ই-ভ্যালি থেকে এমটিএফ: প্রযুক্তিনির্ভর প্রতারণা ঠেকানো যাবে কি?

ডেসটিনি, যুবক কিংবা ই-ভ্যালি থেকে শুরু করে বাংলাদেশে আর্থিক প্রতারণার যত ঘটনা জনসমক্ষে এসেছে, তাতে এসব বিষয়ে আমরা আর অবাক হই না। বরং প্রতিবারই আমরা শিখতে পারছি, কত উদ্ভাবনী প্রক্রিয়ায় সাধারণ মানুষের সীমাহীন লোভ কিংবা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার ঐকান্তিক চাওয়াকে পুঁজি করে হাজারকোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া যায়।

বিগত কয়েক দশকে আর্থিক প্রতারণার বিভিন্ন ঘটনা বিশ্লেষণ করলে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পরিলক্ষিত হয়। আগে যেখানে বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যেখানে অফিস খুলে নগদ অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া ছিল, এখন তা প্রায় পুরোটাই প্রযুক্তিনির্ভর হয় গেছে। বাংলাদেশের সর্বক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহারের যে অভাবনীয় উন্নতি, তার সঙ্গে প্রতারক গোষ্ঠীও পিছিয়ে নেই। সাম্প্রতিক এমটিএফই, ই-ভ্যালি কিংবা এমন অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে, যেখানে প্রতারণার পুরো প্রক্রিয়াই ছিল প্রযুক্তিনির্ভর। ফলে এ ধরনের ঘটনাকে এখন বলতে হবে ‘উদ্ভাবনী প্রতারণা’। এমন অপরাধের দুটি মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে—এগুলোর ধরন সদা পরিবর্তনশীল এবং প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারের কারণে এগুলো নির্মূল করা অসম্ভব, তবে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।

আর্থিক খাতের ডিজিটালাইজেশন যেভাবে বাড়ছে, তাতে এ খাতে অপরাধ কিংবা প্রতারণায় প্রযুক্তির ব্যবহারও যে বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক। সীমিত গবেষণা থেকে দেখা যায়, প্রযুক্তিনির্ভর এমন কর্মকাণ্ডের সাম্প্রতিক কালে অন্তত তিনটি ধরন একেবারে দেশের মাঠপর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এক, এমটিএফইর মতো বিটকয়েন কিংবা বৈদেশিক মুদ্রায় বিনিয়োগের মুঠোফোনভিত্তিক অ্যাপ; দুই, দেশের আনাচকানাচে ডিজিটাল ‘ফরেক্স ট্রেডিং’ বা বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের অ্যাপ ও সেবাকেন্দ্র; এবং তিন, ডিজিটাল বেটিং ও গ্যাম্বলিং মাধ্যমের প্রসার।

এগুলোর মধ্যে ক্রিপ্টোকারেন্সি কিংবা বিটকয়েনে বিনিয়োগ বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসারে অবৈধ। তারপরও বর্তমানে এর প্রবণতা মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে দেশের শহর কিংবা গ্রামে, বিশেষত শিক্ষিত যুবক ও পেশাজীবীদের মধ্যে। যদিও সুনির্দিষ্ট হিসাব নেই, খোঁজ নিলে এমন মুঠোফোন অ্যাপের সংখ্যা হাজারে পৌঁছাতে পারে, যার সবই বিদেশে তৈরি এবং তাদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কোনো ‘প্রযুক্তিনির্ভরতা’ নেই। এর মানে হলো, এসব অ্যাপের মাধ্যমে যাঁরা বিনিয়োগ করেন, তাঁরা লোভের বশবর্তী হয়ে এটুকুও বুঝতেও পারেন না যে একদিন হঠাৎই এসব অ্যাপ অকার্যকর হয়ে পড়তে পারে। অর্থাৎ মুঠোফোনে অ্যাপ আছে, কিন্তু সেটি আর খুলছে না কিংবা নিজের অ্যাকাউন্ট আর অ্যাক্সেস করা যাচ্ছে না। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, অ্যাপটির কার্যক্রম কিংবা প্রযুক্তির ওপর বিনিয়োগকারীর নিজের কিংবা এ দেশের কারোরই কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই হঠাৎ অকার্যকর হলে তাতে দেশের নিয়ন্ত্রক কিংবা নিরাপত্তা সংস্থা বা কারোরই করণীয় কিছুই থাকবে না।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অংশীদার করে নিয়ন্ত্রক এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর নিজেদেরও আধুনিক ডেটানির্ভর প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধ দমনে সমন্বিত ও কার্যকর একটি মাধ্যম তৈরি করা; এবং তিন, এসব কাজে আর্থিক প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী খাতের বিশেষজ্ঞদের কাছে থেকে নিত্যনতুন বিষয়ে নিয়মিতভাবেই সহযোগিতা নেওয়া। বাংলাদেশের চলমান প্রেক্ষাপটে তিনটির কোনোটির ক্ষেত্রেই আমরা এগিয়েছি কি না, তা বিবেচনার প্রশ্ন রাখে।

দ্বিতীয় ধরনটি অবশ্য আরেকটু স্মার্ট। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অনেক আগে থেকেই ফরেক্স ট্রেডিং নিষিদ্ধ বা অবৈধ, দেশের বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে বড় বড় নগরীতে আনুষ্ঠানিকভাবেই অফিস নিয়ে এ ধরনের ট্রেডিং কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে শত প্রতিষ্ঠান। খোদ ঢাকা শহরের ধানমন্ডি কিংবা গুলশান এলাকায় খোঁজ নিলে এমন প্রতিষ্ঠানের ছড়াছড়ি দেখা যাবে। এসব অফিস বিদেশি ফরেক্স ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশে আউটসোর্সিং অফিস হিসেবে পরিচিতি, যার মাধ্যমে বিদেশে ঘটমান লেনদেনের বিপরীতে কাস্টমার ও অ্যাকাউন্ট মেইনট্যানেন্স সার্ভিস দেওয়া হয়। অর্থাৎ তাদের প্রকৃত ব্যবসায়িক লাইসেন্স বিদেশ (যেমন যুক্তরাষ্ট্র)–ভিত্তিক, যেখানে ফরেক্স ট্রেডিং বৈধ।

বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, এসব প্রতিষ্ঠান দুই ধরনের আইন লঙ্ঘন করছে—প্রথমত, দেশের আইনে নিষিদ্ধ বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনে তারা সহায়তা করছে কোনোরকমের অনুমোদন ছাড়াই। দ্বিতীয়ত, লোভে পড়ে অনেক দেশীয় মানুষও এমন ফরেক্স ট্রেডিংয়ে যুক্ত হচ্ছে, যার মাধ্যমে মানি লন্ডারিং বাড়ছে। প্রশাসন কিংবা নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর নাকের ডগায় সুসজ্জিত অফিস নিয়ে কীভাবে তারা অনুমোদন ছাড়া ব্যবসা করছে, তা যেমন বোধগম্য নয়, সেই সঙ্গে ‘আউটসোর্সিং’ খাতে সরকারের সুনজরের সুযোগ ব্যবহার করে তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে নিচ্ছে কি না, তা পরিক্ষণীয়।

তৃতীয় ধরনটি সাম্প্রতিক সময়ে বেশ আলোচিত হয়েছে, যেখানে দেখা গেছে, একটি সুপরিচিত টেলিভিশন চ্যানেলে ক্রিকেট খেলা সম্প্রচারের সময় বেটিংয়ের বিজ্ঞাপন বেশ ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে। বেটিংয়ে দেশে আগাগোড়াই নিষিদ্ধ, কিন্তু এখন তা মোটামুটি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন মুঠোফোন এবং ওয়েবভিত্তিক ডিজিটাল মাধ্যমে। এগুলোর ঝুঁকি ঠিক বিটকয়েনে বিনিয়োগের প্ল্যাটফর্মের মতোই—পুরোটাই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, যার কোনো শারীরিক অবস্থান কিংবা প্রযুক্তিনির্ভরতা এই দেশের অভ্যন্তরে নেই।

সার্বিকভাবে, এই তিন ধরনের ক্ষেত্রেই তিনটি প্রযুক্তিনির্ভরতার দিক পরিলক্ষিত হয়, যা আর্থিক অপরাধ কিংবা প্রতারণার ধরন, সংখ্যা এবং মাত্রা আগের চেয়ে বহুগুণে ত্বরান্বিত করছে।

এক, নগদ অর্থের পরিবর্তে ডিজিটাল মাধ্যমে সব অর্থের লেনদেন হচ্ছে, যার অনেক মাধ্যমই দেশের সুপ্রতিষ্ঠিত পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডারদের মাধ্যমে এবং বাকিটা এমন সব আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে হচ্ছে, যেগুলোর দেশে কোনো অনুমোদন নেই।

দুই, এসব মাধ্যমে যারা লাভের আশায় অংশ নেয়, তাদের সঙ্গে সেই সব প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগও মূলত ডিজিটাল মাধ্যমে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই নামেমাত্র অস্থায়ী এজেন্ট ব্যবহার (মূলত ব্যক্তিভিত্তিক) করে, যারা যেকোনো সময় স্থান বদল করে এবং বিনিয়োগকারী বা কাস্টমারদের মুঠোফোন অ্যাপ কিংবা ওয়েবসাইটের মাধ্যমেই সব যোগাযোগ করতে বলা হয়।

তিন, যেসব বিনিয়োগের লোভ দেখানো হচ্ছে, সেগুলোও প্রযুক্তিনির্ভর। ডেসটিনি যেমন নগদ অর্থ গ্রহণ করে তা নানা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের লোভ দেখিয়েছিল, সে জায়গায় এমটিএফই কিন্তু ক্রিপ্টোকারেন্সি কিংবা বৈদেশিক মুদ্রার ডিজিটাল মার্কেটপ্লেসে বিনিয়োগের লোভ দেখিয়েছে।

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে গত এক দশকে বাংলাদেশের প্রযুক্তিনির্ভর উদ্ভাবনে যে অগ্রগতি, তা ঈর্ষণীয় এবং সারা পৃথিবীতেই সমাদৃত হয়েছে। অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির ঋণাত্মক ব্যবহার বাড়বে, এতে আশ্চর্য হওয়ারও কিছু নেই। প্রযুক্তিনির্ভর উদ্ভাবনী প্রতারণা কিংবা আর্থিক অপরাধ উন্নত দেশেও আছে এবং মাঝেমধ্যেই এমন সংবাদ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে। তবে পার্থক্য হলো, উন্নত দেশেগুলোর প্রযুক্তিনির্ভর ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম বা আর্থিক অপরাধ নিবৃত্ত করার শক্তিশালী ব্যবস্থা ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠা হয়েছে, যার ফলে অনেক ঘটনা ঘটার আগেই ঠেকানো যায় এবং ঘটার পর দ্রুত দোষীদের চিহ্নিত করা যায়।

এমন শক্তিশালী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কয়েকটি প্রধান নিয়ামক পরিলক্ষিত হয়। এক, দেশের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর মধ্যে প্রযুক্তিনির্ভর আর্থিক অপরাধ সম্পর্কে বাস্তবিক জ্ঞান ও ধারণা থাকা এবং তা নিয়মিতভাবেই হালনাগাদ করা; দুই, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অংশীদার করে নিয়ন্ত্রক এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর নিজেদেরও আধুনিক ডেটানির্ভর প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধ দমনে সমন্বিত ও কার্যকর একটি মাধ্যম তৈরি করা; এবং তিন, এসব কাজে আর্থিক প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী খাতের বিশেষজ্ঞদের কাছে থেকে নিত্যনতুন বিষয়ে নিয়মিতভাবেই সহযোগিতা নেওয়া। বাংলাদেশের চলমান প্রেক্ষাপটে তিনটির কোনোটির ক্ষেত্রেই আমরা এগিয়েছি কি না, তা বিবেচনার প্রশ্ন রাখে।

  • ড. সুবর্ণ বড়ুয়া অধ্যাপক, ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: [email protected]