পুরো ঢাকা শহরটাকে বাজার বানিয়ে আমরা কী পাচ্ছি

প্রতিবছর রোজার মাস এলেই শহরজুড়ে এক অভিন্ন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। সেটা হলো ভ্রাম্যমাণ মানুষে শহর ভরে যাওয়া, এই ভ্রাম্যমাণ মানুষেরা এক মাসের জন্য ঢাকায় আসেন এবং নানা কাজ করে কিছু কামাই-রোজগার করে আবার ‘দ্যাশে’ ফিরে যান। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

চলতি বছরের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন; এবার রোজার বেশ আগে থেকেই এই মানুষের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। পাড়ায়-মহল্লায় যেভাবে ভ্রাম্যমাণ দোকানের সংখ্যা বেড়েছে, সেই পরিস্থিতি দেখে বোঝা যায়, এই মানুষের আগমন বেড়েছে।

মাঝে মাঝে বিস্ময় লাগে, এই যে সমাজে এত এত অনাচার ও অন্যায়-দুর্নীতির পরও মানুষ কেন নির্লিপ্ত। সেই প্রশ্নের একটা উত্তর হতে পারে এ রকম: গ্রামে কাজ না পেলে বেকারত্ব সমস্যার সহজ সমাধান হলো শহরে এসে রিকশা চালানো এবং পাড়ার রাজনীতিক ও বিভিন্ন বাহিনীকে টাকাপয়সা দিয়ে ভ্যান নিয়ে বসে যাওয়া।

যে যেভাবে পারছে সেভাবে একটা না একটা কিছু করে খাচ্ছে, বিনিময়ে ক্ষমতাবানদের কিছু বখরা দিলেই চলে। একশ্রেণির মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি ও সর্বোপরি মানুষের মধ্যে যে সর্বগ্রাসী ভোগের প্রবণতা শুরু হয়েছে, তাতে রাস্তার মোড়ে বা বাড়ির সামনে বসে সবজি বিক্রি করা বা রিকশার খ্যাপ পেতে তেমন কোনো সমস্যা হয় না। শহরের সমাজে এই মানুষেরা একভাবে এঁটে যাচ্ছে; একটু বুদ্ধিমান ও পরিশ্রমী হলে কামাই-রোজগারও মন্দ হয় না।

ঢাকার বিভিন্ন মহল্লায় গত কয়েক বছরে মাঠ সংস্কার করা হয়েছে। এসব মাঠ এখন রাতের বেলা আলোঝলমল হয়ে ওঠে; কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় এসব মাঠ এত অপ্রতুল যে সেখানে মানুষ গিজগিজ করে। সেই সঙ্গে আছে ভ্রাম্যমাণ ফুচকা, পেঁয়াজি বিক্রেতাদের দৌরাত্ম্য। সেখানে যে স্বস্তিমতো দুদণ্ড মানুষ বসতে পারে, সেই উপায় নেই। ধানমন্ডি লেকের যে অংশ বছর খানিক আগেও কিছুটা নিরিবিলি ছিল, সেখানেও এখন এই হকারদের দৌরাত্ম্য। শুধু ঢাকা নয়, দেশের সবখানেই এখন প্রায় একই চিত্র। বিনোদনের একমাত্র উপায় যেন বাইরে খাওয়া। এগুলো সবই একসূত্রে গাঁথা যায়-বেকারত্ব সমস্যার সহজ সমাধান; এবং বিনিময়ে বাহিনী ও পাড়ার ষন্ডা পাণ্ডাদের পকেট ভারী হওয়া।

কিন্তু পরিণামে যা হচ্ছে তা হলো পুরো শহরটাই এখন একরকম বাজারে পরিণত হয়েছে। মূল সড়কে তো দূরের কথা, এখন রাজধানীর পাড়া-মহল্লায়ও শান্তিমতো হাঁটা যায় না। যেকোনো সময় আপনার গায়ের ওপর রিকশা বা গাড়ি উঠে যেতে পারে। শহরের রাস্তাঘাট থেকে নিয়মশৃঙ্খলা যে একরকম উঠেই গেছে, তার কারণও এটা। যাঁরা রিকশা চালাতে আসছেন, তাঁদের ট্রাফিক আইন সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা নেই।

ফলে ঢাকার রাস্তায় এখন রিকশায় চলাচল করা আতঙ্কের বিষয়ে পরিণত হয়েছে; স্কুল থেকে ছেলেকে আনতে গিয়ে প্রায়ই ছোটখাটো দুর্ঘটনার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। এমনও দেখেছি, রিকশা ঠিকমতো চালাতে পারে না, এমন মানুষকেও খোদ রাজধানীর মতো জায়গায় রিকশা ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এসব যেন দেখার কেউ নেই।

আরও পড়ুন
বিষয়টি হলো শ্রমিক ও স্বল্প বেতনের কর্মচারীরা উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে আধপেটা খেয়ে ঘুমাবে বা গরমের কারণে রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারবে না, এই বাস্তবতায় আমরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতা করতে পারব না। সে জন্য এই মানুষের জীবনমান উন্নয়নে বরাদ্দ বাড়াতে হবে; সামাজিক নিরাপত্তা জাল আরও সম্প্রসারিত করতে হবে। মানুষকে স্বস্তি দিতে হবে।    

পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে একসময় ঢাকা নগরের যেসব সড়কে রিকশা চলত না, সেখানে এখন রিকশা চলছে। এমনকি রাজধানীর অন্যতম পাঁচ তারকা হোটেল সোনারগাঁও প্যান প্যাসিফিকের সামনে রীতিমতো রিকশার স্ট্যান্ড গড়ে উঠেছে। একদিন দেখলাম, কারওয়ান বাজার পেট্রোবাংলার সামনে এক সিএনজি অটোরিকশা রিকশাকে ধাক্কা দেওয়ায় রিকশাচালক অটোচালকের ওপর চড়াও হয়েছেন। পাঁচ তারকা হোটেলের সামনে এই দৃশ্য বিদেশিদের চোখে আমাদের ভাবমূর্তি কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, তা কি ভেবে দেখা হচ্ছে।

শহরের রাস্তায় হকার ও রিকশার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার একটি কারণ হতে পারে এই যে দেশে দারিদ্র্য পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এক বছর ধরে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের ওপরে। এটা সরকারি পরিসংখ্যান; বাস্তবে মূল্যস্ফীতির হার এর চেয়েও বেশি হবে সেটাই স্বাভাবিক। এত দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকলে মানুষের জীবনমানের অবনতি অবধারিত।

বাস্তবতা হলো, দীর্ঘদিন উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে যাঁরা একসময় কোনোভাবে দারিদ্র্যসীমার‍ ওপরে নাক ভাসিয়ে থাকতেন, তাঁদের অনেকে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছেন। এই সংকট মোকাবিলায় আগের চেয়ে বেশি খাটতে হচ্ছে বা যাঁরা এত দিন গ্রামে কিছু না করতেন, তাঁদেরও শহরে আসতে হচ্ছে। আবার যাঁরা শহরে থাকছেন, তাঁদের আরও বেশি পরিশ্রম করতে হচ্ছে বা যাঁরা আগে সব সময় কাজ করতেন না, তাঁদের আগের চেয়ে বেশি কাজ করতে হচ্ছে।

গত বছর মার্চ মাসে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সানেমের এক জরিপে জানা যায়, তার আগের ছয় মাসে দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের জীবিকার ব্যয় বেড়েছে ১৩ শতাংশ; কিন্তু সে অনুযায়ী তাঁদের আয় বাড়েনি, বরং কমেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে এক বেলা না খেয়ে থাকতে হচ্ছে বলে জানিয়েছিল নিম্ন আয়ের ৩৭ শতাংশ পরিবার। জরিপ থেকে আরও জানা যায়, প্রয়োজনের তুলনায় খাবার কম খাচ্ছেন বলে মনে করছিল ৭১ শতাংশ পরিবার। এখন গত ১১ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ঘরে; এই পরিস্থিতিতে নিম্ন আয়ের মানুষের কী অবস্থা, তা সহজেই অনুমেয়।

তার আগে সানেমের আরেক গবেষণায় বলা হয়েছিল, শহরের প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলো গড়ে তাদের মোট খরচের ৬১ দশমিক ৩১ শতাংশ খাদ্যের পেছনে ব্যয় করে আর গ্রামীণ প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলো করে ৬৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ। বিবিএস এ ক্ষেত্রে যে হিসাব দেয়, তার তুলনায় এ হার অনেক বেশি। বিবিএসের হিসাবে শহর ও গ্রামের পরিবার তাদের মোট খরচের যথাক্রমে ৪৫ দশমিক ১৭ শতাংশ ও ৫৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ খাদ্যের পেছনে ব্যয় করে। ফলে মূল্যস্ফীতির হার বাড়লে এই মানুষেরা কী ধরনের বিপদে পড়েন, তা বলা বাহুল্য।  

এটা ঠিক, গ্রামাঞ্চলে অকৃষি খাতের বিকাশ হচ্ছে; কিন্তু এখনো তা এমন পর্যায়ে যেতে পারেনি যে গ্রামের মানুষের শহরে আসার প্রবণতা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমতে পারে। ফলে মূলোৎপাটিত এই হতভাগ্য মানুষদের ঠাঁই হচ্ছে শহরের বস্তিতে। উদয়াস্ত পরিশ্রম করে বস্তির নোংরা স্যাঁতসেঁতে ঘরে ফিরতে হয় তাঁদের। গরম ও বৃষ্টির সময় এই মানুষের কষ্টের সীমা থাকে না। হাতিরঝিলসংলগ্ন বেগুনবাড়ির বস্তির মানুষদের দেখেছি, গরমের সময় অনেক রাত পর্যন্ত হাতিরঝিলের ফুটপাতে সময় কাটাতে; রাত গভীর হলে যখন গরম ভাব কিছুটা কাটে, তখনই তাঁরা ঘরে ফেরেন।

এই মানুষেরা শহরে আসছেন, নানা ধরনের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করছেন, এর মধ্য দিয়ে জিডিপির চাকা ঘুরছে ঠিক। অনেকে দারিদ্র্যের কাতার থেকে বেরিয়ে আসছেন; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, জীবনমানের বিশেষ উন্নতি হচ্ছে না। নিয়মকানুন না মেনে যত্রতত্র কারখানা গড়ে উঠছে; সেই কারখানার বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ ও প্রতিবেশ। সেই দূষিত পরিবেশেই থাকতে হচ্ছে তাঁদের এবং সামগ্রিকভাবে শহরের বাসযোগ্যতা বিনষ্ট হচ্ছে। এসব বিষয়ে সরকারের নজর নেই বললেই চলে; সরকার কেবল পরিসংখ্যান দেখাতে পাররেই খুশি।  

উন্নয়নশীল দেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের আকার বড় থাকে, এটাই স্বাভাবিক। আমরা স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি; তখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আমরা অনেক অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা হারাব। প্রতিযোগিতা করতে হবে। সেই সঙ্গে হচ্ছে অটোমেশন। এই পরিস্থিতিতে প্রতিযোগিতা করতে হলে শ্রমিকের ও সামগ্রিকভাবে উৎপাদন ব্যবস্থার দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। আমাদের শিক্ষার মান বাড়াতে হবে; বিনিয়োগ বাড়াতে হবে স্বাস্থ্য খাতে।

বিষয়টি হলো শ্রমিক ও স্বল্প বেতনের কর্মচারীরা উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে আধপেটা খেয়ে ঘুমাবে বা গরমের কারণে রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারবে না, এই বাস্তবতায় আমরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতা করতে পারব না। সে জন্য এই মানুষের জীবনমান উন্নয়নে বরাদ্দ বাড়াতে হবে; সামাজিক নিরাপত্তা জাল আরও সম্প্রসারিত করতে হবে। মানুষকে স্বস্তি দিতে হবে।    

  • প্রতীক বর্ধন প্রথম আলোর জেষ্ঠ্য সহসম্পাদক