বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এমপি রূপা হককে লেবার পার্টির সংসদীয় দল থেকে বহিষ্কারের খবর কিছুটা পুরোনো হলেও তার রেশ রয়ে গেছে। দল বহিষ্কার করলেও পার্লামেন্টে তাঁর সদস্যপদ বহাল আছে। বাংলাদেশের মতো ব্রিটেনের সংবিধানে ৭০ ধারা নেই যে দল থেকে বহিষ্কৃত হলেই তাঁকে সদস্যপদ হারাতে হবে।
বিবিসির খবর অনুযায়ী, সম্প্রতি লিভারপুলে লেবার পার্টির এক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী কাওয়াসি কাওয়ারতেংকে ‘লোক দেখানো কৃষ্ণাঙ্গ’ বলে মন্তব্য করেন রূপা হক। এই মন্তব্য বর্ণবিদ্বেষ হিসেবে গণ্য করা হয়। দলের ভেতরে-বাইরে এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হলে লেবার পার্টি তাঁকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয়।
রূপা হক বলেছিলেন, অর্থমন্ত্রী কাওয়াসি কাওয়ারতেংকে দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি একজন কৃষ্ণাঙ্গ। কারণ, তিনি ভালো ও দামি স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। দেশের সব ভালো স্কুলে পড়েছেন। পরে দুঃখ প্রকাশ করেও রূপা হক রেহাই পাননি। তাঁকে শাস্তি পেতে হয়েছে। বর্তমানে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে রূপা হক ছাড়া আরও তিন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপি রয়েছেন। টিউলিপ সিদ্দিক, রুশনারা আলী ও আফসানা বেগম।
রূপা হক কিন্তু তাঁর দলের কোনো নেতা সম্পর্কে মন্তব্য করে বহিষ্কৃত হননি। বহিষ্কৃত হয়েছেন লেবার পার্টির প্রতিপক্ষ দল ক্ষমতাসীন টোরি দলের নেতা ও অর্থমন্ত্রী সম্পর্কে মন্তব্য করে। বাংলাদেশে কি আমরা চিন্তা করতে পারি, সরকারি দলের কোনো নেতা বা এমপি বিরোধী দলের কোনো নেতা-এমপি সম্পর্কে বিদ্বেষমূলক কথা বলে শাস্তি পাবেন বা বহিষ্কৃত হবেন? অথবা এমন দৃষ্টান্তও দেখানো যাবে না যে সরকারি দলের কোনো নেতা-মন্ত্রী-এমপি সম্পর্কে অশোভন মন্তব্য করার কারণে বিরোধী দলের কোনো নেতা-এমপিকে দলের কাছে জবাবদিহি করতে হয়েছে। বরং যিনি বা যাঁরা প্রতিপক্ষ দলের প্রধান ও অন্যান্য নেতার বিরুদ্ধে যত বেশি অশোভন কথা বলবেন, তিনি বা তাঁরা পুরস্কৃত হবেন। পদোন্নতি পাবেন। সংসদে ওই রকম অশোভন মন্তব্যকে টেবিল চাপড়ে উৎসাহ জোগাতেও দেখা গেছে।
প্রথম আলোর দিল্লি প্রতিনিধি সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ভারতের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের ‘অরাজনৈতিক’ সংগঠন ‘কনস্টিটিউশনাল কন্ডাক্ট গ্রুপ’ গঠিত তদন্ত কমিটি সম্প্রতি ২০২০ সালের ২৩ থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি উত্তর-পূর্ব দিল্লির দাঙ্গার ঘটনার প্রতিবেদন জমা দেয়। এতে বলা হয়, দিনের পর দিন বিজেপি ও অন্য উগ্র হিন্দুত্ববাদী নেতাদের ঘৃণা ভাষণ এই দাঙ্গাকে উসকে দিয়েছে। কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উগ্র প্রচার দাঙ্গার সলতে হিসেবে কাজ করেছে। সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি মদন বি লোকুরের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি ঘৃণা ভাষণের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ‘রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রাতিষ্ঠানিক অনীহার’ কঠোর সমালোচনা করেছে। সমালোচনা করেছে একশ্রেণির মিডিয়াকেও; যারা উসকানিমূলক প্রচার চালিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত যে বাংলাদেশ হতে পারত সম্প্রীতির অনন্য আদর্শ, সেই বাংলাদেশে নিয়ত ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে। নেতারা মুখে ঘৃণা ছড়াচ্ছেন আর কর্মীরা লাঠিসোঁটা, ধারালো অস্ত্র বা বন্দুক নিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী দল বা সংগঠন না পেলে নিজ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ওপরই। রাজনীতির নামে যখন ক্রমাগত ঘৃণা ও বিদ্বেষের চাষ চলে—এটিই তো হওয়ার কথা।
ওই কমিটির তাৎপর্যপূর্ণ উদ্ঘাটন হলো সরকার দাঙ্গার অপরাধে ধৃত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী আইন ও বেআইনি কার্যকলাপ রোধ আইনে (ইউএপিএ) মামলা করেছে। কিন্তু কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি, যাতে প্রতিপন্ন হয় যে ধৃত ব্যক্তিরা দেশের ‘একতা, অখণ্ডতা, সংহতি, নিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্ব’ নষ্টের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত। বরং নতুন নাগরিক আইনের বিরুদ্ধে দিল্লিসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তাকে দমন করতে বিজেপি সরকার ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক প্রচার চালিয়ে আসছিল।
ব্রিটেনে রূপা হকের বিরুদ্ধে অভিযোগ বর্ণবিদ্বেষের। ভারতে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে নালিশ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতেও একইভাবে হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ানোর কারণ কী? এখানে বর্ণবিদ্বেষ নেই। দাঙ্গা বাধানোর মতো ক্ষমতাও নেই ধর্মীয় কিংবা জাতিগত সংখ্যালঘুদের।
তারপরও বাংলাদেশের রাজনীতিতে যারা ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন, তঁাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ক্ষমতা। এই ক্ষমতার জন্য কেউ সাম্প্রদায়িক কার্ড ব্যবহার করেন। কেউ স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ কার্ড খেলেন। স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও বাংলাদেশে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি থাকে কী করে। যঁাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও সংবিধানের প্রতি আনুগত্য নেই, তঁারা কি বাংলাদেশের নাগরিক হতে পারেন? যঁারা বাংলাদেশের নাগরিক, তঁাদের দেশপ্রেম নিয়ে তখনই সন্দেহ করা যাবে, যখন এর পক্ষে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ থাকবে। আর সেটি নির্ধারণ করতে পারবেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। যঁারা এখন স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির সঙ্গে আছেন, তঁাদের অতীত সুলুক সন্ধান করলেই বিষয়টি দিবালোকের মতো পরিষ্কার হবে। আওয়ামী লীগ নেতারা এখন যেই জাতীয় পার্টিকে ‘ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা’ বলে উপহাস করছেন, তাদের কৃপায়ই তঁারা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন। যাদের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি বলা হচ্ছে, তাদের সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেছে।
স্বাধীনতার পরপরই স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি নানা দল–উপদলে ভাগ হয়ে গেল এবং তারা ঘোষণা করল, প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করবে। ভোটের মাঠে নয়। অস্ত্র ও ক্ষমতার জোরে। তারা একে অপরকে ‘বিদেশি চর’, ‘সেবাদাস’ ও ‘ষড়যন্ত্রকারী’ বলে অভিহিত করতে থাকলেন। এই সুযোগে কখন আসল ষড়যন্ত্রকারীরা ঢুকে পড়ল, টেরও পেলেন না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন হিংসা-বিদ্বেষের চাষ হচ্ছে। কেউ বলেন, ‘অমুক দলকে নির্মূল করব।’ তার পাল্টা জবাব আসে, ‘তমুক পালিয়ে যাওয়ারও পথ পাবে না।’ আমাদের গণতান্ত্রিক নেতারা সারাক্ষণ পতনের ধ্বনি শোনান। তাঁরা দলের নেতা-কর্মীদের প্রতিপক্ষকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার বুলি আওড়ান। তাঁরা পতন ও দমন ছাড়া কিছু বোঝেন না।
আগে রাজনীতিকেরা সভা-সমাবেশে যেসব কথা বলতেন, তার খুব কমই গণমাধ্যমে আসত। এখন ইউটিউব, ফেসবুকের কল্যাণে অনেক বেশি মানুষ জানতে ও শুনতে পারেন। রাজনীতিকেরা অনেক সময় প্রতিপক্ষের প্রতি এমন ভাষা ব্যবহার করেন, যা শুনলে কানে আঙুল দিতে হয়। টিভি টক শোতে তাঁরা একে অপরের চোখ তুলে নেওয়ার হুমকি দেন। সারাক্ষণ বিষযুক্ত বাক্য বর্ষণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত যে বাংলাদেশ হতে পারত সম্প্রীতির অনন্য আদর্শ, সেই বাংলাদেশে নিয়ত ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে। নেতারা মুখে ঘৃণা ছড়াচ্ছেন আর কর্মীরা লাঠিসোঁটা, ধারালো অস্ত্র বা বন্দুক নিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী দল বা সংগঠন না পেলে নিজ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ওপরই। রাজনীতির নামে যখন ক্রমাগত ঘৃণা ও বিদ্বেষের চাষ চলে—এটিই তো হওয়ার কথা।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি