চীনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) ২০তম ন্যাশনাল কংগ্রেসে সি চিন পিং নজিরবিহীনভাবে তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি এখন তাঁর রাজনৈতিক দলকে আরও শক্তপোক্ত করায় মন দিয়েছেন এবং চীনা সমাজের ওপর সিপিসির নিয়ন্ত্রণ জোরদার করছেন। এখন প্রশ্ন হলো, এই পরিবেশ-প্রতিবেশে সফল অর্থনৈতিক উন্নয়ন কি চলতে পারে?
আমি অনেক মাস ধরে ভাবছি, একদিন ঘুম থেকে উঠে খবরের কাগজে পড়ব: চীন তার জিরো কোভিড কৌশল পুনর্বিবেচনা করছে, অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিমালিকানাধীন পর্যায়ের ব্যবসার সঙ্গে সিপিসির লেনদেননীতি সংশোধন করছে, দেশটির আবাসিক পারমিট পদ্ধতির সত্যিকারের সংস্কার করছে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) সাম্প্রতিক কৌশলগত অবস্থান পুনর্বিবেচনা করছে।
এটি একটি দীর্ঘ অপেক্ষার প্রমাণ দিচ্ছে। কয়েক মাস আগে চীনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে একটি বৈঠকে আমি ঠাট্টা করে বলেছিলাম, চীন সম্পর্কে আমার ৩০ বছরের বেশি সময়কার জানাশোনায় হয়তো অনেক ঘাটতি আছে, কারণ আমি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটির গৃহীত কিছু নীতির কিছুই বুঝতে পারিনি।
এর কারণ হিসেবে আমি এই যুক্তি দাঁড় করাই যে নিশ্চয়ই এসব নীতি সিপিসির উচ্চস্তরের দলগুলোর মধ্যে থাকা উপদলগুলোকে নিরপেক্ষ রাখার কৌশলগত অংশ। নতুন নেতৃত্বে সি চিন পিংকে কারা বেছে নিলেন এবং কারা তাঁর নতুন নেতৃত্বের বিরোধিতা করলেন, তার কিছুই আমরা জানতে পারিনি। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীনের জোট ব্রিকস নিয়ে আমি এবং আমার তৎকালীন সহকর্মীরা এক যুগ আগে একটি বিশ্লেষণে দেখিয়েছিলাম ২০২১ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে ব্রিকসের অর্থনীতি জি-৭ জোটের অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। এর ফলে এক নতুন বিশ্বব্যবস্থার সূচনা হতে পারে।
ধরে নেওয়া হয়েছিল, ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাব্য উৎপাদনশীলতার হার অর্জন করবে। চীনের প্রবৃদ্ধি ৪.৫ থেকে ৫ শতাংশে উন্নীত হবে। কিন্তু চীনের গত তিন বছরের অর্থনৈতিক গতি দেখে মনে হচ্ছে সেই অর্জনের বাস্তব অবস্থা থেকে তারা অনেকটাই ছিটকে পড়েছে। এটি বোঝার যুক্তিসংগত উপায় হলো চীনের কোভিড নীতি। চীনা নেতাদের আশঙ্কা, জিরো কোভিড নীতিকে ত্যাগ করা স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ওলট–পালট করে দেবে। এতে মৃত্যুহার বাড়বে। তবে এই নীতিটি ২০৩৫ সালের জন্য ঠিক করা লক্ষ্য অর্জনের পথের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে অসংগতিপূর্ণ।
উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হার সাম্প্রতিক সময়ে কমে আসায় চীনের জন্য সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। কারণ, বিশ্বব্যাপী জিডিপিতে ইতিমধ্যেই চীনের অংশ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। আগামী বছরগুলোতে সি চিন পিং যদি এনবিইআরের প্রতিবেদনকে হৃদয়ে ধারণ করেন, শুধু তাহলেই কেবল আশা করা যায়, সি তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবেন।
এটা পরিষ্কার যে চীন তার লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে শুধু তখনই, যখন চীনা ভোক্তারা দেশের প্রবৃদ্ধির মডেলের কেন্দ্রীয় অংশ হয়ে উঠতে পারবেন। চীনের দীর্ঘ মেয়াদে লকডাউন চালিয়ে যাওয়া এটিকে কার্যত অসম্ভব করে তুলেছে। অবশ্যই চীনে সেরা পশ্চিমা ভ্যাকসিন আমদানি করার এবং তাদের কোভিড মোকাবিলা করার পন্থায় পরিবর্তন আনা জরুরি হয়ে পড়েছে। এটি করা হলে অনেক সুবিধা মিলবে। সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এর মধ্য দিয়ে বাকি বিশ্বের কাছে একটি শক্তিশালী বার্তা যাবে যে চীন আবার উন্মুক্ত হতে চায়।
এ ধরনের একটি পরিবেশ তৈরি হলে চীন এবং পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যকার বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংযোগহীনতা কেটে যাবে। সেই সঙ্গে জি–২০, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের মতো বেশির ভাগ বৈশ্বিক সংস্থার সঙ্গে চীনের যে ঝামেলা চলছে, তা কেটে যাবে।
চলতি মাসে ইউএস ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ (এনবিইআর) ‘দ্য ফিউচার অব গ্লোবাল ইকোনমিক পাওয়ার’ শীর্ষক একটি সমীক্ষা প্রকাশ করেছে, যা ২১০০ দশকের ওপর আলোকপাত করেছে।
আমাদের সংস্থা ব্রিকস অ্যানালাইসিসের সুরে সুর মিলিয়ে তারাও বলেছে, এই শতাব্দীর শেষে চীন হবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ এবং ভারত দ্বিতীয় অবস্থানে থাকবে।
কিন্তু উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হার সাম্প্রতিক সময়ে কমে আসায় চীনের জন্য সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। কারণ, বিশ্বব্যাপী জিডিপিতে ইতিমধ্যেই চীনের অংশ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। আগামী বছরগুলোতে সি চিন পিং যদি এনবিইআরের প্রতিবেদনকে হৃদয়ে ধারণ করেন, শুধু তাহলেই কেবল আশা করা যায়, সি তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবেন।
ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জিম ও’নিল যুক্তরাজ্য সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী