এই তীব্র তাপপ্রবাহ আমাদেরই সৃষ্টি

গত কয়েক সপ্তাহ ভয়াবহ এক তাপপ্রবাহ দেখল দেশফাইল ছবি

মানবশরীরের তাপমাত্রা ও পানির ভারসাম্য রক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোনো কারণে যদি ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়, তখন পুরো ব্যবস্থাপনাই ভেঙে পড়ে। এ জন্য থামোরেগুলেশন ও অসমোরেগুলেশন মানবশরীরসহ অন্যান্য প্রাণীর জন্য অত্যাবশ্যক কার্যক্রম। ছোটবেলা থেকে আমরা শুনে আসছি, অতিরিক্ত যেকোনো জিনিসই খারাপ। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খারাপ ও শরীরের জন্য বিষ।

ভারসাম্য সামাজিক জীবন, ব্যক্তিগত জীবন ও পরিবেশ—সব ক্ষেত্রেই অতীব জরুরি। মানবশরীরে পানি ও তাপের ভারসাম্য পরিবেশের তাপমাত্রার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পরিবেশের অন্যান্য উপাদান ও জনস্বাস্থ্যে সরাসরি প্রভাব বিস্তার করে। শারীরবৃত্তীয় সব কার্যক্রম সঠিকভাবে চলতে শরীরের তাপমাত্রা ৩৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকা জরুরি।

এই তাপমাত্রায় শরীরের সব এনজাইম, হরমোন সঠিকভাবে কাজ করে। যদি এর চেয়ে বাড়তে থাকে, তবে নেগেটিভ কিডব্যাকের মাধ্যমে শরীর তা ঠিক রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু অতিরিক্ত বেড়ে গেলে শরীরের হোমেওস্টেসিস প্রক্রিয়া আর কাজ করে না।

বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার হিসাবে অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট জায়গার দৈনিক যে গড় তাপমাত্রা বিরাজ করে, তা থেকে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেলে এবং তা পরপর ৫ দিন চলমান থাকলে তাকে হিটওয়েভ বলে।

আমাদের দেশে এই হিটওয়েভ শুরু হয় ৩৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে (আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভাষ্যমতে)। বর্তমানে কিছু কিছু স্থানে তা প্রায় ৪৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাহলে বুঝতে আর বেশি কষ্ট হওয়ার কথা নয়, আমরা কী কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি।

গত ২৮ বছরের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে তীব্র তাপপ্রবাহ দেখা গেল সারা দেশে। এ পরিস্থিতি কি মানবসৃষ্ট, নাকি প্রকৃতির প্রতিশোধ। আমরা যেভাবেই বলি না কেন, মূল কারিগর হলো মানুষ। কারণ, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সব প্যারামিটার আমরা মাত্রাতিরিক্তভাবে বাড়িয়েই চলেছি। খুব গভীরভাবে না ভাবলেও হবে। সাধারণভাবেই যদি চিন্তা করেন, দেশে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার প্রতিক্ষণ বাড়ছে, না কমছে? প্রতিদিন ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক গাড়ির সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে; বাড়ছে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর পরিমাণ। সারা বিশ্বের জীবাশ্ম জ্বালানির পোড়ানোর কাজ প্রতিদিন বেড়েই চলছে।

আমাদের দেশের তো কথাই নেই। ১৯৫০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো কয়েক গুণ বেড়েছে। প্রতিদিন রেফ্রিজারেটর ও এসি ব্যবহারের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বৃদ্ধি পেয়েছে বন ধ্বংসের পরিমাণ, অকল্পনীয় ও অপরিকল্পিতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে কংক্রিটের বাড়িঘর। এ সব কিছুর মধ্যে  গ্রিনহাউস গ্যাস গ্রহণ করে বাতাসকে বিশুদ্ধ ও পরিশুদ্ধ করে সেই সবুজ গাছপালাকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি।

জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক কর্মপরিকল্পনার তথ্য অনুসারে কোনো আদর্শে শহর হলো সেটি, যেখানে ২৫ শতাংশ বনায়ন বা গাছপালা আছে। ২০২০ সালের এক জরিপে দেখা যায়, ঢাকা শহরে বনায়নের পরিমাণ ৮ শতাংশ। বর্তমানে তা আরও কমে যাচ্ছে। বিপরীত দিকে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ইটপাথরের ইমারত আর ইটভাটা। ঢাকা শহরের প্রতিটি মোড়ে যানজট প্রতিদিন বাড়ছে, যা অকল্পনীয়ভাবে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এটি এমন এক ফাঁদ তৈরি করছে, যার মধ্যে সূর্যের আলো প্রবেশ করছে কিছু কিছু ওয়েভ–লেংথ বা তরঙ্গদৈর্ঘ্য পরিবর্তন করে। তারপর সেই ফাঁদ থেকে আর বের হতে পারছে না। যার ফলে প্রতিনিয়তই তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

একইভাবে কিছু গ্যাস ওজোন স্তরের সঙ্গে বিক্রিয়া করে ছিদ্র করে ফেলছে। এই ছিদ্র দিয়ে আরও ভয়ংকর অতিবেগুনি রশ্মি প্রবেশ করে ক্যানসারের মতো ভয়াবহ রোগ সৃষ্টি করছে। একইভাবে তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। যত ধরনের গ্রিনহাউস গ্যাস আছে, এগুলোর মধ্যে কার্বন ডাই–অক্সাইড অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এ গ্যাস সবুজ গাছ দ্বারা শোষিত হয়ে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার কাঁচামাল হিসেবে কাজ করে। এ গ্যাস বনায়ন ধ্বংসের কারণে একদিকে যেমন শোষিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না, অন্যদিকে তেমন ইটভাটা ও জীবাশ্ম জ্বালানির যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে দিন দিন কার্বন ডাই–অক্সাইড মারাত্মকভাবে বেড়েই চলছে। এই নাজুক পরিস্থিতি অবসান কীভাবে সম্ভব, তা বলছি।

প্রথমত, দেশের বড় বড় শহরের বনায়নের শতকরা ভাগ নির্ণয় করতে হবে। বিভাগীয় ও জেলা শহরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সমাজের সব শ্রেণি–পেশার মানুষের সঙ্গে আলাপ–আলোচনা করে সামাজিক বনায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। বনায়ন পৃথিবীর কুলিং সিস্টেম হিসেবে কাজ করে। মানবদেহের ফুসফুস যেমন পরিষ্কার বাতাস গ্রহণ করে রক্ত পরিষ্কার করে দেহের সব কার্যক্রম ঠিক রাখে, তেমনভাবে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ বনায়ন কোনো এলাকার সব দূষিত বাতাস বা কার্বন ডাই–অক্সাইডযুক্ত বাতাস গ্রহণ করে অক্সিজেনযুক্ত বাতাস সরবরাহ করে।

যে হারে জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়ে কার্বন ডাই–অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড ও অন্যান্য ক্ষতিকারক পদার্থ তৈরি হচ্ছে, অন্যদিকে সবুজ বনায়ন ধ্বংস হচ্ছে, এরই মারাত্মক প্রভাব হিসেবেই এই অস্বাভাবিক তাপমাত্রা।

দ্বিতীয়ত, শহরাঞ্চলে যেসব পার্ক বা বিনোদনের জায়গা আছে, যেসব স্থানে সবুজ গাছপালা সংরক্ষণ ও বর্ধন নিশ্চিত করতে হবে। যেসব রাস্তার পাশে কোনো গাছ নেই অথবা গাছের ওপর ধুলাবালুর মোটা আস্তরণ পড়ে মৃতপ্রায়, সেসব রাস্তার পাশে গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে এবং সংস্কার করে পরিচ্ছন্ন গাছ সংরক্ষণ করা জরুরি। বিশেষজ্ঞেদের দ্বারা গঠিত টিম দিয়ে গাছের শ্রেণিবিভাগ করে স্থানভেদে তা রোপণ ও পরিচর্যা নিশ্চিত করতে হবে।

তৃতীয়ত, বনায়ন ধ্বংসের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত আইনের প্রয়োগ হতে হবে সিদ্ধহস্তে। কারণে–অকারণে কোনোভাবেই গাছ কাটা যাবে না। একান্ত প্রয়োজনে একটা গাছ কাটলে কমপক্ষে দুটি গাছ লাগাতে হবে। কারণ, সবুজ বনায়নের পরিমাণ কোনোভাবেই ২৫ শতাংশের কম হওয়া যাবে না।

চতুর্থত, যেসব জলাধারের পাড়ে ব্যক্তিমালিকানার গাছপালা আছে, সেগুলো সংরক্ষণে জনসচেতনতা ও সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করতে হবে। এবারের বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের স্লোগান হলো, ‘আমার স্বাস্থ্য, আমার অধিকার’।

স্বাস্থ্যকে বিশ্বের কমপক্ষে ১৪০টি দেশ মানবাধিকার হিসেবেই বিবেচনা করে তাদের নিজ নিজ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এই অধিকার সংরক্ষণের পথে অনেকগুলো বাধা আছে।

মানবাধিকার যেমনভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে, যেমনভাবে যুদ্ধবিগ্রহ, হানাহানি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে মানবাধিকার খর্ব হচ্ছে, একইভাবে পরিবেশের ওপর নির্মম–নিষ্ঠুর আচরণ করে প্রকৃতিকে করে তুলছি বিরূপ। তাই শান্তি স্থাপন করে প্রকৃতির সহজাত অবস্থান ফিরিয়ে এনে আমার অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি নিজে মনোনিবেশ করা। নিজে পুষ্টকর খাদ্য গ্রহণ করে নিয়মিত ব্যায়াম ও শরীরচর্চার মাধ্যমে নিজের দায়িত্ব পালন করা। আর এভাবেই গড়ে উঠুক সুস্বাস্থ্যের শান্তিময় পৃথিবী।

  • ড. মো. গোলাম ছারোয়ার অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম), মহাখালী, ঢাকা।