একটি টি-শার্ট তৈরিতে ৪১০০ লিটার, এক জোড়া জুতায় ৮০০০ লিটার পানি খরচ হয়

গত দুই দশকে মাথাপিছু মিষ্টি পানির প্রাপ্যতা কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ।
ছবি : প্রথম আলো

পানি যেকোনো প্রাণী ও উদ্ভিদকোষের জন্য একটি প্রধান উপাদান। পানি ছাড়া পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব কল্পনা করা অসম্ভব। তাই পৃথিবীর প্রায় সব জীবের জীবনধারণের জন্যই পানি অত্যাবশ্যক পদার্থ। প্রতিবছর জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ১৬ অক্টোবর বিশ্ব খাদ্য দিবস পালন করে থাকে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘পানি জীবন, পানি খাদ্য, কাউকে পেছনে ফেলে নয়’।

বিশ্বব্যাপী কৃষি পানি ব্যবহারকারীদের মধ্যে বৃহত্তম অংশীজন, আর পানির প্রাপ্যতা শস্যের ফলন ও খাদ্য উৎপাদনকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে। দক্ষ সেচব্যবস্থাপনা ও পর্যাপ্ত পানিসম্পদের সরবরাহের মাধ্যমে কৃষি দেশের জনগণের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করে। যদিও পৃথিবীর অনেক অংশেই পানির অভাব আছে। অদক্ষ পানি ব্যবস্থাপনার কারণে  খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়। জলবায়ু পরিবর্তন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং ভূগর্ভস্থ পানির অপরিমিত উত্তোলনে পানির সংকট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
খাদ্য উৎপাদন গতিশীল রাখতে পানিসম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা অপরিহার্য। আধুনিক ও দক্ষ সেচব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পানিসম্পদের উপযুক্ত ব্যবহার এবং কম পানির চাহিদাসম্পন্ন ফসলের জাত চাষাবাদের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর সম্ভব।  

ভূপৃষ্ঠের ৭০ দশমিক ৯ শতাংশ জুড়ে পানির অস্তিত্ব রয়েছে। প্রাপ্ত এই পানির ৯৬ দশমিক ৫ শতাংশ পাওয়া যায় মহাসাগরে, ১ দশমিক ৭ শতাংশ ভূগর্ভে, ১ দশমিক ৭ শতাংশ হিমশৈল ও তুষার হিসেবে। আর একটি ক্ষুদ্র অংশ অন্যান্য বড় জলাশয়ে এবং শূন্য দশমিক .০০১ শতাংশ বায়ুমণ্ডলে রয়েছে; যা মেঘ, জলীয় বাষ্প, বৃষ্টি, তুষারপাত ইত্যাদি রূপে বিদ্যমান। যদিও ভূপৃষ্ঠের চার ভাগের তিন ভাগ পানি তার বেশির ভাগই (৭১ শতাংশ) হচ্ছে লবণাক্ত। মাত্র ৩ শতাংশ হচ্ছে মিষ্টি পানি, যা আবার সম্পূর্ণভাবে ব্যবহার করা যায় না। এই ব্যবহারযোগ্য মিষ্টি পানি বিভিন্ন সেক্টর, যেমন কৃষি, শিল্প ও গৃহস্থালি কাজে সমভাবে ব্যবহৃত হয় না। কৃষি সেক্টরে সবচেয়ে বেশি প্রায় ৭২ শতাংশ পানি ব্যবহার হয়ে থাকে, যা শিল্পে ১২ শতাংশ এবং গৃহস্থালিতে ১৬ শতাংশ।

একটি সুতার টি-শার্ট তৈরি করতে ৪১০০ লিটার পানি খরচ হয়, এক জোড়া জুতা তৈরিতে ৮ হাজার লিটার পানি ব্যবহার হয়, ১৫০ গ্রামের একটি হ্যামবার্গার তৈরি করতে ২ হাজার ৪০০ লিটার পানি খরচ হয়। বিভিন্ন পর্যায়ে পানির অপচয় কমাতে পারলে সবার জন্য পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত হবে।

সাধারণত এক ক্যালরি খাদ্যকে সেচের আওতায় আনতে এক লিটার পানি প্রয়োজন। এ ছাড়া বিশ্বে গড়ে ১ কেজি ধান, গম, ভুট্টা, সয়াবিন, বার্লি, সরগাম, মিলেট, কফি, চা, বিফ, পর্ক, মাটন, চিকেন উৎপাদন করতে যথাক্রমে ২২৯০, ১৩৩৪, ৯১০, ১৭৯০, ১৩৯০, ২৮৫০, ৪৬০০, ১৭৩৭০, ৯২০০, ১৫৪০০, ৪৮০০, ৪০০০, ৩৯০০ লিটার পানির প্রয়োজন হয়। কৃষিকাজের জন্য মূলত ভূ–উপরিস্থ (নদী, হ্রদ, জলাশয়) এবং ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। কম বৃষ্টিসম্পন্ন অঞ্চলে প্রধানত ভূগর্ভস্থ পানিই সেচকাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। গত ৭০ থেকে ৮০ বছরে কূপ খনন করে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের ফলে বিশ্বে লাখ লাখ মানুষ দারিদ্র্য ও ক্ষুধার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।

কিন্তু এই মিষ্টি পানির প্রাপ্যতা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নগরায়ণ, বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং ক্রমাগত খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য মূল্যবান পানিসম্পদের মজুত কমে যাচ্ছে। পানিসম্পদ কমে যাওয়ার কারণে বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় রয়েছে প্রান্তিক কৃষক, নারী, আদিবাসী ও শরণার্থী জনগোষ্ঠী। বিশ্বের প্রায় ১ দশমিক ১ বিলিয়ন মানুষ নিরাপদ পানি ব্যবহার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং প্রায় ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন মানুষ বছরে এক মাস ব্যবহারযোগ্য পানির সংকটে ভুগছে। গত দুই দশকে মাথাপিছু মিষ্টি পানির প্রাপ্যতা কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ।

আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০৫০ সাল নাগাদ প্রায় ৮০ ভাগ কৃষিজমি সেচের পানির সমস্যায় পড়বে। গবেষণায় দেখা গেছে, দক্ষিণ এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার মোট চাষযোগ্য জমির যথাক্রমে প্রায় ৪৬, ৩২, ৪৪, ৪৯, ২৪ এবং ২৫ শতাংশ জমিতে পানির অভাবে চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। পানির অপ্রাপ্যতার কারণে বিশ্বে খাদ্য উৎপাদন কমে যেতে পারে। ফসল চাষাবাদে পর্যাপ্ত সেচ দিতে পারলে প্রায় ৪০০ গুণ বেশি খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব।

২০৫০ সাল নাগাদ সুপেয় পানির চাহিদা প্রায় ৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে এবং ২০৫০ সালে বর্ধিত ৯ বিলিয়ন জনসংখ্যার জন্য প্রায় ৭০ শতাংশ বেশি খাবার উৎপাদন করতে হবে। তাই কম পানি ব্যবহার করে কীভাবে বেশি খাদ্য উৎপাদন করা যায়, সেই বিষয়ে গবেষণা জোরদার করতে হবে। আমরা আমাদের দৈনন্দিন কাজে, কৃষিতে, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণে, বিভিন্ন সামগ্রী তৈরিতে প্রচুর পানির অপচয় করে থাকি।

একটি সুতার টি-শার্ট তৈরি করতে ৪১০০ লিটার পানি খরচ হয়, এক জোড়া জুতা তৈরিতে ৮ হাজার লিটার পানি ব্যবহার হয়, ১৫০ গ্রামের একটি হ্যামবার্গার তৈরি করতে ২ হাজার ৪০০ লিটার পানি খরচ হয়। বিভিন্ন পর্যায়ে পানির অপচয় কমাতে পারলে সবার জন্য পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত হবে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যবহারযোগ্য পানির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত কলকারখানা ও পয়ঃপ্রণালির আবর্জনা পুকুর, খাল, জলাশয়, হ্রদ ও নদীতে মিশে পানিকে দূষিত করছে।

একক প্রচেষ্টার মাধ্যমে পানি-সংকট দূর করা সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন দক্ষ ও সমন্বিত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা। যত দূর সম্ভব, পরিত্যক্ত ও ভরাট হওয়া পুকুর, খাল-বিল, নদী, জলাশয় ইত্যাদি খনন করতে হবে, যার মাধ্যমে মিষ্টি পানির মজুত বাড়ানো সম্ভব হবে। কেবল পানির দক্ষ ব্যবস্থাপনাই পানির অপ্রয়োজনীয় অপচয় কমাতে পারে, যেটা শস্যের উৎপাদন অব্যাহত রাখবে এবং আমাদের পুষ্টিসমৃদ্ধ ও উন্নত জীবন দেবে।

সবার জন্য পানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য, সবার ন্যায়সংগত পানির ব্যবহার নিশ্চিত করা, টেকসই কৃষির অনুশীলন করা এবং যথাযথ পানিনীতি অনুসরণ করা সময়ের দাবি। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা, নাগরিক সমাজ, গবেষণাপ্রতিষ্ঠান এবং রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের সম্পৃক্ততার মাধ্যমে পানি-সংকট দূর করা সম্ভব হবে এবং টেকসই খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।

  • ড. প্রিয় লাল চন্দ্র পাল, জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ব্রি গাজীপুর।