ইউক্রেনে খুব শিগগিরই সরকার পরিবর্তন হতে চলছে!

চার মাস আগে যে শহরটিতে দাঁড়িয়ে ভলোদিমির জেলেনস্কি সেলফি তুলেছেন সেই শহরের পতন আসন্ন

ওয়াশিংটন প্রশাসনের একটা প্রিয় আশা হচ্ছে, তারা রাশিয়ায় সরকার বদল করে ফেলবে। কিন্তু বাস্তবে একটা সরকার পরিবর্তন খুবই আসন্ন, সেটা রাশিয়াতে নয়; বরং ইউক্রেনে। কিয়েভে সরকার পরিবর্তনে একটা অনুঘটক হবে রক্তক্ষয়ের পরও আভদিবকা যুদ্ধে পরাজয়।

আভদিবকা শহরটি দনবাস অঞ্চলের রাজধানী শহর দোনেৎস্কের খুব কাছে অবস্থিত। আজভ সাগরের সন্নিকটের মারিউপোল এবং উত্তর লুহানস্ক থেকে প্রায় সমদূরে অবস্থিত আভদিবকা। পূর্ব ইউক্রেনের দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের বেশির ভাগটাই রুশভাষী জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে খেরসন ও জাপোরিঝিয়ার সঙ্গে দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে একীভূত করে নেয় রাশিয়া।

আভদিবকা যুদ্ধ চার মাস আগে শুরু হয়েছিল। রুশ বাহিনী চার মাস ধরে ইউক্রেনীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে নিঃশেষিত করে চলেছে। রুশ বাহিনী উত্তর দিক থেকে যখন শহরটি আক্রমণ শুরু করে, তাদের মূল আক্রমণস্থল ছিল সেখানকার কোক-উৎপাদন প্ল্যান্ট। আর দক্ষিণ থেকে যে আক্রমণ পরিচালনা তারা করছে, সেখানে তাদের লক্ষ্যস্থল হলো শহরটির মূল কেন্দ্র।

ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহেই রুশ বাহিনী শহরটিকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলে এবং ভারী বোমা ও গোলাবর্ষণের মধ্য দিয়ে ধারাবাহিকভাবে সামনে অগ্রসর হতে থাকে।

রুশ সেনাবাহিনীর জন্য আভদিবকা অত্যন্ত সুরক্ষিত ও কঠিন লক্ষ্যবস্তু ছিল। রুশ বাহিনী মূল কেন্দ্রে আঘাত করার কারণ হলো, ইউক্রেনীয় বাহিনীর কাছে যেন অস্ত্র, খাদ্য সরবরাহ না পৌঁছায়। নতুন সেনা পাঠিয়ে হতাহত সেনাদের জায়গা পূরণ না করতে পারে। গত সপ্তাহের যুদ্ধে শহরটিতে প্রবেশ ও বাইরে বেরোনোর পথে গোলা ছোড়ার মতো দূরত্বে রয়েছে রুশ বাহিনী।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি আভদিবকার ওপর তাঁর সুনাম বাজি ধরেছেন, সেই সুনাম তিনি যেকোনো মূল্যে রক্ষা করতে চান। সম্প্রতি তিনি তাঁর সেনাপ্রধান ভ্যালেরি জালুঝনিকে বরখাস্ত করেছেন। জালুঝনি মনে করেন, ইউক্রেন আভদিবকা রক্ষা করতে পারবে না। জালুঝনি চেয়েছিলেন, ইউক্রেনীয় বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে সরিয়ে নিতে এবং আরও সুরক্ষিত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে, যাতে রাজধানী কিয়েভ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহর রক্ষা করা যায়।

জালুঝনির জায়গায় এখন ইউক্রেনের সেনাপ্রধান হয়েছেন জেনারেল ওলেকসান্দর সিরস্কি সিরস্কি। জালুঝনির অধীনে স্থল কমান্ডার ছিলেন সিরস্কি। বাখমুত যুদ্ধে বিপর্যয়ের পেছনে সিরস্কির কৌশল প্রধান ভূমিকা রেখেছিল।

সিরস্কি সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আভদিবকাকে পতনের হাত থেকে রক্ষার জন্য তিন বা চার ব্রিগেড সেনা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তাঁর এই উদ্ধার অভিযানের পরিকল্পনাতে এখনই গুরুতর সব সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।

আভদিবকা উদ্ধারের জন্য সিরস্কির সেনারা যে ছোট শহর সেলিডোভে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, সেটা আভদিবকা থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। রুশ বাহিনী সেটা জানতে পেরে এখন সেলিডোভ শহরে ক্ষেপণাস্ত্র ও ক্লাস্টার বোমা দিয়ে হামলা শুরু করে।

টেলিগ্রাম, এক্সসহ বিভিন্ন  সামাজিক মাধ্যমে রাশিয়ান ব্লগাররা দাবি করেছেন, রুশ বাহিনীর হামলার সিরস্কির একটা ব্রিগেড পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

আঞ্চলিক গভর্নর সূত্রে জানা যাচ্ছে, রুশ বাহিনীর বিমান হামলা সেলিডোভের হাসপাতালে আঘাত করেছে। ইউক্রেনীয় প্রোপাগান্ডা মেশিন এখন পুরোদমে সক্রিয়।

তারা দাবি করছে, সেলিডোভের হাসপাতাল ও মাতৃসদন লক্ষ্য করে হামলা করেছে রুশ বাহিনী। কিন্তু বাস্তবে ইউক্রেনীয় বাহিনী ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ সেনা খুইয়েছে।
জেনারেল সিরস্কি অঙ্গীকার করেছেন, আভদিবকা শহরের জন্য ইউক্রেনের তৃতীয় ব্রিগেড লড়াই করবে। বাস্তবে এর অর্থ হচ্ছে, আজভ ব্রিগেডকে নতুন করে গঠন করা।

ইউক্রেনের উগ্র জাতীয়তাবাদীদের জন্য আজভ ব্রিগেড মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করে। ইউক্রেনে হামলা চালানোর পেছনে পুতিনের একটা অজুহাত হলো তিনি নব্য-নাৎসিদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছেন। ইউক্রেনে যদি নব্য-নাৎসি বলে কিছু থেকে থাকে, তাহলে আজভ ব্রিগেডই তার দৃষ্টান্ত। জেলেনস্কির রাজনৈতিক ক্ষমতা অনেকটাই নির্ভর করে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী এবং নির্দিষ্ট করে অতি জাতীয়তাবাদীদের শক্তির ওপর।

যেভাবে বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে, ইউক্রেনের তৃতীয় ব্রিগেডের পক্ষে বাস্তবে সেটা করা কঠিন। ইউক্রেনের উত্তরাঞ্চল থেকে এসে তারা যখন আবভিদকাতে প্রবেশ করবে, তখন সেখানকার পরিস্থিতি অত্যন্ত শোচনীয় হবে। আভদিবকার পতন জেলেনস্কিকে অত্যন্ত খারাপ পরিস্থিতিতে ফেলে দেবে। তিনি তাঁর প্রবল সমর্থক জালুঝনিকে হারিয়েছেন।

ওয়াশিংটন রাশিয়ানদের সঙ্গে কোনো চুক্তি করতে চায় না। ওয়াশিংটনের মূল মনোযোগের জায়গা হলো রাশিয়াকে তারা বহু দিক থেকে হারাতে চায়। তারা রাশিয়াকে শুকিয়ে মারতে চায়। একই সঙ্গে দেশটির প্রেসিডেন্ট পুতিনকে সরাতে চায়। ওয়াশিংটনের এই নীতিকে খাটো করে ইউক্রেন রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করুক, সেই ধারণা নিতে পারছে না বাইডেন প্রশাসন।

কিন্তু ইউক্রেন নিয়ে ওয়াশিংটনের বেশির ভাগ নীতিই ব্যর্থ হয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত নিষেধাজ্ঞাও রাশিয়ার অর্থনীতির ভিত ভাঙতে পারেনি; বরং পশ্চিমা বিশ্বের কাছ থেকে রাশিয়ার অর্থনীতি চীন, ভারত ও ব্রিকসের অন্য দেশগুলোর দিকে ঘুরে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিও ইউক্রেন যুদ্ধের মোড় ঘুরাতে পারেনি।

সবকিছু মিলিয়ে এ লেখার মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ইউক্রেনে জেলেনস্কি সরকার নড়বড়ে অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছে। কেননা, জেলেনস্কির সামরিক আইনভিত্তিক সরকার কোনো নির্বাচন করবে না এবং সেখানে কোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়াও চলতে দেবে না। কিন্তু সেনাবাহিনীর মধ্যে ক্ষোভ বেড়েই চলেছে। আজ হোক বা কাল, সেনাবাহিনী জালুঝনিকে আবার সেনাপ্রধান হিসেবে বেছে নেবে।

সে কারণেই কিয়েভে খুব শিগগিরই সরকার পরিবর্তন হতে যাচ্ছে।

  • স্টিফেন ব্রায়েন, সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসি অ্যান্ড ইয়র্কটাউন ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত