গত সপ্তাহে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদির ওপর ঘটে যাওয়া দুঃখজনক হত্যাচেষ্টা এবং সার্বিকভাবে অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির পটভূমিতে অন্তর্বর্তী সরকার গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতা, আসন্ন নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থী ও জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্বদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এ–সংক্রান্ত একটি নীতিমালাও প্রকাশ করেছে ১৫ ডিসেম্বর। যখন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নাগরিকেরা একটি ভয়ভীতিহীন, সহিংসতামুক্ত আনন্দমুখর নির্বাচনী পরিবেশ প্রত্যাশা করছে, যেখানে বৈধ-অবৈধ সব ধরনের অস্ত্রের ব্যবহার সংকোচনের দাবি উঠছে, সেখানে এই সিদ্ধান্ত দিয়ে কী অর্জন হবে? রাষ্ট্রের দায়িত্ব হিসেবে নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রয়াস নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই সিদ্ধান্ত কি নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, নাকি নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিকেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবে?
আমার বিবেচনায়, এ সিদ্ধান্ত কেবল নীতিগতভাবে ভুল নয়, বরং দীর্ঘ মেয়াদে এটি সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
নির্বাচনী রাজনীতি ও সহিংসতার ঝুঁকি
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় নির্বাচন মানেই তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা, উত্তেজনা এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে সহিংসতার আশঙ্কা। এমন পটভূমিতে রাজনৈতিক নেতাদের হাতে বৈধ অস্ত্র থাকা মানে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার গণ্ডি ছাড়িয়ে সহিংসতার সম্ভাব্য বিস্তার।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডগুলো—যেমন চট্টগ্রামে রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে এবং মিরপুরে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডগুলোর ভিডিওতে দেখা যায়, এখানে ঘাতকেরা পরিকল্পনা করে এমনভাবে ঘটনাটি ঘটিয়েছে যে নিহত ব্যক্তির কাছে অস্ত্র থাকলেও সম্ভবত তা তিনি ব্যবহার করার কোনো প্রস্তুতি বা সময় পেতেন না। অতীতে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়, যাঁরা বিভিন্ন সময় হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, তাঁদের অনেকেরই ব্যক্তিগত অস্ত্র ছিল।
রাজনৈতিক কর্মসূচি, মিছিল, পাল্টাপাল্টি অবস্থান—এসব পরিস্থিতিতে অস্ত্রের উপস্থিতি কেবল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে নয়, পুরো সমাজকেই ঝুঁকির মধ্যে ফেলে। সমাজবিজ্ঞানের ভাষায়, এটি ‘স্পিল ওভার’—একটি সিদ্ধান্তের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার যুক্তি এখানে শেষ পর্যন্ত সামষ্টিক নিরাপত্তার অবনমন ঘটাতে পারে।
সহিংসতার স্বাভাবিকীকরণ ও সমাজের সামরিকায়ন
এ সিদ্ধান্ত সমাজে একটি গভীর ও বিপজ্জনক মনোভাব তৈরি করতে পারে—নিরাপত্তা মানেই অস্ত্র। একে রাজনৈতিক বিজ্ঞান ও নিরাপত্তা অধ্যয়নে বলা হয় দৈনন্দিন নিরাপত্তার সামরিকায়ন (মিলিটারাইজেশন অব এভরি সিকিউরিটি)। এটি কোনো সুস্থ সমাজের লক্ষণ নয়। ড্যানিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ব্যারি বুজান ও কোপেনহেগেন স্কুলের নিরাপত্তাতত্ত্ব অনুযায়ী, যখন রাষ্ট্র কোনো সামাজিক বা রাজনৈতিক সমস্যাকে ‘নিরাপত্তা সমস্যা’ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং এর সমাধান হিসেবে ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা (যেমন অস্ত্র, বলপ্রয়োগ) বৈধতা দেয়, তখন সহিংসতা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।
এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। সেখানে ব্যক্তিগত অস্ত্র বহনের সাংস্কৃতিক ও আইনি বৈধতা সমাজে দীর্ঘদিন ধরে সহিংসতার একধরনের সহনশীলতা তৈরি করেছে। গবেষণা দেখায়, অস্ত্র সহজলভ্য হলে বিরোধ, রাগ বা আতঙ্ক অনেক দ্রুত প্রাণঘাতী রূপ নিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের বাস্তবতা বাংলাদেশে সরাসরি অনুকরণযোগ্য না হলেও অস্ত্রের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা কীভাবে সহিংসতাকে স্বাভাবিকীকরণ করে, সে শিক্ষা অস্বীকার করা যায় না।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব ব্যক্তির ঘাড়ে : একটি সাংবিধানিক প্রশ্ন
আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণার কেন্দ্রে আছে নিরাপত্তা। টমাস হবসের সামাজিক চুক্তি ধারণা অনুযায়ী, মানুষ রাষ্ট্র গঠন করেছে মূলত নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। আর জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার স্পষ্টভাবে বলেছেন, রাষ্ট্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো বৈধ সহিংসতার একচেটিয়া অধিকার (মনোপলি অব লেজিসলেটিভ ভায়োলেন্স)। এ প্রেক্ষাপটে যখন রাষ্ট্র নিজেই বলে দেয় যে গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অস্ত্র বহন করা প্রয়োজন, তখন দুটি গুরুতর প্রশ্ন উঠে আসে। প্রথমত, রাষ্ট্র কি তার মৌলিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে? দ্বিতীয়ত, তাহলে সংবিধানের সেই প্রতিশ্রুতি—যেখানে বলা হয়েছে, নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে—তা কি কার্যত দুর্বল হয়ে পড়ে না?
পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা এখানে প্রাসঙ্গিক। সেখানে রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী মহলের ব্যক্তিগত সশস্ত্র নিরাপত্তা ধীরে ধীরে একটি স্বাভাবিক চিত্রে পরিণত হয়েছে। ফলাফল হলো রাষ্ট্রীয় পুলিশি ব্যবস্থার ওপর আস্থাহীনতা, অস্ত্রের অবৈধ বিস্তার এবং সহিংসতার চক্র, যা আজও দেশটিকে ভোগাচ্ছে।
নিরাপত্তার বেসরকারীকরণ ও অস্ত্রবাজারের প্রসার
যেখানে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য অস্ত্রের লাইসেন্স বাড়ে, সেখানে অনিবার্যভাবে অস্ত্রের বাজারও সক্রিয় হয়—বৈধ ও অবৈধ উভয় ধরনের। বাংলাদেশের দুর্বল সীমান্ত নিরাপত্তা এবং দুর্বল পুলিশি ব্যবস্থাকে বিবেচনায় নিলে এটা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়, অবৈধ অস্ত্র বাজারের জন্য সরকারই এই সিদ্ধান্ত আনন্দের সংবাদ হিসেবে স্বাগত জানানো হবে। লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশে (বিশেষ করে ব্রাজিল ও মেক্সিকোতে) নিরাপত্তার বেসরকারীকরণ ও সশস্ত্র গার্ড সংস্কৃতি সমাজে অপরাধ ও সহিংসতা কমানোর বদলে বরং আইনের শাসন দুর্বল করেছে—এটি নিরাপত্তা গবেষণায় বহুল আলোচিত বিষয়।
শেষ কথা
নিরাপত্তা কখনোই কেবল অস্ত্রের মাধ্যমে অর্জিত হয় না। নিরাপত্তা আসে বিশ্বাসযোগ্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, পেশাদার পুলিশি ব্যবস্থা, রাজনৈতিক সহনশীলতা ও আইনের শাসন থেকে। নেতাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া রাষ্ট্রের সক্ষমতার প্রমাণ নয়; বরং এটি একধরনের স্বীকারোক্তি যে রাষ্ট্র নিজেই তার নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না। বাংলাদেশের মতো একটি ঘনবসতিপূর্ণ, রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল সমাজে এই সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে সহিংসতার নরমালাইজেশন, সমাজের সামরিকায়ন এবং রাষ্ট্র-নাগরিক সম্পর্কের মৌলিক ভিত্তিকেই দুর্বল করতে পারে। এখনই এই নীতির পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন—নিরাপত্তাকে অস্ত্রের নয়, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ও গণতান্ত্রিক শাসনের প্রশ্ন হিসেবে দেখার জন্য।
● কাজী মারুফুল ইসলাম অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
* মতামত লেখকের নিজস্ব