বাংলাদেশ ‘বিচ্ছিন্ন’ হওয়ার শঙ্কা কেন

সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচন করার জন্যই বাংলাদেশে একটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়ে থাকে। আগে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য কোনো আইন ছিল না। এবার আমরা আইন করে একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করেছি। অতএব, এই নির্বাচন কমিশনকে ‘বেআইনি’ বলা যাবে না।

নির্বাচন কমিশনের কাজ হলো নির্বাচন করা। সেটি হোক রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন কিংবা স্থানীয় সরকার নির্বাচন। তবে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন করার ক্ষেত্রে আবার সরকারের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে কখনোই বড় সমস্যায় পড়তে হয়নি তাদের। বেশির ভাগ সময়ই একক প্রার্থী ছিলেন।

সংসদীয় ব্যবস্থা চালুর পর একবারই রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল ১৯৯১ সালে। সেবার বিএনপির মনোনীত প্রার্থী আবদুর রহমান বিশ্বাসের বিপরীতে বিরোধী দলের প্রার্থী ছিলেন বদরুল হায়দার চৌধুরী। আবদুর রহমান বিশ্বাস ১৭২–৯২ ভোটে জয়ী হয়েছিলেন।

সবচেয়ে বেশি বিপত্তি ও বিতর্ক জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে। খুব কম নির্বাচন কমিশনই নির্বাচন করার পর ফুলের মালা পেয়েছে। বরং তাদের কপালে নিন্দামন্দই বেশি জুটেছে।

এই প্রেক্ষাপটে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের পদাধিকারী ব্যক্তিরা যে ভীষণ পেরেশানিতে আছেন, সেটি তাঁদের বক্তৃতা–বিবৃতিতে বোঝা যায়। একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করার তথা ভোটারদের ভোটাধিকার রক্ষার জন্যই নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনী আচরণবিধি, রিটার্নিং কর্মকর্তা, পোলিং এজেন্ট ইত্যাদি।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও তাঁর সহকর্মীরা একটি ‘সুষ্ঠু’ নির্বাচনের জন্য প্রতিদিনই বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রাথমিক যে পূর্বশর্ত, সেটাই এবার অনুপস্থিত। নির্বাচনটি হচ্ছে প্রতিযোগিতাহীন। বাতি জ্বালিয়ে বিরোধী দলের প্রার্থী খুঁজতে হচ্ছে।

নির্বাচন কমিশনের মূল কাজ ভোটারদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা। কত শতাংশ ভোট পড়ল, কত ভাগ জালভোট শনাক্ত করা হলো, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, দেশের প্রায় ১২ কোটি ভোটারকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্যে আনা গেল কি না?

দেশের দুই প্রধান দলের মধ্যে বিএনপি একটি। নির্বাচনে তাদের অনুপস্থিতি মানে ভোটারদের একটি অংশ এই নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে থাকা।

সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন করতে যে নির্বাচন কমিশনের চেষ্টা ছিল না, সে কথা আমরা বলছি না। অবশ্যই চেষ্টা ছিল। কিন্তু আমাদের রাজনীতি এতটাই বিভাজিত যে তারা একে অপরের ছায়া মাড়াতেও রাজি নয়।

এ অবস্থায় সব দলকে নিয়ে নির্বাচন করা কঠিনই বটে। ফলে নির্বাচন কমিশন ‘সত্য যে কঠিন কঠিনেরে ভালোবাসিলাম’–এর পথে না গিয়ে সহজ পথই বেছে নিয়েছে। রকিব ও হুদা কমিশনও তাই করেছিল।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও তাঁর সহযোগীদের কণ্ঠে যে আমরা উৎকণ্ঠার কথা শুনি, তারও পেছনের কারণ হলো সব দলকে নির্বাচনে নিয়ে আসতে না পারা। তাদের কাছে এখন যে চাওয়া, তা হলো রাজনৈতিক দলের একাংশকে বাদ দিয়ে যে নির্বাচন হচ্ছে, সেটাকে যতটা সম্ভব সুষ্ঠু ও পরিচ্ছন্ন দেখানো। তবে তাঁরা এ কথাও বলেছেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি না, সেটা নির্ভর করবে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের আচরণের ওপর।’

আরও পড়ুন

আমাদের রাজনীতি যে কত অসহিষ্ণু ও অসংযত, তা আওয়ামী লীগের নৌকাধারী ও স্বতন্ত্র (কেউ কেউ একে ডামি বা বিকল্প প্রার্থী বলেন) প্রার্থীদের পরস্পরের প্রতি ভাষা ব্যবহার থেকেই স্পষ্ট। এখানে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ, দলের নীতি–আদর্শ কর্মসূচি কোনো বিষয় নয়। বিষয় হলো নিজের জয় নিশ্চিত করা।

বর্তমান সংসদের একজন হুইপ এবার দলের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নৌকার প্রার্থীর সমর্থকেরা তাঁর পরিবারের সদস্যদের হামলা করে আহত করেছেন। তাঁদের দাবি, পাঁচ বছর হুইপ সাহেব এলাকার জনগণের ওপর যে অত্যাচার–নির্যাতন করেছেন, তার ‘ফল’ পেয়েছেন।

কেবল ওই আসন নয়, অনেক আসনেই নৌকার প্রার্থীর সমর্থকেরা স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলে পড়ার কারণ, তাঁদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ নষ্ট হয়েছে।

নির্বাচন নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও তাঁর সহযোগীরা অনেক কথাই বলেছেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমানের কথাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। একই সঙ্গে উদ্বেগজনকও।

আরও পড়ুন

গত বছরের শেষদিন ৩১ ডিসেম্বর রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে।

তাঁর ভাষ্য, ‘সমগ্র বিশ্ব আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমরা যদি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে না পারি, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। বাংলাদেশের আর্থিক, সামাজিক, ব্যবসায়িকসহ সবকিছু থমকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। মাত্র ছয় দিন বাকি। সপ্তম দিন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আমরা শুধু আমাদের দৃষ্টিতে এই নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন বললেই হবে না।’

ইসি আনিছুর রহমানের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই, তিনি বহির্বিশ্ব থেকে বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন। বাংলাদেশ আর্থিক, সামাজিক ও ব্যবসায়িকভাবে থমকে যাওয়ারও অশনিসংকেত দিয়েছেন। এত দিন ভোট বর্জনকারীরাই এসব কথা বলতেন।

আরও পড়ুন

সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের বড় নেতারা যখন নির্বাচনের পর সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে এবং বন্ধুদেশগুলোর সঙ্গে কোনো সমস্যা হবে না বলে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করছেন, তখন ইসি আনিছুর রহমানের কথায় এই শঙ্কা কেন?

এ বিষয়ে তাঁর কাছে কি নির্দিষ্ট কোনো তথ্য আছে? তবে সুষ্ঠু নির্বাচন বলতে কমিশনের পদাধিকারী ব্যক্তিরা যা বোঝান, বহির্বিশ্ব নিশ্চয়ই সেভাবে বুঝবে না। তাদের কাছে সুষ্ঠু নির্বাচন হলো অনেকের মধ্যে একজনকে বাছাই করার সুযোগ। যেখানে ভোটের আগেই ফল জানা যায়, সেটিকে আর যা–ই হোক, আন্তর্জাতিক মাপকাঠিতে সুষ্ঠু নির্বাচন বলা যাবে না।

● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]