কত দূর এগোল আমাদের বিনোদন-সৃজন?

‘মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারটি আমাদের সংস্কৃতি ও বিনোদনজগতের সব কর্মীকে সম্মান জানানোর আয়োজন’

একটা পেনসিল ছিল।

লিখে লিখে ক্ষয়ে ফেলতে এক হপ্তাও লাগেনি।

পেনসিলকে জিজ্ঞেস করলে বলবে:

‘একটা গোটা জীবন।’

আমি বলব:

‘এমন আর কী, মোটে তো একটি সপ্তাহ।’

২৫ বছর মহাকালের বিচারে তেমন কিছু নয়। কিন্তু আমাদের বিচারে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্বটুকু। ১৯৯৯ সালে মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারের প্রথম আসরটি বসেছিল ১২ মার্চ। তার আগের বছর আমরা করেছিলাম মেরিল-ভোরের কাগজ তারকা জরিপ পুরস্কার। ১৯৯৮ সালেরটা উপস্থাপন করেছিলেন হানিফ সংকেত। ১৯৯৯ সালেরটা, মানে প্রথম মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার উপস্থাপন করেন আফজাল হোসেন এবং সুবর্ণা মুস্তাফা। সে বছরই প্রথম প্রবর্তন করা হয় সমালোচক পুরস্কারও।

প্রথম মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার পেয়েছিলেন জনপ্রিয় পর্বে জাহিদ হাসান, বিপাশা হায়াত, রিয়াজ, শাবনূর, তপন চৌধুরী, সাবিনা ইয়াসমিন, হানিফ সংকেত, নোবেল, মৌ, এলআরবি এবং আহমেদ ইউসুফ সাবের। সমালোচক পুরস্কার পেয়েছিলেন তারিক আনাম খান (সেরা নাট্যকার ও অভিনেতা), মেঘনা, সালাহউদ্দিন লাভলু (নির্দেশক)।

পুরস্কার তুলে দিতে মঞ্চে উঠেছিলেন নীলুফার ইয়াসমিন, সুবীর নন্দী, লাকী আখান্দ্‌, মাহমুদুর রহমান, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, গীতি আরা সাফিয়া চৌধুরী, আলী যাকের, সারা যাকের, হুমায়ুন ফরীদি, সুচন্দা, বুলবুল আহমেদ, মাহবুব জামিল, বেবী ইসলাম, শর্মিলী আহমেদ ও গোলাম মুস্তাফা।

মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা গ্রহণ করে যাঁরা আমাদের ধন্য ও কৃতার্থ করেছিলেন, তাঁরা হলেন সোহরাব হোসেন, সুভাষ দত্ত, আব্দুল লতিফ, শাহ আবদুল করিম, ফেরদৌসী মজুমদার, কলিম শরাফী, ফেরদৌসী রহমান, বেবী ইসলাম, সুধীন দাশ, ফিরোজা বেগম, মুস্তাফা মনোয়ার, রামকানাই দাশ, রাজ্জাক, ফাহমিদা খাতুন, কবরী, সৈয়দ হাসান ইমাম, ববিতা, আলী যাকের, রুনা লায়লা ও সাবিনা ইয়াসমিন।

তালিকার দিকে তাকালে শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় হৃদয় সিক্ত হয়ে ওঠে। তাঁদের মধ্যে অনেককেই আমরা হারিয়েছি।

মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারটি আমাদের সংস্কৃতি ও বিনোদনজগতের সব কর্মীকে সম্মান জানানোর আয়োজন। পুরস্কারে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার চেষ্টা থাকে শতভাগ।

সমালোচক পুরস্কারের বিচারক হিসেবে যাঁরা থাকেন, তাঁরা জানেন, ফল তৈরি করে খামে করে ভরে তাঁরা দিয়ে যান, অনুষ্ঠানের আগে আগে তা খোলা হয়; স্কয়ার কিংবা প্রথম আলো থেকে কোনো রকমের তদবির কিংবা ইচ্ছা-অনিচ্ছা ঘুণাক্ষরেও কখনো প্রকাশ করা হয় না। জনপ্রিয় শাখার ভোটের ফল যা আসে, তা-ই গ্রহণ করা হয়। ফলে পুরস্কারের সঙ্গে কোনো অর্থমূল্য দেওয়া না হলেও এ পুরস্কার নিয়ে দেশবাসীর আগ্রহ থাকে, শিল্পী-নির্মাতারাও এটির দিকে তাকিয়ে থাকেন।

কোভিডের কারণে একবার পুরস্কার দেওয়া হয়নি, আরেকবার অনুষ্ঠান করা যায়নি বলে শিল্পীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুরস্কার তুলে দিয়ে আসা হয়েছিল।

২৫ বছর ধরে বিরামহীন এ চেষ্টার ফল কী দাঁড়াল? এখানেই আসে নাজিম হিকমতের কবিতাটার কথা। মহাকালের বিচারে ২৫ বছর তো কিছুই নয়, কিন্তু আমাদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়টা ধরে আমরা এই কাজটার সঙ্গে যুক্ত থাকলাম। তাতে কি কোনো সুফল মিলল?

রবীন্দ্রনাথের গানে আছে, ‘তোর আপনজনে ছাড়বে তোরে, তা ব’লে ভাবনা করা চলবে না। ও তোর আশালতা পড়বে ছিঁড়ে, হয়তো রে ফল ফলবে না।’

আজকে আমাদের চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতিজগতের দিকে তাকালে মনে হয়, মেরিল-প্রথম আলোর এই প্রয়াস ব্যর্থ হয়ে যায়নি। সুফল মিলছে! যাঁরা মেরিল-প্রথম আলোর সমালোচক পুরস্কার পেয়েছেন, অনেক বছর আগে, তাঁরা তখন কেবল শুরু করেছেন, এই পুরস্কার তাঁদের স্বীকৃতি ও সম্মানই কেবল দেয়নি, কাজ করার সুযোগ এনে দিয়েছে, নিরীক্ষা করার সাহস দিয়েছে। তার সুফল আমরা পেয়েছি। বাংলাদেশের টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে অনেক চমৎকার কাজ হয়েছে। আমাদের ছবি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎসবে যাচ্ছে, পুরস্কৃত হচ্ছে।

এখন আশার আলো হয়ে জ্বলে উঠেছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। জয় গোস্বামীর মতো কবি ঢাকায় এসে মোশাররফ করিমের সঙ্গে দেখা করেছেন এবং তাঁকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। কান ফেস্টিভ্যাল থেকে শুরু করে অনেক বড় বড় উৎসবে আমাদের ছবি ও শিল্পীরা যাচ্ছেন, সম্মান পাচ্ছেন। এখন তো ওটিটি প্ল্যাটফর্মের কাজগুলোও আন্তর্জাতিক উৎসবে স্বীকৃত হচ্ছে। চলচ্চিত্র নিয়ে আমরা হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। হাওয়া আর পরাণ এসে পুরো দৃশ্যপট পাল্টে দিল। এখন সিনেমা হলে মানুষ যাচ্ছে। প্রিয়তমা এবং সুড়ঙ্গ ছবির দেখার টিকিট পাওয়া যাচ্ছিল না।

আজকে বাংলাদেশকে যাঁরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরছেন, কিংবা যাঁরা আমাদের চলচ্চিত্র এবং ছোট পর্দাকে ঋদ্ধ করছেন, তাঁদের অনেকেই তাঁদের কর্মজীবনের শুরুতে মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার পেয়েছেন, মনোনয়ন পেয়েছেন। সালাহউদ্দিন লাভলু, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, অমিতাভ রেজা, গিয়াসউদ্দিন সেলিম, মেজবাউর রহমান সুমন, আশফাক নিপুণ, অনিমেষ আইচ থেকে শুরু করে এ তালিকা অনেক বড়। সবচেয়ে বড় কথা, নবীনতররা আসছেন। একেকটা নাম দেখে চমকে উঠতে হয়, তাঁদের কাজ দেখে অভিভূত না হয়ে পারা যায় না। কীসব কাজই না হচ্ছে আমাদের সিনেমায়, কিংবা ছোট পর্দায়।

২৫ বছর পরে আমাদের সান্ত্বনা এবং প্রেরণার জায়গাটা তা-ই অনেক বড়। বাংলাদেশে বিদেশি সিনেমা মুক্তি দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু সেসব ছবি নিয়ে হইচই হচ্ছে না; দর্শকদের আগ্রহ বাংলাদেশের ছবি নিয়ে। একটা সময় আমরা শুনতাম, কলকাতায় বাংলাদেশ টেলিভিশনের নাটক দেখার জন্য লোকে অ্যানটিনায় ঘটিবাটি লাগাত। আজকে বাংলাদেশের ওটিটির কাজগুলো নিয়ে পড়শি-দেশের আর রিভিউয়াররা প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

ভোর হচ্ছে, আলো আসছে।

বাংলাদেশের সংস্কৃতিজগতের সবাইকে আবারও ধন্যবাদ, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা। স্কয়ার গ্রুপ এবং বিশেষ করে এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরীকে বিশেষ রকম ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা।

মেরিল-প্রথম আলো অনুষ্ঠানটির সামনে-পেছনে বহু মানুষের বহুদিনের পরিশ্রম থাকে। তাঁদের কাউকে মঞ্চে বা পর্দায় দেখা যায়, কাউকে দেখা যায় না। আমরা কথায় কথায় বলি, আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করে...কিন্তু তারকা শিল্পীদের বেলায় কথাটা আক্ষরিক অর্থেই সত্য। তাঁদের সময় মূল্যবান। সময়ের হিসাবেই তাঁরা আয় করে থাকেন। মেরিল-প্রথম আলো অনুষ্ঠানে তাঁরা সময় দেন স্রেফ ভালোবাসার কারণে। সবাই মিলে ভালো একটা কিছু করব—এ রকমের একটা ব্রত থেকে। কত মানুষের কাছে কত ধরনের ঋণ যে রয়ে যায়, তা বলাও হয়ে ওঠে না, শোধ করার তো প্রশ্নই ওঠে না।

আমাদের সমাজকে পেছনে টানে অন্ধকারের শক্তি। কিন্তু অন্ধকারকে তরবারি ঘুরিয়ে দূর করা যায় না। আলো জ্বালতে হয়। সংস্কৃতি হচ্ছে সেই আলো, যা পশ্চাৎপদতার আঁধারকে দূর করে। যা সমাজকে প্রীতিময় করে, মানুষের মনে আশা তৈরি করে। একটা দেশ শুধু জিডিপি দিয়ে এগোয় না। শিল্প-সংস্কৃতি তাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। যে দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এত ঋদ্ধ, সে দেশ কেন সিনেমায়, নাটকে, সংগীতে ভালো করবে না!

আমাদের সমুদয় প্রয়াস আলো জ্বালানোর, দেশ-সমাজ-মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। বাংলার আবহমান সংস্কৃতির শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। সামান্য ঝড়ে তা উপড়ে পড়বে না। কিন্তু তাকে আলো দিয়ে, পানি দিয়ে পুষ্ট করার দায়িত্ব তো আমাদের সবার।

বাংলাদেশের সব শিল্পী ও কুশলীকে আবারও অভিবাদন।

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক