যে নীতি মিয়ানমারকে ভেঙে দিতে পারে

মিয়ানমার সেনাসদস্যদের কুচকাওয়াজছবি: এএফপি

মিয়ানমার, একদা যে দেশটি গণতন্ত্রের জন্য উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল, সেই দেশই এখন সংঘাত, হতাশা ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের পাঁকে নিমজ্জিত। গত মাসে দেশটির জান্তা সরকার ২০১০ সালে পাস হওয়া একটি আইন অনুযায়ী দেশটির তরুণদের সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক নিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। এর মানে বিদ্রোহের ধাক্কা সামলাতে মিয়ানমারের জান্তা সরকার মরিয়া হয়ে উঠেছে।

বিদ্রোহীরা একের পর এক ভূখণ্ড দখল করছে এবং জান্তা সরকারের ক্ষমতার ওপর চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। বাধ্যতামূলক নিয়োগের সিদ্ধান্তে সামরিক সরকার অনেকটা স্বীকার করে নিল যে দেশের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণের শক্ত মুঠি আলগা হয়ে আসছে।

বিদ্রোহীরা চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করায় এখন জান্তা সরকার তাদের অবস্থান সমুন্নত রাখার জন্য শক্ত পদক্ষেপ নিতে চাইছে। কিন্তু সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক নিয়োগ জান্তা সরকারের শক্তি–সামর্থ্যের প্রকাশ নয়; বরং ভিন্নমতাবলম্বীদের উত্থানের যে জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে, তা ঠেকাতে তাদের চরম দুর্বলতা ও অক্ষমতার প্রকাশ।

এখনো অবাস্তবায়িত ২০১০ সালের আইন অনুযায়ী, ১৮–৩৫ বছর বয়সী পুরুষদের এবং ১৮–২৭ বছর বয়সী নারীদের দুই বছর পর্যন্ত সেনাবাহিনীকে সেবা দিতে হবে। চিকিৎসক বা অন্য পেশার বিশেষজ্ঞদের ক্ষেত্রে ৪৫ বছর বয়স পর্যন্ত সেই সেবা দিতে তিন বছরের জন্য।

মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন জানিয়েছে, বর্তমান জরুরি অবস্থাকালে এই সেবা কমপক্ষে পাঁচ বছর পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। বছরের পর বছর ধরে মিয়ানমার সেনাবাহিনী অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা ভোগ করে আসছে। বিরোধীদের কণ্ঠস্বর তারা স্তব্ধ করে আসছে। ভয় ও দমনের সংস্কৃতি চাপিয়ে দিয়েছে। যা–ই হোক, দেশটির জনগণের প্রতিরোধ এবং গণতন্ত্রের প্রতি অবিচল অঙ্গীকারের কারণে জান্তা সরকার অপরাজেয় বলে যে বিভ্রম তৈরি হয়েছিল, তা ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। 

 অক্টোবরের শেষ হতে এখন পর্যন্ত সব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মিয়ানমারের জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো এবং গণতন্ত্রপন্থী যোদ্ধারা ৪০০টির বেশি সেনাঘাঁটি এবং ৩০০–এর বেশি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। ফলে সেখানকার জান্তা সরকার অভূতপূর্ব হুমকির মুখে পড়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩১ জানুয়ারি ক্ষমতা দখলের তৃতীয় বর্ষপূর্তি উপলক্ষে জান্তা সরকার রাষ্ট্রীয় জরুরি অবস্থা আরও ছয় মাস বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়।

মিয়ানমারের সীমান্তসংলগ্ন এলাকাগুলোতে জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো স্বশাসন প্রতিষ্ঠা করে চলেছে। সামরিক জান্তাবিরোধী সংগঠনগুলো একত্র হওয়ায় সংঘাত এমন মাত্রায় পৌঁছেছে, যা মিয়ানমারের ইতিহাসে অভূতপূর্ব।

বিদ্রোহী বাহিনীগুলো শুধু সামরিক সরকারের প্রতি তাদের বিরোধিতার কারণেই ঐক্যবদ্ধ হয়নি, সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক কাঠামো ভেঙে ফেলে এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের ভিত্তিতে একটা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য থেকেও তারা একত্র হয়েছে।

এখন জান্তা সরকারের ঘাড়ের ওপর পরাজয়ের ভূত চেপে বসেছে। একেকটা দিন যাচ্ছে আর বিদ্রোহীরা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে। সাধারণ মানুষের সমর্থন তাদের সাহসী করে তুলছে এবং ন্যায্যতা ও মুক্তির সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষা তাদেরকে অনুপ্রাণিত করছে। বিপরীতে সামরিক জান্তা ক্রমে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। তারা বলপ্রয়োগ ও দমনপীড়ন চালিয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে চাইছে। এমনকি দেশটির সামরিক জান্তার নিয়োগ করা প্রেসিডেন্ট সাবেক জেনারেল মিয়ন্ত সুয়ে সতর্ক করে বলেছেন, তাঁর দেশ বিপজ্জনক রকম বিশৃঙ্খলা ও বিভেদের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে। 

অসন্তোষ ও অন্যায্যতার মূল কারণ ধরতে জান্তা সরকার ব্যর্থ হওয়ায় মিয়ানমারের সংকটটাই কেবল তীব্র হয়েছে। মিয়ানমারকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক নিয়োগ কোনো সমাধান নয়; বরং জান্তা সরকার দেশব্যাপী যে তীব্র বিরোধিতার মুখে তা থেকে নিজেদের ক্ষমতা কোনো রকমে আঁকড়ে রাখার মরিয়া প্রচেষ্টা।

নিজ দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে তরুণদের অস্ত্র ধরতে বাধ্য করার মাধ্যমে জান্তা সরকার আরও অসন্তোষ ও বিভাজনের বীজ বুনে চলেছে। তাতে সামাজিক ফাটল আরও গভীর হচ্ছে এবং মিয়ানমার ভেঙে যাওয়ার হুমকি তৈরি করছে।

আজিম ইব্রাহিম যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক নিউলাইনস ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসির পরিচালক

আরব নিউজ থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত অনুবাদ