ব্রাজিলের বেলেম শহরে এ বছর কপ৩০ শেষ হওয়ার পর দেশে-বিদেশে চলছে পাওয়া না–পাওয়ার নানা হিসাব। কী পেলাম, কী পেলাম না, কেন পেলাম না আর কী পাওয়া উচিত ছিল—এসবই মূলত আলোচনার বিষয়। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য সবচেয়ে বেশি জরুরি প্রশ্ন হলো উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার বিষয়টি।
দীর্ঘদিন ধরে চলা জলবায়ু সম্মেলনের আলোচনা থেকে বোঝা যায়, আমাদের দর–কষাকষির ভাষ্যে বড় ঘাটতি রয়েছে। দর–কষাকষি আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনীতির একটা বহুল প্রচলিত পদ্ধতি। দর–কষাকষির প্রক্রিয়ায় কে কী পাবে, তা আলোচনার টেবিলে বসার আগেই মোটামুটি নির্ধারিত হয়ে যায়। কারণ, প্রতিটি পক্ষের শক্তি ও সামর্থ্যই তা নির্ধারণ করে দেয়।
জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশসহ অন্য দেশগুলো ক্ষতিপূরণ হিসেবে অর্থ আদায়ের চেষ্টা চালায়। উন্নত বিশ্বও এটিকে ক্ষতিপূরণ হিসেবেই বলে থাকে। কিন্তু বাস্তবে তারা এটিকে ক্ষতিপূরণ না দয়াদাক্ষিণ্য হিসেবে দেখে, তা বোঝা জরুরি। যে ক্ষতিপূরণ চাইবে, সে পাওনাদার। সাধারণ নিয়মে পাওনাদারের অবস্থান থাকে ওপরে। কিন্তু জলবায়ু ক্ষতিপূরণ আদায়ের এসব দর–কষাকষিতে আমাদের অবস্থান যে উন্নত দেশগুলোর দয়ার ওপর নির্ভর করে, সেটি মোটামুটি সবারই জানা।
এর মানে জলবায়ু ন্যায্যতা (ক্লাইমেট জাস্টিস) নিয়ে সারা দুনিয়ায় যতই উচ্চবাচ্য হোক, আমাদের মানসিকতায় তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। তাই জলবায়ু ন্যায্যতার ধারণা শুধু কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে।
এবারের সম্মেলনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের প্রতিশ্রুতির তুলনায় ২০৩৫ সাল পর্যন্ত জলবায়ু অভিযোজনে অর্থায়ন তিন গুণ বাড়ানো হবে। আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিত ২৯তম কপ সম্মেলনে এ বিষয়ে ‘নিউ কালেকটিভ কোয়ানটিফায়েড গোল’ নামে সম্মতি এসেছিল। কিন্তু এবারের সম্মেলনে বাড়তি অর্থ জোগাড় করার বদলে বিষয়টি সম্পূর্ণ ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। মূলত আগের বছরের যে প্রতিশ্রুতি ছিল, তা আরও দুর্বল হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছিল ২০৩০ সালের মধ্যে অভিযোজনের অর্থ তিন গুণ করা হবে।
বাস্তবতা হলো পেটে ভাত না থাকলে মানুষ সম্মানের চেয়ে খাবার জোগাড়েই বেশি মনোযোগ দেয়। তাই ভাবমূর্তির চেয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেই বেশি মনোযোগ আমরা দেখেছি।
সমস্যা হলো এবারের সম্মেলনেও ক্ষতিপূরণের এ টাকা আদায়ে নির্দিষ্ট আইনি সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি, জবাবদিহি পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়নি এবং এ অর্থ যে একদম নতুন একটা তহবিল থেকে দেওয়া হবে, সে বিষয় নির্দিষ্ট করা হয়নি। ফলে উন্নত দেশগুলো যেটুকু অর্থ দিচ্ছে, সেটি তারা অন্য উন্নয়নমূলক খাত থেকে সরিয়ে জলবায়ু তহবিলে দেবে। ফলে দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো যেসব খাতে তারা অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে সহায়তা দিত, সেটি আরও কমে যাবে।
উন্নত দেশগুলোর জোট অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার (ওইসিডি) হিসাবে দেখা যায়, দাতা দেশগুলো দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন সহায়তা (ওডিএ) হিসেবে দরিদ্র দেশগুলোকে যে অর্থ দিয়ে থাকে, সেখানে জলবায়ু খাতে সহায়তা ক্রমাগত বেড়েছে। ২০১১ সালে সব কটি দাতা দেশের সম্মিলিত উন্নয়ন সহায়তার মধ্যে জলবায়ু সহায়তার পরিমাণ ছিল ১০ শতাংশ। ২০২৩ সালে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৯ শতাংশ, অর্থাৎ সার্বিক উন্নয়ন সহায়তার একটা বড় অংশ ক্রমাগত জলবায়ুসহায়তা হিসেবে দেওয়া হচ্ছে। ফলে এটি ‘নতুন ও বাড়তি’ অর্থ নয়। এবারের কপ সম্মেলনেও বিষয়টি সুরাহা হয়নি।
এটি বোধগম্য যে উন্নত দেশগুলো তাদের উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেই জলবায়ু তহবিলে অর্থ দিয়ে থাকে। আলাদাভাবে নতুন আরেকটা কাঠামো তৈরির ঝক্কি এড়ানোর জন্যই তারা এটা করে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে বাড়তি অর্থ বরাদ্দ দিলে তা যুক্তিসংগত হতো। জলবায়ু ক্ষতিপূরণ হিসেবেই যে টাকা দেওয়া হচ্ছে, অন্য উন্নয়নমূলক খাত থেকে কাটছাঁট করা হয়নি, সেটি তাহলে প্রমাণিত হতো। কিন্তু তা না হওয়ায় উন্নত দেশগুলো দুই ধরনের সুবিধাই লাভ করছে। একই তহবিল দুবার দেখিয়ে তারা জলবায়ু ক্ষতিপূরণ ও উন্নয়নসহায়তা—দুটি লক্ষ্যমাত্রাই পূরণ করেছে বলে দাবি করতে পারছে।
এখান থেকে প্রমাণিত হয় যে উন্নত দেশগুলো জলবায়ু তহবিলকে ক্ষতিপূরণের পরিবর্তে দয়াদাক্ষিণ্য হিসেবেই দেখছে।
অভিযোজন বনাম প্রশমন
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অভিযোজনের চেয়ে প্রশমনে অগ্রাধিকার দেওয়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর চেয়ে উন্নত দেশগুলোর স্বার্থই বেশি রক্ষা পাচ্ছে। কারণ, জলবায়ু অভিযোজনে যে অর্থ দেওয়া হয়, সেটি ব্যয় হয় ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মানুষের কল্যাণে। কিন্তু জলবায়ু প্রশমনের অর্থ কোনো নির্দিষ্ট দেশের সীমারেখায় আবদ্ধ নয়। এটি পাবলিক গুড। কারণ, কার্বন নির্গমন কমালে শুধু অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ নয়, উন্নত বিশ্বের মানুষও এর সুফল পাবে। তাই প্রশমনে যে অর্থ দেওয়া হচ্ছে, সেটি ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেখার সুযোগ নেই।
ওইসিডির ২০২৩ সালের হিসাবে দেখা যায়, দাতা দেশগুলো ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে জলবায়ু প্রশমনের প্রাথমিক লক্ষ্য নিয়ে করা প্রকল্পে। অন্যদিকে জলবায়ু অভিযোজন, যার উপকারভোগী মূলত বাংলাদেশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো, সেসব প্রকল্পে দাতা দেশগুলো ব্যয় করেছে মাত্র ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তিতে যেমনটি বলা হয়েছিল যে প্রশমন ও অভিযোজনের অর্থায়নের মধ্যে সমতা আনতে হবে, সেই লক্ষ্য পূরণেও শিল্পোন্নত দেশগুলো ব্যর্থ হয়েছে।
কপ৩০-এ অভিযোজন–সংক্রান্ত অর্থায়ন নিয়ে সতর্ক ও দুর্বল সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে প্রশমন ও অভিযোজনের এ ভারসাম্যহীনতা কমার কোনো লক্ষণ নেই; বরং আমরা দেখলাম অভিযোজন অর্থায়নের অগ্রগতি মাপতে সূচক চালু করার বিষয়ে উন্নত দেশগুলো বাধা দিয়েছে।
দরকার নতুন চিন্তা
জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের (ইউএনএফসিসি) এটি বড় একটি ব্যর্থতা। ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত প্যারিস চুক্তিও সে জন্য কার্যকর কিছু করতে পারেনি। উদ্দেশ্য ছিল দেশগুলো যে প্রতিশ্রুতি দেবে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের ভাবমূর্তি ধরে রাখতে তারা সেটি প্রতিপালন করবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো পেটে ভাত না থাকলে মানুষ সম্মানের চেয়ে খাবার জোগাড়েই বেশি মনোযোগ দেয়। তাই ভাবমূর্তির চেয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেই বেশি মনোযোগ আমরা দেখেছি।
ফলে এ প্রক্রিয়ায় আমরা কতটুকু কী অর্জন করতে পারব, তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। আর কিছু অর্জন করলেও সেটি কত দিনে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এদিকে আমাদের মতো দেশগুলোর মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগে চরম দুর্ভোগে দিন যাপন করতেই থাকবে। তাই এ প্রক্রিয়া চালু থাকুক, কিন্তু নতুন কোনো পদ্ধতি নিয়ে ভাবা দরকার। এমন যেন না হয় আমরা অন্ধ কানাগলিতে এমনভাবে আটকে থাকি, যাকে অরুন্ধতী রায়ের ভাষায় বলা যায় ‘এন্ড অব ইমাজিনেশন’ বা কল্পনাশক্তির সমাপ্তি।
খলিলউল্লাহ্ প্রথম আলোর জলবায়ু প্রকল্প ব্যবস্থাপক
মতামত লেখকের নিজস্ব