শৈশবে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘রামের সুমতি’ পড়ে কেঁদেছি আমরা অনেকেই। পারিবারিক জটিলতায় রামকে পৃথক করে দেওয়া হলে সে একা একা সেই প্রথম ভাত রেঁধেছিল। এক হাঁড়ি চালের সঙ্গে সমান সমান জল দিয়ে উনুনে বসিয়েছিল। সেটির কী দফা হতে পারে, তা আর না-ই বলি। মাতৃসম বউদি কেঁদেকেটে একশা। তবু তো রাম ছোট ছিল।
তারও ১০০ বছর পর আমাদের ঘরের ২৪ থেকে ২৫ বছর বয়সী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নেওয়া ছেলে বিদেশে পড়তে গিয়ে ফোনে মায়ের কাছে জানতে চান, ‘মা, ভাত রাঁধতে কতটুকু তেল লাগে?’ তখন হাসব না কাঁদব, বুঝে উঠতে পারি না।
‘আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ’ চলবে এ মাসের ১০ তারিখ পর্যন্ত। প্রতিপাদ্য ‘নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা বন্ধ করুন ও সহিংসতা প্রতিরোধে বিনিয়োগ করুন’। নারীর প্রতি সহিংসতার তো কোনো শেষ নেই। উত্তরাধিকার বঞ্চনা, ধর্ষণ, বাল্যবিবাহ, অপরিণত মাতৃত্ব, যৌতুক, হত্যা, তালাক, হয়রানি, উত্ত্যক্তকরণ, বডি শেমিং, মেয়েসন্তান জন্ম, লিঙ্গ বিভাজন, বন্ধ্যত্ব, প্রবঞ্চনা-নির্যাতনের কথা বলতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে।
এসব নিয়ে প্রতিনিয়ত প্রতিবেদন আমাদের চোখে পড়ে। এ ছাড়া সরাসরি প্রতিবাদ করতে না পেরে মানবতাবাদী কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরা ফিকশনের আশ্রয় নেন। এ লেখার শুরুতেই যা নিয়ে কথা বলছিলাম, তা হলো আরেক নির্যাতনের পরিহাস। একে নির্যাতন বলে কেউ মনেই করেন না। তা হলো, ‘মেয়েকে এত লেখাপড়া শিখিয়ে কী হবে? সেই তো পরের বাড়ি হাঁড়ি ঠেলা!’
আজ বরং ঘরের কাজে নারী নির্যাতন নিয়ে কথা বলা যায়। অন্যান্য নির্যাতনের তুলনায় এ নির্যাতন দৃশ্যত অতটা সহিংসতার আওতায় পড়ে না; কিন্তু স্লো পয়জনের মতো নারীর জীবন ক্রমে অচল করে তোলে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই নারীর জীবন দেখেশুনে বলেছেন-
‘একটানা এক ক্লান্ত সুরে
কাজের চাকা চলছে ঘুরে ঘুরে...
রাঁধার পরে খাওয়া আবার খাওয়ার পরে রাঁধা,
বাইশ বছর এক-চাকাতেই বাঁধা’।
এ দেশের কয়টা বাড়িতে পুরুষ ঘরের কাজ করেন? বুঝলাম বেশির ভাগ পুরুষ বাইরে কাজ করে সংসারের ভরণপোষণ চালান। তাঁরা উপার্জনও করবেন আবার সংসারে গতর খাটাবেন—মগের মুল্লুক নাকি?
কিন্তু পোশাক কারখানার লাখ লাখ নারী শ্রমিকের বাসায় উঁকি দিয়েছেন কখনো? তাঁদের অনেকের স্বামীও বাইরে কাজ করেন। কিন্তু সাতসকালে উঠে নারীকেই রান্না করে, ধোয়াকাচা সেরে, সন্তান থাকলে তাদের প্রাতঃক্রিয়া, খাওয়া, গোছানো শেষ করে নিজে তৈরি হন, একই সঙ্গে স্বামীকে ডেকে তুলে নাশতার থালা এগিয়ে দেন, তারপর দুজনের লাঞ্চ টিফিন বক্সে ভরে হয় সন্তানকে ডে-কেয়ারে রাখেন, না হয় বস্তির বৃদ্ধ খালার জিম্মায় রেখে জোরকদমে কারখানায় পৌঁছান।
অন্যদিকে বাইরে কাজ করা উচ্চপদস্থ স্বামী-স্ত্রী দুজনেই অফিস শেষে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফেরেন। কিন্তু বাইরের কাপড় না ছেড়েই নারীকে ছুটতে হয় রান্নাঘরে, সোফায় গা এলিয়ে দেওয়া ‘অত্যধিক পরিশ্রান্ত’ স্বামীর জন্য চা-নাশতার ব্যবস্থা করতে।
বস্তি বলুন আর প্রাসাদ বলুন, কোথাও নারীর স্বস্তি নেই। উচ্চশিক্ষিত হয়ে নারীরা ঘরে বসে থাকবেন কেন? আবার পরিবারের প্রয়োজন ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধেও নারীরা উজ্জীবিত। নারীর ঘরের বাইরে কাজের সদিচ্ছা, সুযোগ ও ক্ষেত্র ক্রমে বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের সার্বিক জন্মহারও নিম্নগামী। এখনো আমাদের দেশে কিছু ক্ষেত্রে নতুন মা হওয়া নারীর পাশে তাঁর মা বা শাশুড়ি স্থানীয় নারীরা থাকেন বলে তাঁকে চাকরি ছাড়তে হয় না।
কিন্তু যেসব কর্তৃত্ববাদী পরিবার বিবাহিত নারীর চাকরি করাটাকে নিছক শখ বা শাড়ি-গয়না কেনার বাহানা মনে করে, তারা বলে, ‘যা বেতন পাও তা আমি দেব, কিন্তু বাচ্চা ফেলে রেখে স্বেচ্ছাচারিতা নৈবচ নৈবচ।’
নারীর কাজ সন্তান জন্ম দেওয়া, তার লালন-পালন, স্বামীসহ বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের সেবা ও সংসারের যাবতীয় কাজ করা।
এই সামাজিক ট্যাবু মানছেন না বলে শিক্ষিত নারীরা তালাকের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্যারিয়ারকে অগ্রাধিকার দিয়ে সন্তান না নেওয়ারও দৃষ্টান্ত রাখতে দেখা যাচ্ছে।
আমাদের দেশ তো দূর কি বাত, খোদ ইউরোপ-আমেরিকাতেও তালাকের অন্যতম কারণ হিসেবে ‘ল্যাক অব ফ্যামিলি সাপোর্ট’কে ধরা হতো। এর মধ্যে ঘরের কাজ, সমানুপাতিক ব্যয়, সন্তানের দেখভাল ইত্যাদিতে সাধারণত পুরুষ সঙ্গীদের সহযোগিতা বিরল।
তবে সেসব দেশে মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতাকে সর্বাগ্রে রেখেও পরিবারব্যবস্থা সুসংবদ্ধ করার উদ্যোগ লক্ষণীয়। সে ক্ষেত্রে প্রাথমিক স্কুলগুলোর ভূমিকা অনস্বীকার্য। সেখানে হাতে-কলমে ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ অনেক আগে থেকেই প্রচলিত। এতে করে লিঙ্গবৈষম্য ও লিঙ্গভেদে শ্রম বিভাজনের অপকারিতা দূর হচ্ছে, পারিবারিক মূল্যবোধ জাগ্রত হচ্ছে। আগের তুলনায় সংসারে সহযোগী পুরুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আমাদের দেশের মায়েরাই সন্তানদের লেখাপড়া নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। বাবারা সন্তানদের জন্য শিক্ষিত মা দিয়েই খালাস। এসব শিক্ষিত মা বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে এবারের পাঠ্যক্রমে কেন ভাত, আলুভর্তা, ডিম ভাজা রান্না শেখানো হচ্ছে, কেন ছেলেশিশুদের দিয়ে ঘরের কাজ করানো হচ্ছে, এ নিয়ে মাঠ গরম করছেন।
আমাদের দেশের মায়েরাই সন্তানদের লেখাপড়া নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। বাবারা সন্তানদের জন্য শিক্ষিত মা দিয়েই খালাস। এসব শিক্ষিত মা বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে এবারের পাঠ্যক্রমে কেন ভাত, আলুভর্তা, ডিম ভাজা রান্না শেখানো হচ্ছে, কেন সন্তানদের দিয়ে ঘরের কাজ করানো হচ্ছে, এ নিয়ে মাঠ গরম করছেন।
ইউটিউবে ছেয়ে গেছে ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যক্রম নিয়ে বিক্ষুব্ধ মায়ের প্রতিবাদ। একজন মা বলছেন, বয়ঃসন্ধির বিষয়টা কেন পাঠ্যক্রমে আনতে হবে? এগুলো পারিবারিকভাবে জানানোই ভালো।
পড়ে দেখলাম, এমন কোনো উন্মুক্ত আলোচনা করা হয়নি, যা জেনে সন্তানেরা লজ্জায় স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেবে। তিনি হয়তো জানেন না, পশ্চিমের দেশগুলোয় পঞ্চম শ্রেণির শেষ ভাগে পুস্তকে এবং শিক্ষকদের আলোচনায় মা-বাবার শারীরিক সম্পর্কে সন্তান জন্মের বিষয়টিও বিস্তারিতভাবে জানানো হয়। সেখানে অভিভাবকদেরও অনলাইনে আমন্ত্রণ জানানো হয়।
জ্বালাময়ী বক্তৃতা প্রদানকারী বলছেন, পরিবারে বড় হতে হতে এগুলো আপনাআপনিই ছেলেমেয়েরা শিখে যায়। দেখা যায়, অনেক অভিভাবকেরই এসব বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান নেই বা কুসংস্কার রয়েছে। সন্তানেরাও মা-বাবা বা বড়দের কাছ থেকে এসব জানতে অস্বস্তি বোধ করে।
মনে আছে, আমরা সত্তরের দশকের প্রথম দিকে যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তাম, তখন ক্লাসে ইংরেজি বইয়ে ‘মি. আলি ইজ মিসেস আলিস হাজবেন্ড’ এবং ‘মিসেস আলি ইজ মি. আলিস ওয়াইফ’ এসব লাইনের বাংলা অনুবাদও করা লাগত।
আমরা মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতাম, যেন ওই অনুবাদে ‘স্বামী’ ‘স্ত্রী’ শব্দগুলো বলার পালা না আসে। যার ভাগ্যে ‘দিস ইজ আ ক্যাট’—‘ইহা হয় একটি বিড়াল’ থাকত, তাকে পৃথিবীর সেরা ভাগ্যবান মনে হতো।
তখন ‘স্বামী’, ‘স্ত্রী’ শব্দ উচ্চারণ করাটাই আমাদের কাছে অনেক লজ্জার ছিল। আর রজঃ চক্র সম্পর্কে ভুল ধারণা, স্বাস্থ্যবিধি পালন না করা, নিয়ম না জানার জন্য কী হেনস্তা হতে হয়েছে, তা এখন ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়।
জীবন ও জীবিকা পাঠ্যক্রমে ঘরের কাজে ছেলেমেয়েদের যে সমতা দেখানো হয়েছে, তা আমাদের পরিবার তথা সমাজের জন্য একটি বিপ্লব বৈকি! সমাজে আবহমান কালের চেপে বসা পুরুষতান্ত্রিক মনোভঙ্গি পাল্টানোর এক কার্যকর পদক্ষেপ।
ধন্যবাদ তাঁদের, যাঁরা এটি প্রণয়নে সাহসী ভূমিকা রেখেছেন। অন্তত এবারের ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ’কে নারীর গৃহকর্মে অমানবিক নির্যাতন প্রতিরোধের একটি যুগান্তকারী উপহার এটি।
একই সঙ্গে এ কথাও বলার মওকা ছাড়তে মন চাচ্ছে না, তা হলো, একসময় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল ছেলেরাই ভর্তি হতেন। এখন মেয়েরাও সমানে ভর্তি হচ্ছেন। তাহলে গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন ছেলেরা ভর্তি হবেন না?
উম্মে মুসলিমা সাহিত্যকর্মী
[email protected]