অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে একটি সফল গণ-অভ্যুত্থানে। স্বনামধন্য প্রধান উপদেষ্টাসহ সবাইকে অভিনন্দন। গণ–অভ্যুত্থানের সূচনায় একটি ধাপ ছিল দীর্ঘকালীন শাসনব্যবস্থায় থাকা কর্তৃত্ববাদী ও কার্যত অগণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থার পরিবর্তন। সে পর্বটি সম্পন্ন হয়েছে। এ অসম্ভবকে সম্ভব যাঁরা করলেন, সেই তরুণ সম্প্রদায় ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবেন। এর জন্য আত্মাহুতি দিয়েছেন পাঁচ শতাধিক ছাত্র-জনতা। গুরুতর আহত অবস্থায় আছেন কয়েক হাজার।
দ্বিতীয় ধাপ একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন। এটার নামই বলে দিচ্ছে সরকার দীর্ঘমেয়াদি হবে না। এর সামনে রয়েছে লাখো তরুণসহ গোটা গণতন্ত্রকামী জনগণের নতুন বাংলাদেশ করার প্রাথমিক দায়িত্ব। সরকার ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা স্থিতিশীল হলে জাতির দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা একটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। এ কাজটি কেউ কেউ চাইলেও অতি দ্রুত করার সুযোগ নেই। এর প্রধান কারণ, প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো বেহাল। সরকার পরিবর্তনের পর দেখা যাচ্ছে, থানা ও রাস্তা থেকে পুলিশ সরে পড়েছে।
এমনটা দেখা গেল এবারই প্রথম। অবশ্য পুলিশের ওপর দিয়ে যে ধকল গেছে, তাদের পুরোপুরি কাজে ফিরিয়ে আনা একটু কঠিন কাজই বটে। আবার বাহিনীটির কিছু সদস্যকে বিদায়ী সরকারের কর্তৃত্ববাদী ও নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার ক্রীড়নক হিসেবে উৎসাহী ভূমিকায় আমরা দেখেছি। আমরা জেনেছিলাম, ২০১৮–এর নির্বাচনের আগের রাতে ভোটকেন্দ্রগুলোতে তাদের কারও কারও ব্যালট পেপার নিয়ে সরকারি দলের প্রার্থীদের অনুকূলে সিল দেওয়ার বিষয়টি। এমনকি ওই ‘নির্বাচনে’ সরকারকে ক্ষমতায় রাখার দাবিও কেউ কেউ করেছেন। এ ছাড়া জনপ্রত্যাশা ও আইনের বিপরীতে তখনকার ক্ষমতাসীন দলটির নেতা-কর্মীদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে জনগণের মধ্যে একটি সুপ্ত প্রচণ্ড ক্ষোভও তারা জাগিয়ে তুলেছিল।
এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের পরপর। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেক পুলিশ সদস্য প্রাণ হারান, আহত হন, বিধ্বস্ত হয় পুলিশের অনেক স্থাপনা ও যানবাহন। তবে অতি অবশ্যই বলতে হবে, পুলিশ ছাড়া দেশ চলবে না। সামরিক বাহিনী সহায়ক শক্তি হিসেবে সাময়িকভাবে আছে। এ ক্রান্তিকালে তাদের ভূমিকাও ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হবে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসহ অপরাধ তদন্ত ও অনুরূপ কাজে পুলিশের বিকল্প হিসেবে তারা থাকবে না।
সুতরাং পুলিশকেই ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সাহস ও প্রেরণা দিতে হবে। দ্রুততার সঙ্গে অবকাঠামোগত বিষয়গুলো এখনকার মতো চালুর ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি বিতর্কিত কর্মকর্তাদের মূলস্রোত থেকে সরিয়ে দিতে হবে। কারও কারও বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ আনারও প্রয়োজন রয়েছে। এর মাঝে নবনিযুক্ত প্রধান উপদেষ্টা নৈরাজ্যকে পরাভূত করার আহ্বান জানিয়েছেন। আমরা আশাবাদী।
তার পরপরই আসবে সাধারণ প্রশাসনের কথা। এরা রয়েছে সচিবালয়ে, কোনো কোনো অধিদপ্তর ও মাঠ প্রশাসনে। এ প্রতিষ্ঠানও দীর্ঘস্থায়ী দলীয়করণের রূঢ় পরিণতিতে ব্যাপক জনসমষ্টির আস্থা ধরে রাখতে পারেনি। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও তদন্ত হচ্ছে না। যার ফলে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে বেশ কিছু সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুপস্থিতি ও নিষ্প্রাণ অবস্থা লক্ষ করা যাচ্ছে। তাঁদের কেউ কেউ পরিস্থিতির চাপে এমনটা করতে পারেন। তবে একটি অংশ পদ–পদবি ও বেআইনি সুবিধা ভোগ করার জন্য দলবাজি করেছেন। এখন ভয়ে পলায়নপর অবস্থায় আছেন। অথচ নতুন সরকার আসার আগে সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় সচিবালয়ে ব্যাপক কর্মচাঞ্চল্য থাকার কথা ছিল। নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী বা উপদেষ্টাদের মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত প্রাথমিক ধারণা দিতে একটি ধারণাপত্র তৈরি করা হয়। এমনটা হয় যুক্তরাজ্য, ভারতসহ অন্য দেশগুলোতে। অথচ এর বিপরীতটাই আমরা দেখে বিস্মিত না হলেও মর্মাহত হচ্ছি।
পাশাপাশি আশ্বস্ত করতে হবে সবাইকে যে তারা ব্যাপক দলবাজি করে অন্যায্য সুবিধাভোগী বা দুর্নীতির অংশীদার না হলে তারা নিরাপদে থাকবে। একটি সুস্থির ভাব ফিরিয়ে আনা দরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান নিয়ে সরকারকে সমন্বিত ব্যবস্থা নিতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থার ভাব ফিরিয়ে আনা ও মান উন্নীত করার জন্য যেটুকু প্রয়োজন, দ্রুতই করতে হবে।
জানা যায়, খুব কম মন্ত্রণালয়ই সক্রিয় রয়েছে। মাঠ প্রশাসনও চলছে নির্দেশনাহীন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নির্বাহী অঙ্গ পুলিশের অনুপস্থিতিতে। অথচ সচিবালয়, অধিদপ্তর ও মাঠ প্রশাসন শুধু নির্বাচন নয়, সরকারের অন্যান্য দায়িত্ব সম্পাদনের জন্যও অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান। শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় বেশ কিছু যোগ্য কর্মকর্তাকে বছরের পর বছর বঞ্চিত করে অন্যরা সুফলভোগী হয়েছেন। এখন বঞ্চিতদের ক্ষোভের আগুনেও ধিকিধিকি জ্বলছে সচিবালয়, অধিদপ্তর ও মাঠ প্রশাসন। এ অবস্থা থেকেও ক্রমান্বয়ে নিপুণভাবে বের হয়ে আসতে হবে।
অন্য সব কাজ করার জন্য এসব প্রতিষ্ঠানকে গতিশীল করতে বেশ কিছু ক্ষেত্রে সার্জিক্যাল অপারেশনের দরকার হবে। তবে যেকোনো অবিবেচনাপ্রসূত কাজ নতুন ক্ষোভের জন্ম দিয়ে অন্যদিকে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। পুলিশের মতো হাতে থাকা কর্মকর্তাদের দিয়েই এসব প্রতিষ্ঠান চালু রাখতে হবে। বিবেচনায় রাখতে হবে, গত ১৬ বছর নির্দয় দলীয়করণ হয়েছে। এমনকি নতুন নিয়োগ পর্বেও পিএসসি কর্তৃক সুপারিশকৃত প্রার্থীর পুলিশি ও গোয়েন্দা তদন্তেও শুধু তার নয়, অকারণে তার বৃহত্তর পরিবারে রাজনৈতিক পরিচিতি প্রাধান্য পেয়েছে। অথচ নিয়মানুযায়ী সুপারিশকৃত প্রার্থীদের রাষ্ট্রদ্রোহমূলক কাজ বা ফৌজদারি অপরাধই এসেছে বিবেচনায়।
এভাবেই আমাদের হতভাগ্য দেশটিতে বেশ কিছু মেধাবী ছেলেমেয়ে কঠিন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় পিএসসি কর্তৃক সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েও বঞ্চিত হয়েছেন নিয়োগ থেকে। পদোন্নতিও হয়েছে একই প্রক্রিয়ায়। এখন থেকে হয়তো এমনটা হবে না। হয়তোবা এ দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল। কিন্তু নতুন দলীয় সরকার এসে কী করে, সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। এ ধরনের দলীয় বিবেচনা ব্যাপকভাবে চালু হয় এরশাদ সরকারের বিদায়ের পর নির্বাচিত সরকারগুলোর সময়কালে।
আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তির পর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সরকার পরিবর্তনের সুযোগ কার্যত না থাকায় এটা ষোলোকলা লাভ করে। এতে রাজনীতিকদের ইন্ধন জোগান বেশ কিছু স্বার্থান্বেষী তুলনামূলক নিম্নমানের কর্মকর্তা। তাঁদের ষোলোকলা পূর্ণ হলেও দেশের শাসনব্যবস্থায় সৃষ্টি হয়েছে গভীর ক্ষত। ব্যবস্থাটি প্রসারিত হয়েছে উচ্চ আদালতসহ বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়সহ স্বাস্থ্যব্যবস্থায়।
হতে পারে বিদায়ী সরকারের সময়কালে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে। বেড়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন। কিন্তু সেসব ক্ষেত্রেও সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা একটি শ্রেণি দুর্নীতি করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছে। অন্যদিকে বেড়ে গেছে আয়বৈষম্য। অবিভক্ত পাকিস্তানে আইয়ুব খান অনেক উন্নয়নকাজ করেছিল। কিন্তু দমিয়ে রেখেছিল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। ফলে একপর্যায়ে জনগণ এমনই একটি গণ–অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে ছুড়ে ফেলে দেয়।
কথা থাকবে এ সময়ের জন্য জরুরি করণীয় কী? প্রকৃতপক্ষে জনগণের অনেক প্রত্যাশার মুখে দায়িত্ব নিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তাদের অগ্রাধিকারে রয়েছে সেই প্রত্যাশা পূরণ। আর সেটা করতে গিয়ে যে হাতিয়ারগুলো প্রয়োজন হবে, সেসব প্রতিষ্ঠানে সতর্কতার সঙ্গে অথচ দ্রুত বেশ কিছু পরিবর্তন করতে হবে। অতি অবশ্য কোনো প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সবাই দলবাজ বা ব্যাপক সুবিধাভোগী, এমনটা বলা যাবে না। সচিবালয়, অধিদপ্তর, পুলিশ ও মাঠ প্রশাসনে সতর্কতার সঙ্গে রদবদল শুরু করতে হবে।
পাশাপাশি আশ্বস্ত করতে হবে সবাইকে যে তারা ব্যাপক দলবাজি করে অন্যায্য সুবিধাভোগী বা দুর্নীতির অংশীদার না হলে তারা নিরাপদে থাকবে। একটি সুস্থির ভাব ফিরিয়ে আনা দরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান নিয়ে সরকারকে সমন্বিত ব্যবস্থা নিতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থার ভাব ফিরিয়ে আনা ও মান উন্নীত করার জন্য যেটুকু প্রয়োজন, দ্রুতই করতে হবে।
এ–জাতীয় ক্ষেত্রে কিছু বাদ পড়বেন এবং বঞ্চনার অবসান যতটা সম্ভব করা যাবে। যা আছে তা–ই নৈপুণ্যের সঙ্গে নাড়াচাড়া করে প্রশাসনকে কার্যকর ও গতিশীল করাই এখন সময়ের দাবি। সেটা যত দ্রুত করা যায়, ততই মঙ্গল।
আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব