একটি এনজিওর ডিজিটাল যাত্রার গল্প

বুরো বাংলাদেশ গ্রাহকদের চাহিদা, পরিবেশ, অর্থনৈতিক অবস্থা এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে নানা পরিবর্তন নিয়ে এসেছে
ছবি: বুরো বাংলাদেশ–এর ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

পরিবর্তন ছাড়া অগ্রগতি অসম্ভব—এ কথা বলেছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সফল প্রযুক্তিবিদ ও প্রথম অ্যানিমেশন প্রোগ্রামার ওয়াল্ট ডিজনি। আমরা সেই পরিবর্তনের পথেই হাঁটছি। ডিজিটালকরণের ব্যাপক গতি বৃদ্ধির কারণে সারা বিশ্বে জীবন-জীবিকা, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পসহ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। সংযোগ এবং স্মার্ট ডিভাইসের ব্যবহার খুব সহজ হওয়ার কারণে বাংলাদেশও ডিজিটালকরণে খুব সহজে সম্পৃক্ত হতে সক্ষম হয়েছে। বিশেষ করে সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ রূপরেখা ও উদ্যোগ এই সম্পৃক্ততাকে দ্রুত করেছে।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বুরো বাংলাদেশ একটি উন্নত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দারিদ্র্য নিরসনসহ জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে তিন দশক ধরে কাজ করে যাচ্ছে। জনগণের সার্বিক জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সহযোগিতার মাধ্যমে একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও আত্মনির্ভরশীল সমাজ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বুরো বাংলাদেশ গত পাঁচ বছরে সংস্থার ডিজিটালকরণে বেশ কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় সংস্থার প্রায় সব গ্রাহককে ভেরিফায়েড ডিজিটাল পেমেন্ট পদ্ধতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়েছে।

দেশজুড়ে প্রায় ১ হাজার ৩০০-এর বেশি শাখার মাধ্যমে ২৫ লাখ গ্রাহকের স্বপ্ন, লক্ষ্য এবং উন্নত জীবনের চাহিদা উপলব্ধি করতে বুরো বাংলাদেশ সক্ষম হয়েছে। আর সেই উপলব্ধি থেকেই দেশের শীর্ষস্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে বুরো বাংলাদেশ গ্রাহকদের চাহিদা, পরিবেশ, অর্থনৈতিক অবস্থা এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে নানা পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। এই পরিবর্তনগুলো যেন সবার জন্য কার্যকর ও টেকসই হয়, সেই লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়েছে। যখন পরিবর্তনই একমাত্র সত্য, তখন যেকোনো পরিবর্তনকে কার্যকর ও সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য দৃঢ় মনোভাব প্রয়োজন।

অদূর ভবিষ্যতে সব আর্থিক লেনদেন ডিজিটাল মাধ্যমে সম্পন্ন হবে—এই উপলব্ধি থেকেই বুরো বাংলাদেশ সব শাখার কার্যক্রমকে অটোমেশন ও রিয়েল-টাইম কানেকটিভিটির আওতায় যুক্ত করার একটি কারিগরি ও কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।

আরও পড়ুন

এখানে বলা প্রয়োজন, ২০১৭ সালে ৩টি শাখায় সফল পরীক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে ২০১৯ সালে বুরো বাংলাদেশের সব শাখার যাবতীয় নথি সংরক্ষণ, লেনদেন এবং দৈনন্দিন কার্যক্রমকে ডিজিটাল কাঠামোতে রূপান্তর করার প্রকল্পটি সফলভাবে সম্পন্ন করেছে। ফলে সব শাখাই এখন সম্পূর্ণ ডিজিটাল ও রিয়েল-টাইম অনলাইন মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। ২০২০ সালে ইনভেনটরি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ও ফিক্সড অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের সঙ্গে শাখা পরিচালনার নিয়মিত কার্যক্রম একীভূত করার মাধ্যমে সংস্থার পুরো সিস্টেমকে হালনাগাদ করা হয়েছে, যা বুরো বাংলাদেশের এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং প্ল্যাটফর্মে রূপান্তরিত হবে। এই প্ল্যাটফর্মে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা, নিরীক্ষা এবং ক্রয়বিষয়ক কার্যক্রমকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া চলমান।

বুরো বাংলাদেশের কর্মীদের ডিজিটালি আরও দক্ষ করে তুলতে ঋণ ও সঞ্চয় সংগ্রহের জন্য সব কর্মসূচি সংগঠককে ৯ হাজারের বেশি ডেটা সিম ও নক্স নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য সক্ষম স্যামসাং ট্যাবলেট সরবরাহ করা হয়েছে। ডিভাইস হারালে তাৎক্ষণিক ব্লক করা, অফিসের কাজের সময় ইউটিউব, ফেসবুকের মতো ডোমেইন ব্লক রাখা এবং ব্যবহারকারীর কাছ থেকে ফ্যাক্টরি রিসেট সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। ফলে প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা এখন নিরাপদে ডিজিটাল এবং মোবাইল পদ্ধতিতে রিয়েল টাইমে তাঁদের পোর্টফোলিও স্ট্যাটাস ট্র্যাক, ইনপুট প্রদান এবং আপডেট করতে পারছেন।

মোবাইল আর্থিক পরিষেবাগুলোর ব্যাপক চাহিদা বৃদ্ধির কারণে সংস্থার ডিজিটাল রূপান্তরের পরবর্তী মাইলফলক ছিল গ্রাহকদের জন্য একটি ভেরিফায়েড ডিজিটাল পেমেন্ট সলিউশন তৈরি করা। এতে গ্রাহকেরা যেকোনো সময়, যেকোনো স্থান থেকে সর্বোচ্চ কম খরচে নিজেদের ফোনের মাধ্যমে অতি সহজে লেনদেন করতে সক্ষম হন।

বুরো বাংলাদেশের সব শাখায় ডিজিটালকরণ বাস্তবায়নের এই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ এবং ডিএফএস প্রোগ্রামের উন্নয়ন হওয়ায় ২০২০ সালে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ঘোষিত কোভিড প্রণোদনা প্যাকেজ বিতরণ সংস্থার জন্য সহজতর হয়েছে।

বুরো বাংলাদেশের কর্মসূচি বিভাগ ও আইসিটি টিম টেকনিক্যাল সার্ভিস প্রোভাইডার এবং মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রোভাইডারদের সঙ্গে নিয়ে অ্যান্ড টু অ্যান্ড প্লাগ অ্যান্ড প্লে সিস্টেম প্রণয়ন করছে, যা অন্যান্য এমএফআইও তাদের সুবিধার্থে ব্যবহারের সুযোগ পাবে। বুরো বাংলাদেশের এই উদ্ভাবন শুধু সংস্থার গ্রাহকদের সমস্যার সমাধানের জন্যই নয়, বরং পুরো ক্ষুদ্রঋণদান সংস্থাগুলোকে (এমএফআই) সহায়তা করার জন্য। ফলে এমএফআই খাতের ডিজিটাল উন্নয়ন দ্বারা দেশ ও জনগণের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন দ্রুত গতি লাভ করবে।

২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে সংস্থার ২টি শাখায় ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস প্রকল্পের একটি পাইলট কর্মসূচি শুরু করে। পরবর্তী সময়ে এই প্রকল্পের আওতায় গত ৩ বছরে প্রায় ৯ হাজার ২০০ জন প্রশিক্ষিত কর্মীর নিরলস প্রচেষ্টায় ডিজিটাল লেনদেনের সংখ্যা রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ৪০০টি লেনদেন দিয়ে শুরু হলেও বর্তমানে এই সংখ্যা মাসে কয়েক লাখ। ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ডিজিটাল লেনদেনের সংখ্যা ১ কোটি ৩৫ লাখ ছাড়িয়ে গেছে, যা প্রতি মাসে বৃদ্ধি পেয়েছে ২২ শতাংশ এবং টাকার অঙ্কে বৃদ্ধি পেয়েছে ১ হাজার ৩০০ কোটির বেশি। প্রবৃদ্ধির হিসাবে এই পরিসংখ্যান মাসে ১৫ শতাংশ। এভাবে সমন্বিত প্রচেষ্টার ফলে প্রতিষ্ঠানের মোট লেনদেনের প্রায় ১০ শতাংশ ডিএফএস প্রোগ্রামের অধীনে ডিজিটাল পেমেন্টে স্থানান্তরিত হয়েছে।

বুরো বাংলাদেশের সব শাখায় ডিজিটালকরণ বাস্তবায়নের এই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ এবং ডিএফএস প্রোগ্রামের উন্নয়ন হওয়ায় ২০২০ সালে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ঘোষিত কোভিড প্রণোদনা প্যাকেজ বিতরণ সংস্থার জন্য সহজতর হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে সংস্থার ৩৯ হাজার ৫৫২ জন সদস্যের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের ২৭০ কোটি টাকা সফলভাবে বিতরণ করা সম্ভব হয়েছে। পাশাপাশি বুরো বাংলাদেশের মাঠপর্যায়ের কর্মীদের বেতন বাবদ প্রায় ৫০ কোটি টাকাও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়েছে।

ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের সুবিধাগুলো প্রযুক্তিগত সক্ষমতা সৃষ্টির পাশাপাশি এই সক্ষমতাকে বহুগুণে প্রসারিত করেছে। ফলে অন্যান্য অনেক লেনদেনও এই প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে। গ্রাহকদের জন্য ২৪ ঘণ্টা পরিষেবা গ্রহণের সুযোগ উন্মুক্ত রাখার পাশাপাশি এতে গ্রাহকদের লেনদেনের সময় ও যাতায়াত খরচের সাশ্রয় হয়। গ্রাহক যেকোনো সময় যেকোনো স্থান থেকে বিনা খরচে তাঁর সাধারণ অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স, মেয়াদি সঞ্চয় ব্যালান্স, ঋণের কিস্তি ও বকেয়ার পরিমাণও দেখতে পারেন।

ডিজিটাল লেনদেনের ক্ষেত্রে সংস্থা ইতিমধ্যে সব ডিএফএস সেবা প্রদানকারীদের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে এ পর্যন্ত কয়েকবার লেনদেনের খরচ কমানোর ব্যবস্থা নিয়েছে। যেখানে নিয়মিত লেনদেনের ক্ষেত্রে ১ হাজার টাকায় সাড়ে ১৮ টাকা খরচ হয়, সেখানে বুরো বাংলাদেশে লেনদেনের ক্ষেত্রে শুরুতে ১ হাজার টাকায় ১০ টাকা খরচ হতো, যা নিয়মিত খরচের চেয়ে ৫০ শতাংশ কম। পরে এই খরচ আরও কমিয়ে ১ হাজার টাকায় ৯ টাকা বা ৯ টাকা ২০ পয়সা হয়। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, লেনদেনের এই খরচ সর্বোচ্চ ১৫০ টাকা। অর্থাৎ গ্রাহক যদি একটি ধাপে বড় অঙ্কের কোনো লেনদেন করেন, তখন তাঁর জন্য এই খরচের পরিমাণ ১৫০ টাকার বেশি হবে না। এ ছাড়া ডিজিটাল লেনদেনে অভ্যস্ত হওয়ার কারণে সদস্যরা ঘরে বসেই মোবাইল রিচার্জ, সেন্ড মানি, অনলাইন কেনাকাটাসহ নানা রকম ডিজিটাল সুযোগ পাচ্ছেন, যা কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণেও ভূমিকা রেখেছে।

  • ফারমিনা হোসেন পরিচালক, অপারেশনস ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, বুরো বাংলাদেশ।