাতীয় সরকারের, তারা রাজি হয় নাই। সেই পোস্টের পর যাঁরা আন্দোলনে গেছেন, যাঁরা ক্ষমতাধর সমন্বয়ক তাঁরা সবাই বিএনপিকে জুলাইয়ের দুশমন দেখিয়ে লেখা শুরু করেছেন, যেন এই গোটা জুলাইকে ভন্ডুল করার একমাত্র দায় বিএনপির।
কিন্তু ক্ষমতায় তো বিএনপি বাদে অন্য কোনো দল থেকেও কাউকে নেওয়া হয় নাই ক্ষমতার অংশী হিসেবে, যে একলা বিএনপিকে দায় দেওয়া যাবে। তা ছাড়া এখন এই সময়ে এসে, অভ্যুত্থানের পাঁচ মাস পর, সব রাজনৈতিক দল থেকে বিশ্বস্ততা চাওয়া একটু বেশিই হয়ে যায় তো। যেখানে প্রতিটা দলই রাজনীতিটা করছে, ক্ষমতায় যেতে। দেশ শাসন করতে।
দেশে এক যুগ ধরে কোনো নির্বাচন নাই, নাই বলতে ছিল নামকাওয়াস্তে; জনতার অংশ নাই সরকার গঠনে, সেটা একটা বড় ধরনের কনসার্ন ছিল দেশের মানুষের।
অভ্যুত্থানের সরকারকে মানুষ চূড়ান্ত ক্ষমতা দিয়েছিল। তাই বলে, সেটা অবশ্যই একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে থাকবে। কিন্তু যদি সেই সরকারটাও সবাই মিলে না করা হয়, এত কিছু মানুষ কেন মানবে। একটা বিনা ভোটের সরকার থেকে অন্য আরেকটা ভোটবিহীন সরকারের কাছে নিজেদের সঁপে দেওয়ার তো অর্থ নাই।
মীর হুযাইফা আল মামদূহ গবেষক