বাইডেনের সৌদি সফরকে যে কারণে স্বাগত জানাতে হবে

জেদ্দায় মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে জো বাইডেনের সাক্ষাৎছবি : রয়টার্স

জো বাইডেনের সৌদি আরব সফর অল্পবিস্তরের চেয়েও একটু বেশি বিতর্ক সৃষ্টি করল। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার একেবারে শুরুতে নীতিগতভাবে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল বাইডেন প্রশাসন। কিন্তু এখন অনেকটাই সমঝোতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যাচ্ছে। স্বভাবতই বাইডেন প্রশাসনকে ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কিন্তু সৌদি আরবের ক্ষেত্রে এ অবস্থানের পরিবর্তনকে স্বাগত জানানোর অনেক ভালো কারণ রয়েছে।

২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণাকালে বাইডেন সৌদি আরবকে ‘জাতিচ্যুত’ বলে অভিহিত করেছিলেন। বাইডেন একসময় সৌদি আরবের কার্যত শাসক যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে (যিনি এমবিএস নামে সুপরিচিত) কূটনৈতিকভাবে একঘরে করে রেখেছিলেন। গত বছর তাঁর প্রশাসন একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে ২০১৮ সালে সৌদি বংশোদ্ভূত সাংবাদিক জামাল খাসোগির নিষ্ঠুর হত্যার জন্য সালমানকে দায়ী করা হয়েছিল।

জ্বালানির দামের পাগলা ঘোড়া এবং আকাশচুম্বী মূল্যস্ফীতির কারণে যে জনচাপ সৃষ্টি হয়েছে, তাতে বাইডেনকে তাঁর হিসাব বদলাতে হয়েছে। এখন তেলের জন্য তাঁর প্রশাসনের সৌদি আরব ও আরব আমিরাতকে খুব করে দরকার।

সমালোচকদের দাবির বিপরীতে দাঁড়িয়ে বলা যায়, বাইডেনের সৌদি সফর আমেরিকার বড় ধরনের দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ নয়। এর বিপরীতে শেষ পর্যন্ত বাইডেন পরীক্ষিত একটি মার্কিন নীতি গ্রহণ করলেন। মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষেত্রে ভারসাম্যপূর্ণ নীতিই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সব সময়ের জন্য কাম্য বিকল্প। শক্তিমত্তা প্রদর্শন কিংবা সক্রিয় অবস্থান হঠাৎ করেই বিস্ময়ের জন্ম দেয়, কিন্তু খুব শিগগির আবার ঘৃণা, অস্থিতিশীলতা ও অপমানের পুনর্জন্ম হয়।

বর্তমানে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত—দুটি দেশের কোনোটিই যুক্তরাষ্ট্রের ইরান–নীতি নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। কেননা, তারা তাদের ভূখণ্ডে ইরান–সমর্থিত ইয়েমেনের যোদ্ধাদের হামলার ভয়ে ভীত। কিন্তু বাইডেনের কাছে এ ভয় প্রশমন করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই, আবার সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের ক্ষেত্রে আমেরিকার আঞ্চলিক আধিপত্য মেনে নেওয়া ছাড়া খুব কম বিকল্প আছে।

১৯৫০-এর দশকে প্রেসিডেন্ট আইসেন হাওয়ারের অভিজ্ঞতাটি বিবেচনা করা যাক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবসানে মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে যুক্তরাষ্ট্রের তারা সবে উদিত হচ্ছিল। ১৯৫৬ সালে সুয়েজ খাল ঘিরে সৃষ্ট সংকটের পর আইসেন হাওয়ার ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইসরায়েলকে মিসর থেকে সরে যাওয়ার দাবি জানান। উদ্দেশ্য ছিল সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সুদৃঢ় করা। মাত্র দুই বছর পর আইসেন হাওয়ার যে সুনাম কুড়িয়েছিলেন, তা ধূলিসাৎ হয়ে গেল। অস্থির লেবাননে স্থিতিশীলতা আনতে সামরিক অভিযান চালানোর পরেই পরিস্থিতি আমূল পাল্টে গেল।

রোনাল্ড রিগ্যানও একই ধরনের ধ্বংসাত্মক আচরণের শিকার হয়েছিলেন। প্রথমে তিনি মধ্যপ্রাচ্যে শক্তি প্রদর্শন করতে চেয়েছিলেন। লেবাননের গৃহযুদ্ধ থামাতে গিয়ে ১৯৮৩ সালে তিনি মার্কিন সেনা মোতায়েন করেন। কিন্তু ভয়াবহ বোমা হামলায় ২৫৮ জন আমেরিকান নিহত হওয়ার পর তড়িঘড়ি করে সেখান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। আঞ্চলিক ক্রীড়নকেরা তাঁর ওপর সন্তুষ্ট হতে পারেননি। কল্পনা করুন তো, কানেটিকাটের চেয়ে ছোট কিংবা কানসাসের চেয়েও কম লোকসংখ্যার একটি দেশের সংঘাত নিরসনে বৃহত্তম পরাশক্তি ব্যর্থ হয়েছে?

১৯৯০ ও ২০০০–এর দশকে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে প্রধান অনুঘটক ছিল ইরাক। প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের বাহিনী ১৯৯০ সালে কুয়েত আক্রমণ করে বসে। জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশের সেনারা সেখানে ৩৮ দিন ধরে বিমান হামলা চালান। এরপর ১০০ ঘণ্টা ধরে চলে স্থল অভিযান। সিএনএন এ অভিযান সরাসরি সম্প্রচার করেছিল। ইরাকের বাহিনীকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। কুয়েত মুক্ত হয়েছিল। আঞ্চলিক ক্রীড়নকদের ফের সমীহ অর্জন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। দৃষ্টান্ত হিসেবে সিরিয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যায়। সিরিয়া ১৯৮৩ সালে লেবাননে মার্কিন বাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু উপসাগরীয় যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় যৌথ শান্তি প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছিল দেশটি।

এই সমীহ খুব ক্ষণস্থায়ী ছিল। সাদ্দাম হোসেন ক্ষমতা ছাড়লেন না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র চাইছিল তিনি ক্ষমতা ছেড়ে দিন। যুক্তরাষ্ট্র সে সময়ে ইরাককে শায়েস্তা ও একঘরে করার নীতি নিয়েছিল। আমেরিকার আঞ্চলিক মিত্র, যেমন আরব আমিরাত, এ নীতির বিরোধিতা করেছিল। ফলে আবার একটা ফাটল তৈরি হয়।

২০০০–এর দশকেও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। সাদ্দাম হোসেনকে উচ্ছেদের জন্য জর্জ ডব্লিউ বুশ এবার ঝটিকা একটি সামরিক আক্রমণের নির্দেশ দিলেন। প্রতিপক্ষকে হকচকিত করে দিয়েছিল এ আক্রমণ। এবারে লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি তাঁর গণবিধ্বংসী অস্ত্র সংবরণ করলেন, ইসলামি চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শামিল হলেন। ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের বশ্যতাও স্বীকার করে নিলেন।

এ ক্ষেত্রেও আমেরিকার সৌভাগ্য বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। একজন ইরাকি বিদ্রোহী যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীকে খাদের মধ্যে নামিয়ে দিয়েছিল। আমেরিকান কূটনীতিকেরা এই বেয়াড়া শত্রুতা মিটমাট করতে পারেননি কিংবা ভয়ানক সংঘাতও থামাতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে গণতন্ত্রের বীজ বপন করতে গেছে, কিন্তু সেখানে ইরান মুখাপেক্ষী চারার অঙ্কুর হয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার প্রতিপত্তি আবার ক্ষয় হতে থাকে। এমনকি দীর্ঘদিনের একনিষ্ঠ মিত্ররাও এবার বুড়ো আঙুল দেখাতে শুরু করল। মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক যুক্তরাষ্ট্রে ছয় বছর সফরে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন। সিরিয়া আবার শত্রুতা শুরু করে দেয়। ইরাক, লেবানন ও ফিলিস্তিনে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থিত সরকারকে অস্থিতিশীল করার তৎপরতা শুরু করে।

একই চক্রের মধ্যে বারবার ঘুরপাক খেতে খেতে মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা অর্জনই যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি প্রধান চাওয়া। এর অর্থ হচ্ছে, মিসর থেকে উপসাগরীয় অঞ্চল-জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ হওয়া সত্ত্বেও কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে চলা।

বর্তমানে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত—দুটি দেশের কোনোটিই যুক্তরাষ্ট্রের ইরান–নীতি নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। কেননা, তারা তাদের ভূখণ্ডে ইরান–সমর্থিত ইয়েমেনের যোদ্ধাদের হামলার ভয়ে ভীত। কিন্তু বাইডেনের কাছে এ ভয় প্রশমন করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই, আবার সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের ক্ষেত্রে আমেরিকার আঞ্চলিক আধিপত্য মেনে নেওয়া ছাড়া খুব কম বিকল্প আছে।

চীন ও রাশিয়া জাতিসংঘে ও আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা থেকে ইরানকে ঢাল হিসেবে রক্ষা করছে। কিন্তু তেলসমৃদ্ধ এই ভঙ্গুর দেশগুলোকে রক্ষা করার সামর্থ্য তাদের নেই।

আরও পড়ুন

মিসর এখন রাশিয়ার অক্ষের দিকে ঝুঁকছে। কিন্তু মিসরকে যদি ইসরায়েলের সঙ্গে অস্ত্রশক্তির প্রতিযোগিতায় মাথা বাঁচিয়ে রাখতে হয়, তাহলে মার্কিন অস্ত্রের বিকল্প নেই। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর সোভিয়েত উপদেষ্টারা মিসরে যে সমরাস্ত্র দিয়েছিল, তার তিক্ত অভিজ্ঞতা সেখানকার সামরিক কর্মকর্তাদের স্মৃতিতেই উঠে এসেছে।

একইভাবে ইথিওপিয়ার সঙ্গে পানি নিয়ে মিসরের যে বিরোধ, তা সমাধান করা চীনের পক্ষে সম্ভব নয়। যদিও চীন ইথিওপিয়ায় সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী ও ঋণদাতা। সত্যি বলতে কি, সংঘাত নিরসনে কেবল আমেরিকারই দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে।

২০১৮ সালে খাসোগি হত্যার পর আমি বলেছিলাম, যুক্তরাষ্ট্রের অন্য ঘনিষ্ঠ মিত্রের যে মান, সেটা সৌদি আরবও যেন বজায় রাখে, সে প্রত্যাশা থাকতেই পারে। এরপরও দুই দেশের যৌথ স্বার্থ ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতা শেষ পর্যন্ত জিতবে। জো বাইডেনের সৌদি আরব সফর দেখে মনে হচ্ছে, তিনি এখন সেই সিদ্ধান্তেই পৌঁছেছেন।

স্বত্ব প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: মনোজ দে

  • বারাক বারফি নিউ আমেরিকার সাবেক রিসার্চ ফেলো এবং ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ভিজিটিং ফেলো