বিশ্বব্যাংক কি পথ হারিয়েছে

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের ওয়াশিংটন ডিসির সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত হলো বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশের সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে সে অনুষ্ঠানে যোগ দেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পদ্মা সেতুর চিত্র উপহার গ্রহণকালে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাসের বিমর্ষ ও বিব্রত ছবি এবং বিশ্বব্যাংক কার্যালয়ের সামনে সরকার–সমর্থক ও বিরোধীদের সংঘর্ষ ছাড়া বাকি অনুষ্ঠান ফলপ্রসূ হয়েছে বলে ধারণা করি।

‘বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংক গ্রুপ: পঞ্চাশ বছর একসাথে’ শিরোনামে এ উপলক্ষে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘যখন ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে, এটি ছিল বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি—গত ৫০ বছরে দেশটির অর্থনীতিতে যে রূপান্তর ঘটেছে, তা উন্নয়নের একটি বিস্ময়কর গল্প।’ প্রথমেই একটা ভুল সংশোধন করা প্রয়োজন। তা হলো, স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে ২৬ মার্চ ১৯৭১—এ দিনটিই বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস।

মূল আলোচনা শুরুর আগে একটা গল্প বলি। কথিত আছে, অর্থনীতিবিদ পল স্যামুয়েলসনের পিএইচডি গবেষণার মূল্যায়ন কমিটির দুই সদস্য ছিলেন জেন টিনবার্গেন ও র‍্যাগনার ফ্রিশ। সাক্ষাৎকারকালে তাঁরা ছাত্র স্যামুয়েলসনকে তাঁর গবেষণা বিষয়ে নানান প্রশ্ন করেন ও জবাব শোনেন। সাক্ষাৎকার শেষে স্যামুয়েলসন রুম থেকে বের হয়ে গেলে সিদ্ধান্তের পালা। টিনবার্গেন ও ফ্রিশ পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে বলেন, ‘ডিড উই পাস?’ অর্থাৎ ছাত্র তো দারুণ উতরে গেছে, কিন্তু আমরা কি পাস করেছি! উন্নয়ন অভিযাত্রায় গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ গোল্ডেন জিপিএ পেয়েছে। কিন্তু বিশ্বব্যাংক পাস করেছে কি? পাস করে থাকলে কী গ্রেড পেল? নিচে বিষয়টির ওপর খানিকটা আলোকপাত করব।

আগেই বলে রাখি, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আমার কাজ করার অভিজ্ঞতা প্রায় ৩৩ বছরের, সেই ১৯৮৯ সাল থেকে। প্রথমে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে ২০১০ সাল এবং পরে তাদের আন্তর্জাতিক পরামর্শক হিসেবে ২০২২ সাল পর্যন্ত।

বিশ্বব্যাংক-বাংলাদেশ সহযোগিতায় সাফল্যের দৃষ্টান্ত

প্রথমেই খানিকটা স্মৃতিচারণা দিয়ে শুরু করি। তখন নব্বইয়ের দশকের শুরুতে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অর্থনীতি সংস্কার ও উদারীকরণের ঢেউ চলছে। আমি ও আরেক সহকর্মী তখন সবে বিদেশে উচ্চশিক্ষা শেষ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে কাজে যোগ দিয়েছি। আমাদের অর্থনীতি তখন অন্তর্মুখী ও নাজুক। বিশ্বব্যাংক চাইছিল বাংলাদেশও অর্থনীতি সংস্কার ও উদারীকরণের ধারায় শরিক হোক। আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছিলেন সংস্কার ও উদারীকরণের বিপক্ষে—তাঁরা চান, যেভাবে চলছে সেভাবেই চলুক। আমরা চাইছিলাম সংস্কার ও উদারীকরণ হোক। তবে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শমতো রাতারাতি নয়, দেশের জন্য সহনীয় গতিতে।

আমরা চাই, কেবল লেনদেনসর্বস্ব ব্যাংক না হয়ে বিশ্বব্যাংক প্রকৃত উন্নয়ন সহযোগী হয়ে উঠুক। অর্থনৈতিক সংস্কার বিষয়ে দৃঢ় ও দারিদ্র্যবিমোচন বিষয়ে আন্তরিক হোক। বৈদেশিক ঋণের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা কমলেই তা হবে বাংলাদেশ-বিশ্বব্যাংক সহায়তার সাফল্যের প্রতীক। সব শেষে ৫০তম বর্ষপূর্তিতে বাংলাদেশ-বিশ্বব্যাংক সহায়তা আগামী দিনগুলোতে ফলপ্রসূ হোক, এই কামনা করি।

তখন বিশ্বব্যাংক মিশন মানেই ছিল আমাদের সঙ্গে নিত্যদিন বাহাস। তবে দুই তরফেই লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়া। আমরা আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সংস্কার ও উদারীকরণের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতাম।

আমাদের কান্ডারি ছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান। তিনি আমাদের মতামত শুনতেন ও উৎসাহ দিতেন। বিশ্বব্যাংকের মিশনকে আমরা বোঝাতাম, তোমাদের পরামর্শ অক্ষরে অক্ষরে মেনে নিলে, কোনো সংস্কার ও উদারীকরণ করা সম্ভব হবে না। তবে কিছু শর্ত শিথিল করলে তা বাস্তবায়নযোগ্য হবে। তারা তাদের সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বোঝায়। এভাবে আমরা ‘শিল্প খাত সমন্বয় ঋণ-২’-এর আওতায় বাণিজ্য উদারীকরণ ও ‘জনসাধারণের সম্পদ সমন্বয় ঋণ’-এর আওতায় করব্যবস্থার সংস্কার করতে সক্ষম হই। তা ছাড়া এ দুই ঋণ কর্মসূচি ও আইএমএফের ‘বর্ধিত কাঠামোগত সমন্বয় সুবিধা’র আওতায় মূল্য সংযোজন কর প্রবর্তন করা হয়। ফলে স্থবির অর্থনীতিতে গতি আসে, কর রাজস্ব ও জিডিপির অনুপাত বাড়ে।

একই সময়ে যমুনা বহুমুখী সেতুর ইন্টারনাল রেট অব রিটার্ন (আইআরআর) কম বিধায় প্রকল্পটির অর্থায়নে বিশ্বব্যাংক তাদের আগের প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসে। তখন আমরা তিনজন মিলে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা পুনর্মূল্যায়ন করে দেখাই যে বিশ্বব্যাংকের মূল্যায়নে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ পড়েছে, যা অন্তর্ভুক্ত করলে আইআরআর তাদের গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে উন্নীত হবে। বিশ্বব্যাংক তা মেনে নেয়, সেতু অর্থায়নে ফিরে আসে, দেশের প্রথম বড় সেতুটি সংক্ষিপ্ততম সময়ে ও স্বল্পতম ব্যয়ে বাস্তবায়িত হয়।

আরও পড়ুন

আরও কয়েক বছর পর আমরা ইডকলের মাধ্যমে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ‘গ্রামীণ বিদ্যুতায়ন ও নবায়নযোগ্য শক্তি উন্নয়ন প্রকল্প’-এর আওতায় আমরা বিশ্বের সবচেয়ে সফল সোলার হোম সিস্টেম কর্মসূচি বাস্তবায়ন করি। এ কর্মসূচির আওতায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রায় দুই কোটি মানুষের কাছে সৌরবিদ্যুতের সুবিধা পৌঁছে দেওয়া হয়। উপরিউক্ত কর্মসূচিগুলোর সাফল্যের মূল কারণ ছিল সংস্কার বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের দৃঢ়তা ও তা বাস্তবায়নে নমনীয়তা এবং স্থানীয় মতামত ও বিশ্লেষণকে গুরুত্ব দেওয়া।

পথ হারিয়েছে বিশ্বব্যাংক

নতুন শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এসেই বিশ্বব্যাংক পথ হারিয়ে ফেলে, ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। পদ্মা সেতু অর্থায়ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ বিষয়ে তারা অদক্ষতার পরিচয় দেয়। তাদের আনীত দুর্নীতির অভিযোগ সঠিক না ভুল, সেই বিতর্কে না গিয়েও এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা চলে যে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশ সংক্ষিপ্ততম সময়ে ও স্বল্পতম ব্যয়ে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

এ সময়ে অর্থনীতিতে নতুন নতুন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করায় আগের অনেক সংস্কারকে ছেঁটে ফেলা হয়। আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সুদ ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারিত হয়, রিজার্ভ হ্রাস পায়, ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বিকৃতির বিকাশ ঘটে, খেলাপি ঋণ ও বিদেশে মুদ্রা পাচার অতীতের সব রেকর্ড, এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলোকে ছাড়িয়ে যায়। এ ছাড়া দুর্নীতির কারণে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বাড়তে থাকে এবং রাজস্ব আদায়ে ভাটার টান পড়ে।

দারিদ্র্যবিমোচন বিশ্বব্যাংকের কর্মসূচিতে পেছনের আসন নেয়। ফলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সংকটে নিপতিত হয়; আয়, সম্পদের বৈষম্য ও হতদরিদ্রের সংখ্যা বাড়তে থাকে।

বিশ্বব্যাংক এসব বিষয়ে চোখ বুজে থাকে। তারা ব্যস্ত থাকে তাদের ঋণের ব্যয়ন বাড়াতে এবং এ ক্ষেত্রে সাফল্য আসে। ফলে আগে যেখানে বাংলাদেশ তাদের প্রতিশ্রুত অর্থ ব্যবহার করতে পারত না, সেখানে এখন আফ্রিকার অন্যান্য দেশে প্রতিশ্রুত অর্থের অব্যবহৃত অংশও ব্যবহার করে। ফলে ক্রমবর্ধমান হারে বিশ্বব্যাংকের ঋণের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরশীলতা বাড়তে থাকে।

আমরা কি এই বিশ্বব্যাংক চেয়েছিলাম

বিশ্বব্যাংক এবং অনুরূপ দাতা সংস্থার আকর্ষণ হলো সুদের স্বল্প হার, দীর্ঘ মেয়াদ ও গ্রেস পিরিয়ড। এর কারণ রয়েছে। এসব দাতা সংস্থা ঋণ ফেরত পাওয়ার কাতারে সবার আগে দাঁড়িয়ে। অর্থাৎ অন্য কারও ঋণ পরিশোধের আগে তাদের ঋণ পরিশোধ করতে হবে। সার্বভৌম খেলাপি হওয়া ছাড়া অন্য যেকোনো পরিস্থিতিতে তাদের ঋণের অর্থ ফেরত পাবে। তারা কোনো অবস্থাতেই ঋণ মওকুফ করে না। উদাহরণস্বরূপ, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ পাকিস্তান গৃহীত ঋণ পরিশোধে অপারগতা জানায়। কিন্তু এতত্সত্ত্বেও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে তার অংশে বাস্তবায়িত প্রকল্পের ৩৪৫ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলারের ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়।

এ জন্যই একটি মার্কিন বিনিয়োগ ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী (সম্ভবত গোল্ডম্যান স্যাক্স) একসময় বলেছিলেন, ‘যে পরিমাণ, পদ্ধতিতে বিশ্বব্যাংক তার তহবিল সংগ্রহ করে এবং যে শর্তে তারা ঋণ দেয়, সে সমপরিমাণ অর্থ, একই পদ্ধতি ও শর্ত আমাদের বিনিয়োগ ব্যাংককে দেওয়া হলে, আমরা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আরও উত্তম উন্নয়ন ফল প্রদর্শন করতে পারতাম।’

আরও পড়ুন

আমরা যা চাই

আমরা চাই, কেবল লেনদেনসর্বস্ব ব্যাংক না হয়ে বিশ্বব্যাংক প্রকৃত উন্নয়ন সহযোগী হয়ে উঠুক। অর্থনৈতিক সংস্কার বিষয়ে দৃঢ় ও দারিদ্র্যবিমোচন বিষয়ে আন্তরিক হোক। বৈদেশিক ঋণের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা কমলেই তা হবে বাংলাদেশ-বিশ্বব্যাংক সহায়তার সাফল্যের প্রতীক। সব শেষে ৫০তম বর্ষপূর্তিতে বাংলাদেশ-বিশ্বব্যাংক সহায়তা আগামী দিনগুলোতে ফলপ্রসূ হোক, এই কামনা করি।

  • মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ

    [email protected]