রাশিয়ার সঙ্গে কেন সমঝোতা চান আগের চেয়ে বেশি ইউক্রেনীয়

এবারের জরিপে অর্ধেক ইউক্রেনীয় জানিয়েছেন, তাঁরা তাঁদের প্রিয়জনদের হারিয়েছেন।ছবি : রয়টার্স

প্রায় দুই বছর ধরে চলা যুদ্ধের ভয়াবহতা সয়ে টিকে রয়েছেন ইউক্রেনীয়রা। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া আগ্রাসন শুরুর পর ৬৩ লাখ ইউক্রেনীয় দেশ ছেড়েছেন। আর দেশের ভেতরে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ৩৭ লাখ।

এই যুদ্ধ ভূরাজনৈতিক ও বাস্তুসংস্থানিক স্বাভাবিকতা ভেঙে দিয়েছে। কিন্তু সাধারণ ইউক্রেনীয় যাঁরা দেশটিতে রয়ে গেছেন আর প্রতিদিন লড়াই করে বেঁচে থাকছেন, তাঁরা প্রতিদিন নারকীয় অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছেন।

যুদ্ধ যখন তৃতীয় বছরে পড়তে চলেছে, সে সময়ে সাধারণ ইউক্রেনীয়দের মনোভাব কী? একজন রাজনৈতিক ভূগোলবিদ হিসেবে অঞ্চলটিতে কাজ করার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা নিয়ে আমি বলতে পারি, যুদ্ধকালে ইউক্রেনীয়দের মতামত বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।

প্রতি চারজন ইউক্রেনীয়ও মধ্যে একজন এখন বাস্তুচ্যুত। যুদ্ধের সম্মুখভাগের প্রায় এক হাজার কিলোমিটার এলাকার পরিবেশ চরম অস্থিতিশীল, প্রতিদিনই ক্ষেপণাস্ত্র আর ড্রোন হামলা চলছে। দেশপ্রেমের অনুভূতি এখনো অনেক বেশি মাত্রায় থাকলেও, কিন্তু তাতে অবিশ্বাসও আছে। বিশেষ করে রাশিয়ার অধিকৃত এলাকার মানুষের মধ্যে এই মনোভাব অনেক বেশি।

এখন ইউক্রেনে টেলিফোনে জনমত জরিপ পরিচালিত হচ্ছে। জরিপ সংস্থাগুলো চালু থাকা টেলিফোন নম্বরে কল দেয় এবং ১৮ বছরের বেশি বয়সী নাগরিকদের নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে। কিন্তু তাতে সাড়া মিলছে খুব কম। এরপরও জরিপ সংস্থাগুলো নিরলসভাবে চেষ্টা করে চলেছে।

ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউটের সর্বশেষ জরিপ প্রকাশিত হয়েছে জানুয়ারি মাসে। ইউক্রেনীয়রা কীভাবে যুদ্ধের সঙ্গে মানিয়ে চলছেন, তা নিয়ে ২৬টি বিষয় উঠে এসেছে এই জরিপে। ২০২৩ সালের ১৪-২২ নভেম্বর টেলিফোনে জরিপটি পরিচালিত হয়, ২ হাজার ৫১৬ জন ইউক্রেনীয় তাতে অংশ নেন।

জীবনযাত্রার ব্যয় এবং মানসিক স্বাস্থ্যের বিপর্যয়

যুদ্ধ শুরুর পর ২০২২ সালের মে মাসে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট যে জরিপ করেছিল, তাতে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, যুদ্ধে তাঁরা তাঁদের বন্ধু ও স্বজনদের কাউকে হারিয়েছেন কি না। সে সময়ে পাঁচজনের মধ্যে একজন জানিয়েছিলেন, তাঁরা তাঁদের বন্ধু ও স্বজন হারিয়েছেন। এবারের জরিপে অর্ধেক ইউক্রেনীয় জানিয়েছেন, তাঁরা তাঁদের প্রিয়জনদের হারিয়েছেন।

ইউক্রেন যুদ্ধে মানসিক স্বাস্থ্যের যে ক্ষতি হচ্ছে, সেটা অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। অনেককে জোর করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাংকারে আশ্রয় নিতে হচ্ছে। সর্বশেষ জরিপে উঠে এসেছে, পুরুষদের মধ্যে অর্ধেক এবং নারীদের মধ্যে তিনজনের একজন মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। এককভাবে যদি বলতে হয়, তাহলে ঘুমের সমস্যায় ভুগছেন সবচেয়ে বেশি জন। কাজ হারানো, শারীরিক স্বাস্থ্যের অবনতি ও পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা—এসব সমস্যাও বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে।

যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ইউক্রেনের বিশাল একটি জনগোষ্ঠী শারীরিক ও মানসিক সমস্যার মধ্যে বাস করতে হবে। তাদের পুনর্বাসনের বিষয়টিকে এখনই বিবেচনায় নিতে হচ্ছে, ভবিষ্যতে সেটা আরও বাড়বে।

আগের চেয়ে বেশি ইউক্রেনীয় সমঝোতা চান

যুদ্ধ শুরুর পর প্রথম জরিপে (২০২২ সালের মে মাসে) ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট প্রশ্ন করেছিল, শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের কোনো ধরনের সমঝোতায় যাওয়া ঠিক হবে কি না। সে সময় ৫৯ শতাংশ ইউক্রেনীয় বলেছিলেন হ্যাঁ, যাওয়া উচিত। কিন্তু রাশিয়ার চরম নিষ্ঠুরতা, যুদ্ধাপরাধের কারণে একই বছরের আগস্ট মাসের জরিপে বেশির ভাগ ইউক্রেনীয় সমঝোতার বিরুদ্ধে মত দেন।

কিন্তু যুদ্ধের বর্তমান বাস্তবতায় ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সমঝোতায় আসা উচিত, এমন মত পোষণ করা ইউক্রেনীয়দের সংখ্যা বেড়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের গবেষকেরা যেসব গবেষণা করেছেন তাতে দেখা যায়, যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহত যত বাড়ে, যুদ্ধের প্রতি সমর্থন তত কমে।

কিন্তু আরেকটি বিষয় হলো, আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধে সব সময়ই বড় জনগোষ্ঠীর সমর্থন থাকে। কারণ, সেই যুদ্ধ প্রয়োজনীয় ও ন্যায্য। কিন্তু ইউক্রেন নতুন করে তাদের সেনাবাহিনীতে সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ সেনা নিয়োগ দেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর বিষয়টি বড় প্রশ্নের মুখে পড়েছে।

রাশিয়ার কাছে ভূখণ্ড খোয়াতে চান না ইউক্রেনীয়রা

যুদ্ধ শুরুর পরপর ইউক্রেনীয়দের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, কিসের বিনিময়ে তাঁরা শান্তি প্রতিষ্ঠায় আসতে চান। কিন্তু ইউক্রেনীয়দের মধ্যে যাঁরা যুদ্ধে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন।

যুদ্ধ শুরুর পর কিয়েভ ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোসিওলজির করা জরিপে দেখা যাচ্ছে, দ্রুত শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য রাশিয়াকে একচুল ভূখণ্ড ছাড় দেওয়ার ব্যাপারে ইউক্রেনীয়দের আপত্তি অনেক জোরালো। দক্ষিণ-পূর্ব ইউক্রেনে যুদ্ধে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত শহরগুলোর বাসিন্দারা বিশ্বাস করেন ইউক্রেনের অখণ্ডতা একটা পবিত্র বিষয়।

কিন্তু মানুষের মন তো বাস্তবতার সঙ্গে পরিবর্তন হওয়াটা স্বাভাবিক। ভূখণ্ড রক্ষা নাকি জীবন রক্ষা—কোন বিষয়ে অগ্রাধিকার দিতে হবে, তা নিয়ে ইউক্রেনীয়দের মধ্যে বিভক্তি তৈরি হয়েছে।

যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতাও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি। যুদ্ধের প্রথম দিকে ইউক্রেনীয়দের জন্য ঘরবাড়ি ছেড়ে আসাটাই প্রধান সমস্যা ছিল। সে সময়ে অধিকাংশই তাঁদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। ফলে দ্রুত অস্ত্রবিরতির পক্ষে বেশির ভাগ ইউক্রেনীয় মত দিয়েছিলেন।

রাশিয়া এখন ইউক্রেনের প্রায় ১৮ শতাংশ (২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির আগে দনবাস ও ক্রিমিয়ার যে অংশ দখলে নিয়েছিল তা বাদে) ভূখণ্ড অধিকার করে রেখেছে। এ প্রেক্ষাপটে জরিপে অংশ নেওয়া ইউক্রেনীয়দের ৭১ শতাংশ এখন খুব জোরালোভাবে মত দিয়েছেন যে তাঁরা কোনোভাবেই শান্তির বিনিময়ে রাশিয়ার কাছে ভূখণ্ড ছাড়তে রাজি নন। জোরালো না হলেও আরও প্রায় ১৩ শতাংশের মতামত একই। আর মাত্র ১২ শতাংশ লোক বলছেন, শান্তির বিনিময়ে রাশিয়ার কাছে ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়া তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য।

আর জরিপে অংশ নেওয়া খুব অল্পসংখ্যক ইউক্রেনীয় মত দিয়েছেন, শান্তির বিনিময়ে ন্যাটোতে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা থেকে সরে আসার বিষয়টি তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য।

দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধেও আশাবাদী ইউক্রেনীয়রা

যুদ্ধ খুব তাড়াতাড়ি শেষ হতে পারে, সেটা মনে করেন না ইউক্রেনীয়রা। ৪৩ শতাংশ মনে করছেন, যুদ্ধ কমপক্ষে আরও এক বছর ধরে চলবে। তিনজনের একজন বলছেন, যুদ্ধ কবে শেষ হবে, তা নিয়ে তাঁদের কোনো ধারণা নেই।

২০২২ সালের মে মাসের জরিপে তিনজনের একজন ইউক্রেনীয় মনে করতেন, যুদ্ধ তিন মাসের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। সর্বশেষ জরিপ বলছে, মাত্র ৩ শতাংশ ইউক্রেনীয় মনে করেন, যুদ্ধ তাড়াতাড়ি শেষ হতে পারে।

যুদ্ধ যখন ইউক্রেনকে গুঁড়িয়ে চলছে, সে সময়ে ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে ইউক্রেনীয়রা অনেক বেশি আশাবাদী। ৭৭ শতাংশ বলছেন, তাঁরা তাঁদের দেশ নিয়ে আশাবাদী।

ইউক্রেন নিয়ে যুদ্ধক্লান্তি তাদের পশ্চিমা পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে বেড়েই চলেছে। কিন্তু একটা রূঢ় সত্য হলো, এই ক্লান্তি বোধের ধরন যে কী রকম, সেটা ইউক্রেনীয়দের চেয়ে আর কেউ ভালো বুঝতে পারছেন না। যুদ্ধে সাধারণ ইউক্রেনীয়দের চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে। তাঁরা তাঁদের প্রিয়জনদের হারাচ্ছেন, ঘরবাড়ি ও বসতি ধ্বংস হচ্ছে, পরিবেশ বিষাক্ত হচ্ছে, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হচ্ছে।

এ সবকিছুর প্রতিফলন জনমত জরিপে ঘটছে। কিন্তু স্বাধীনতা আর ভূখণ্ডের অখণ্ডতার ব্যাপারে ইউক্রেনীয়দের প্রতিরোধ আকাঙ্ক্ষা এখনো জোরালোভাবে রয়ে গেছে।

  • জেরার্ড টোল যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া টেকের সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে অধ্যাপক
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত