তারা আর সৌদি আরবের বিরুদ্ধে সংঘাতে জড়াবে না। চুক্তির বিষয়ে দুই দেশের যৌথ বিবৃতি প্রকাশের দিনই যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র জন কারবি বলেছেন, ‘ওই অঞ্চলে যেকোনো ধরনের উত্তেজনা প্রশমন চেষ্টা আমাদের স্বার্থকেই রক্ষা করবে’। একই সঙ্গে এ চুক্তি স্বাক্ষরকে যুক্তরাষ্ট্র স্বাগত জানায় বলে তিনি মন্তব্য করেন। তবে যুক্তরাষ্ট্র মুখে যতই এই চুক্তিকে স্বাগত জানাক, ওয়াশিংটন ভালো করেই জানে, টেলিযোগাযোগ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বৈশ্বিক নেতৃত্ব থেকে চীনকে পিছিয়ে রাখার বিষয়ে আমেরিকার যে চেষ্টা আছে, পারস্য উপসাগরে চীনের এ আধিপত্য সেই চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেবে।
আঞ্চলিক অর্থনীতিকে প্রযুক্তিগতভাবে রূপান্তর করতে চীনের সক্ষমতা তার কূটনৈতিক উদ্যোগগুলোর পেছনে বড় ভূমিকা রাখবে। মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার বিষয়ে চীনের তাৎক্ষণিক আগ্রহের পেছনে মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর বেইজিংয়ের নির্ভরশীলতা একটি বড় কারণ হিসেবে কাজ করছে। সর্বোপরি, বেইজিং চায় না মধ্যপ্রাচ্যে কোনো আঞ্চলিক সংঘাত লাগুক, কারণ সেটি হলে তার জ্বালানি সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। চীন এ অঞ্চলে তার নেতৃত্বাধীন ইউরেশিয়ান অবকাঠামোর শিল্পভিত্তিক সম্ভাবনাকে বিস্তৃত করতে চায়।
পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা হতবাক হলেও বাস্তব সত্য হলো, কয়েক মাস ধরে চীনা কূটনীতি সৌদি-ইরানের যে যৌথ বিবৃতির খসড়া তৈরি করেছে, তাতে চীনের মধ্যস্থতার পদক্ষেপকে ‘মহামান্য প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের মহান পদক্ষেপ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। গত বছর উপসাগরীয় দেশগুলো এবং ইসরায়েল—উভয় শিবিরের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করা দেশ তুরস্ককে চীনের এ উপসাগরীয় পরিকল্পনার কেন্দ্রস্থলে রাখা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য উপাত্ত সূচকে এ অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের প্রমাণ পাওয়া যায়। সেই সূচক বলছে, গত তিন বছরে এ অঞ্চলে চীনের রপ্তানি দ্বিগুণ হয়েছে।
প্রায় সিকি শতাব্দী ধরে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে চলা সংঘাত নিরসনে এই প্রথমবারের মতো চীন হস্তক্ষেপ করল। কোন ক্ষমতাবলে চীন ইরানকে সৌদির সঙ্গে চুক্তি করতে রাজি করিয়েছে, তা পরিষ্কার নয়। তবে এটি অনুমেয় যে চীনের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া ইরানের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
ইসরায়েলের কিছু বিশ্লেষক ইরান-সৌদি চুক্তির বিষয়ে সতর্কতার সঙ্গে আশাবাদ প্রকাশ করেছেন। জেরুজালেম পোস্ট পত্রিকায় ১১ মার্চ সেথ ফ্রানৎসমান লিখেছেন, ‘তুরস্ক সৌদি আরবের পদাঙ্ক অনুসরণ করছে। ইসরায়েল ও উপসাগরীয় যে দেশগুলোর সঙ্গে কিছুদিন আগেও আঙ্কারার বৈরী সম্পর্ক ছিল, তাদের সঙ্গেও আঙ্কারা সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করছে। মানে মোটাদাগে বলা যায়, মধ্যপ্রাচ্য এখন সংঘাতের নয়, কূটনীতির ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।’
মিডলইস্ট মিডিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট (মেমরি) ইরান-সৌদি চুক্তির যে সারসংক্ষেপ প্রকাশ করেছে, তাতে বলা আছে, ইরানের পরমাণু কার্যক্রম ও আঞ্চলিক অস্থিরতা ঘটানো এবং সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীকে সমর্থন দেওয়ার বিষয়টি আমলে নিতে হবে; দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের বিস্তার রোধকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে; একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক নৌসীমা ও তেল স্থাপনার নিরাপত্তা নিশ্চিতে ইরানকে অঙ্গীকার করতে হবে।
প্রায় সিকি শতাব্দী ধরে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে চলা সংঘাত নিরসনে এই প্রথমবারের মতো চীন হস্তক্ষেপ করল। কোন ক্ষমতাবলে চীন ইরানকে সৌদির সঙ্গে চুক্তি করতে রাজি করিয়েছে, তা পরিষ্কার নয়। তবে এটি অনুমেয় যে চীনের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া ইরানের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
কারণ, ইরান সাংঘাতিকভাবে চীনের তৈরি পণ্য, সমরাস্ত্র, বিশেষ করে ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। পশ্চিমারা ইরানের ওপর অবরোধ আরোপ করার পর ইরানের পণ্য আমদানিতে চীন একচেটিয়া ভূমিকা নেওয়ায় তেহরানের পক্ষে চীনকে না করা কঠিন ছিল।
সব মিলিয়ে সৌদি আরব ও ইরানকে এক টেবিলে বসানো এবং এর সঙ্গে তুরস্ককেও যুক্ত করার গোটা প্রক্রিয়ায় চীনের রাখা এ ভূমিকাকে বেইজিংয়ের বিশাল কূটনৈতিক অর্জন বলা যেতে পারে।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
স্পেংলারএশিয়া টাইমস–এর কলাম লেখক