একটি টেকসই ও সমৃদ্ধ বিশ্ব বিনির্মাণে জাদুঘর যেভাবে ভূমিকা রাখতে পারে

আজ ১৮ মে বিশ্ব জাদুঘর দিবস। ১৯৭৭ সাল থেকে দিবসটি পালন করে আসছে ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব মিউজিয়ামস (আইকম)। বিশ্বের সব জাদুঘরের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ বৃদ্ধি, একটি সাধারণ প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা যেখানে জাদুঘর বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা একত্রে সাংস্কৃতিক নিদর্শন সংরক্ষণ, নিদর্শনের গবেষণা ও প্রকাশনা করা, সংস্কৃতির বিনিময় ও উন্নয়ন, মানুষের মধ্যে শান্তি ও সহযোগিতা এবং পারস্পরিক সমঝোতা বৃদ্ধি করা আইকমের প্রধান লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য থেকে সংস্থাটির উদ্যোগে এ দিবস পালন শুরু হয়।

প্রতিবছরের মতো এবারও আইকম এ দিবসের জন্য একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে। পৃথিবীতে একটি টেকসই, নির্মল, সবুজ, নিরাপদ ও সমৃদ্ধ আবাসস্থল বিনির্মাণে জাদুঘর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। একটি জাদুঘর নিদর্শন সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও গবেষণালব্ধ জ্ঞান দ্বারা দর্শকদের গ্যালারি পরিদর্শনের ব্যবস্থা করে থাকে। নিয়মিত দর্শক/বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আগত ছাত্রছাত্রী, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, পথশিশু থেকে শুরু করে দেশি-বিদেশি ভিআইপি ইত্যাদি পর্যায়ে নিয়মিত গাইড সেবা প্রদান করে থাকে।

এ ছাড়াও নানা দিবসকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখছে। এর মধ্যে দিয়ে শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা, সামাজিক মূল্যবোধ তৈরিতে জাদুঘর অসামান্য অবদান রেখে চলেছে। এ ছাড়া গবেষকদের জাদুঘরের নিদর্শন নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ এবং বিভিন্ন ইলেকট্রিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার কর্মীদের জাদুঘরের ওপর বিশেষ ফিচার ও প্রতিবেদন তৈরি ও জাদুঘরের ওপর জাদুঘরের কর্মীদের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে নিয়ে সরাসরি অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা ইত্যাদি কাজে সহযোগিতা করছে।

বর্তমান ডিজিটালাইজেশনের যুগে মোবাইল গেম, ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদি ব্যবহারে সারা বিশ্বের মতো এ দেশের শিশু–বয়স্ক সবাই সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। আর এই বিচ্ছিন্নতা রোধে ভূমিকা পালন করতে পারে জাদুঘর। কেননা জাদুঘরগুলো সব শ্রেণির দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত এবং বিনোদনের পাশাপাশি প্রায়োগিক ও বাস্তবিক জ্ঞান বিতরণ করে থাকে।

এবারের আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবসের প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে দেশ তথা বিশ্বের প্রায় সব জাদুঘর সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে জনগণকে সচেতন করে তোলার চেষ্টা করছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর যেমন সারা বছর বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নাচ, গান, কবিতা আবৃত্তি, গুণীজনদের ওপর ডকুমেন্টারি তৈরি ইত্যাদি অনুষ্ঠান করে দর্শকদের বিনোদন তথা মানসিক শান্তি প্রদান করে থাকে।

জাদুঘর ভ্রমণ করে জাদুঘরের প্রদর্শনীসহ জাদুঘরের পরিচ্ছন্ন পরিবেশ থেকে দর্শনার্থীরা প্রভূত জ্ঞান অর্জন করে, এতে তাদের মধ্যে মানসিক উৎফুল্লতাও তৈরি হয়।
এসডিজির ১৭টি লক্ষ্য থেকে আইকম ১৮ মে আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস ২০২৩ পালন উপলক্ষে তিনটি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে একটি লক্ষ্য হলো, সব বয়সী সব মানুষের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশ এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা রোধ করা।

যেকোনো দেশের জাদুঘরগুলো জাতির দর্পণস্বরূপ। জাদুঘরকে বলা হয় অনানুষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ লক্ষ্যের আলোকে জাদুঘরগুলো নিম্নোক্ত ভূমিকা পালন করতে পারে:

স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে হাসপাতাল, ক্লিনিকের ডাক্তার–নার্স/অটিজিম স্কুল-কলেজ/মা-বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করে বিশেষ চাহিদসম্পন্ন শিশুদের জাদুঘর পরিদর্শনে আনার ব্যবস্থা করা এবং তাদের মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশে ভূমিকা পালন করা। অন্ধদের জন্য ব্রেইল পদ্ধতিতে লেবেল, কি লেবেল তৈরি করে নিদর্শন প্রদর্শন করা এবং তাদের জাদুঘরে এনে জাদুঘর দেখানোর ব্যবস্থা করা।

বাক্‌প্রতিবন্ধীদের জাদুঘর পরিদর্শনে আনার ব্যবস্থা করা এবং তাদের মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশে ভূমিকা পালন করা। প্রদর্শিত নিদর্শন তাদের উপযোগী করে উপস্থাপন এবং সাংকেতিক ভাষায় তাদের নিদর্শন সম্পর্কে গাইড দ্বারা বর্ণনা দেওয়া এবং প্রতিটি শোকেসের সামনে ট্যাবে করে তাদের ভাষায় ভিডিও চিত্র তৈরি করে উপস্থাপন করা।

বয়স্কদের/বৃদ্ধাশ্রমের বৃদ্ধাদের/বিশেষভাবে চলাচলে অক্ষম ব্যক্তিদের/মাদকাসক্ত—ডিজিটাল আসক্ত শিশুদের/ পথশিশুদের জাদুঘর পরিদর্শনে আনার ব্যবস্থা করা এবং জাদুঘরের গ্যালারি পরিদর্শনের মাধ্যমে মোটিভেশন করা, তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন করা। শিশুদের জন্য বিশেষ কর্নার করা/বয়োবৃদ্ধদের জন্য বিশেষ গেমের ব্যবস্থা করা। শিশুদের জন্য আলাদা করে বিশেষ কর্নার এবং নিদর্শন-সম্পর্কিত গেমের ব্যবস্থা করা, যা টাকা জাদুঘর করেছে। শিশুদের জন্য বিভিন্ন কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা এবং পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা করা। জাদুঘরে নিদর্শন প্রদর্শনের পাশাপাশি বিশেষ নিদর্শন দিয়ে বিভিন্ন পোস্টার স্লোগান প্রদান করা।

বর্তমান ডিজিটালাইজেশনের যুগে মোবাইল গেম, ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদি ব্যবহারে সারা বিশ্বের মতো এ দেশের শিশু–বয়স্ক সবাই সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। আর এই বিচ্ছিন্নতা রোধে ভূমিকা পালন করতে পারে জাদুঘর। কেননা জাদুঘরগুলো সব শ্রেণির দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত এবং বিনোদনের পাশাপাশি প্রায়োগিক ও বাস্তবিক জ্ঞান বিতরণ করে থাকে।

বয়স্ক, শিশু পরিচিত, অপরিচিত সব শ্রেণির দর্শকের জাদুঘর একটি মেলবন্ধন করে দিতে পারে। জাদুঘর ভ্রমণের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের কোনো পরিচিত বন্ধু, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে একে অপরের দেখা হওয়া, কথা বলার সুযোগ, যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং হৃদ্যতা বৃদ্ধি পাবে। আর এ ক্ষেত্রে জাদুঘরকে আন্তরিকতার সঙ্গে দর্শকদের গ্রহণ করা ও তার কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে চালিয়ে যাওয়া এবং দর্শকদের চাহিদা মোতাবেক নিদর্শন প্রদর্শন করা। এককথায় সব বয়সী সব মানুষের জাদুঘর পরিদর্শনে আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিকর প্রভাব কমাতেও জাদুঘরের ভূমিকা রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের দুটি কারণ রয়েছে। একটি হলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অপরটি হলো মনুষ্যসৃষ্ট সংকট। তবে পরিবেশ দূষণে মনুষ্যসৃষ্ট সংকটই বেশি দায়ী। কার্বন/বায়ুদূষণ/শব্দদূষণ/অতিমাত্রায় হর্ন বাজানো/অতিরিক্ত গাড়ির ব্যবহার এর পরিমাণ হ্রাস করা।

এর থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে ফুয়েল ব্যবহারকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের জাদুঘর ভ্রমণে আনার ব্যবস্থা করা এবং এ বিষয়ে তাদের সচেতন করে তোলা এবং জাদুঘরের পরিচিতিসহ পোস্টার করে গাড়িতে লাগিয়ে প্রচারের ব্যবস্থা করলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। জীবাশ্ম জ্বালানি (কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস, পেট্রল, অকটেন, ডিজেল প্রভৃতি ব্যবহারের পরিমাণ হ্রাস করা। উন্নতমানের জ্বালানি ব্যবহার করা। বিদ্যুচ্চালিত গাড়ির ব্যবহার বৃদ্ধি করা।

মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশে এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা দূরীকরণে সব শ্রেণির দর্শকদের জাদুঘর পরিদর্শনে আসার আহ্বান জানানো এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এককথায়, সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নির্মল, সবুজ, টেকসই, নিরাপদ এবং সমৃদ্ধ পৃথিবী বিনির্মাণে জাদুঘরগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

  • ড. আছিয়া খানম কিউরেটর, টাকা জাদুঘর