তফসিল অনুযায়ী ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু নির্বাচনটি কেমন হবে, ভোটারদের উপস্থিতি কেমন থাকবে, কোন আসনে কার সঙ্গে কার প্রতিযোগিতা হবে ইত্যাদি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা চলছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু আসনে ‘অঘটনের’ খবর পাওয়া যাচ্ছে।
নৌকা প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল হওয়ায় দলের মনোনয়নবঞ্চিত ও ‘কিংস পার্টির’ কয়েকজন নেতার কপাল খুলছে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে। তবে সবকিছু চূড়ান্ত হবে ১৭ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের পর।
নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত ৪৪টি দলের মধ্যে ২৯টি দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। বাকি ১৫টি দল তফসিল প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এর বাইরেও অনেক দল আন্দোলনে আছে। শোনা যাচ্ছে, ৬০টি দল এক মঞ্চে এসে আন্দোলনের অভিন্ন কর্মসূচি নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
একই সঙ্গে নির্বাচনী ‘উৎসব’ ও হরতাল-অবরোধের আন্দোলন—এটা বাংলাদেশেই সম্ভব। একপক্ষ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আরেক পক্ষ আন্দোলন জোরদার করার কথা বলছে। তাহলে সাধারণ মানুষ, শ্রমজীবী মানুষ, যঁাদের জীবিকার জন্য প্রতিদিনই ঘরের বাইরে যেতে হয়, তঁারা কী করবেন? যঁারা ভোট করছেন, তঁারা যেমন জনগণের দোহাই দিচ্ছেন, আবার যঁারা আন্দোলন করছেন, তঁারাও। এই দুই পক্ষের লড়াইয়ের জাঁতাকলে জনগণ ও অর্থনীতি পিষ্ট।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলছেন। তবে সবচেয়ে দামি কথাটি বলেছেন সম্ভবত নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আলমগীর। মঙ্গলবার ময়মনসিংহ জেলার নির্বাচনসংক্রান্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের ওপর বিদেশিদের চাপ একেবারেই নেই।
তঁারা এসে আমাদের কাছে যেটা জানতে চান, সেটা হচ্ছে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে আমরা কী কী কাজ করেছি।...বরং সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনই সবাইকে চাপ দিয়ে বেড়াচ্ছে।
নির্বাচন কমিশন কোথায় কাকে চাপ দিচ্ছে, এখনো কেউ টের পাচ্ছে না। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী দল বা প্রার্থীরা নির্বাচন কমিশনের আদেশ–নির্দেশ কিংবা আচরণবিধি খুব একটা আমলে নিচ্ছেন বলে মনে হয় না।
তফসিল ঘোষণার আগে ইসি দফায় দফায় বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের সঙ্গে বৈঠক করেছিল। সেসব বৈঠকে প্রায় সবাই একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ওপরই জোর দিয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন বলেছে, রাজনৈতিক মতৈক্য প্রতিষ্ঠা করা তাদের দায়িত্ব নয়। সংবিধান তাদের ওপর যে দায়িত্ব দিয়েছে, সেটা তারা করবে। এর বাইরে কিছু নয়।
তফসিল ঘোষণার মাধ্যমে ইসি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দায় থেকে নিজেকে অব্যাহতি দিয়েছে। সংবিধানে আছে, ‘নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনের জন্য যেরূপ কর্মচারীর প্রয়োজন হইবে, নির্বাচন কমিশন অনুরোধ করিলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনকে সেই রূপ কর্মচারী প্রদানের ব্যবস্থা করিবেন।’ অথচ এখন নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ডে মনে হয় সরকারের নির্বাহী বিভাগ ‘যেরূপ’ নির্বাচন চাইছে, সেটাই তারা করার সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছে।
প্রথমে কমিশন বলল, সরকারি কর্মকর্তাদের বদলি করা যাবে না। করলে জনপ্রশাসনে অসন্তোষ দেখা দেবে। এরপর বলল, না, আমরা সব ইউএনও ও ওসিকে বদলি করব। কিন্তু প্রশাসন ও পুলিশের ওপর মহল থেকে আপত্তি এলে ইসি ধীরে চলো নীতি অনুসরণ করে। একটি পত্রিকা খবর দিয়েছে, ওসিদের বদলি নিয়ে তদবির–বাণিজ্য শুরু হয়েছে। যাঁরা আগে তদবির করে এসেছেন, তঁারা চিন্তায় আছেন। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সবচেয়ে জরুরি ছিল সব দলকে নির্বাচনে নিয়ে এসে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি করা। সেটি তারা করতে পারেনি। এখন তারা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার নির্বাচন করছে।
নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হয়েছে, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আগে নির্বাচনী প্রচার চালানো যাবে না। কিন্তু প্রার্থীরা হরদম প্রচার চালাচ্ছেন। পত্রিকায় দেখা গেল, ঝালকাঠি জেলার কাঁঠালিয়ায় নৌকা প্রার্থীর প্রচারসভায় তাঁর এক অনুসারী বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে আছেন।
পরে জানা গেল, ওই বন্দুকটি প্রার্থীর এবং যিনি দাঁড়িয়েছিলেন তিনি স্থানীয় বিএনপির নেতা। একই নির্বাচনী সভায় তিনি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের একত্র করে অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন। সারা দেশে যদি আওয়ামী লীগ, বিএনপি নেতা-কর্মীদের এ রকম ‘মধুচন্দ্রিমা’ হতো, তাহলে নির্বাচন নিয়ে লাঠালাঠির প্রয়োজন হতো না।
সোমবার সন্ধ্যায় ঝালকাঠি-১ আসনে নির্বাচন কমিশনের গঠন করা অনুসন্ধান কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারক সিনিয়র সহকারী জজ পল্লবেশ কুমার কুণ্ডু এই প্রার্থীকে কারণ দর্শানোর আদেশ দেন। ইসি জানায়, আপনি (শাহজাহান ওমর) নির্বাচনী এলাকায় সমাবেশে যোগদান করেন এবং বক্তব্য দেন। এ সময় আপনার পাশে বন্দুক হাতে একজনকে বসে থাকতে দেখা যায়। যা রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণবিধিমালা ২০০৮–এর অধীনে ৬ (ক) (গ) ও বিধি ১২ লঙ্ঘনের শামিল। তঁার বিরুদ্ধে কেন আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণসহ নির্বাচন কমিশনে রিপোর্ট পাঠানো হবে না, সে মর্মে বুধবারের মধ্যে শোকজের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
পরদিনই শাহজাহান ওমর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে নির্বাচন কমিশনে আসেন। তিনি জানেন কোথায় গেলে কাজ হবে।
সহকর্মী আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোয় জাতীয় পার্টির ‘সাবালকত্ব’ নিয়ে একটি রিপোর্ট করেছেন। সেই রিপোর্টে দেখলাম, জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক বলেছেন, জাতীয় পার্টি এত দিনে সাবালক হয়েছে। এবার সাহস করে এককভাবে নির্বাচন করছে। অর্থাৎ ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দল থেকে এবারে তারা ‘সত্যিকার’ বিরোধী দল হতে চাইছে। আবার ভয়ও আছে।
আওয়ামী লীগ যদি ছাড় না দেয়, আসন ধরে রাখা কঠিন হবে। বর্তমান সংসদে জাতীয় পার্টির আসনসংখ্যা ২৩। এরশাদের পর জাতীয় পার্টির দুই প্রধান নেতা রওশন এরশাদ ও জি এম কাদের। অনুসারীদের জন্য আসন বরাদ্দ না পেয়ে রওশন নির্বাচন বর্জন করেছেন। তিনি নির্বাচন বর্জন করে নিশ্চুপ আর জি এম কাদের নির্বাচনে অংশ নিয়েও নিশ্চুপ। মহাসচিব একটাই ব্যাটিং করে যাচ্ছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জাতীয় পার্টির চেয়েও খারাপ অবস্থায় আছে ১৪–দলীয় জোটের শরিকেরা। যদিও এই জোট গঠনের সময়ে বলা হয়েছিল, তারা একসঙ্গে আন্দোলন, নির্বাচন ও সরকার গঠন করবেন। ১৪ দলের অনেক শরিক জোট ছেড়েছে। আবার নতুন করে কেউ কেউ যুক্ত হয়েছে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রথমে বলেছিলেন, আমরা জোটের প্রয়োজন দেখছি না। জোট শরিকেরা তাঁর কথার প্রতিবাদ করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ১৪ দলের শীর্ষ নেতাদের বৈঠক হয়। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত, জোটগতভাবেই তঁারা নির্বাচন করবেন।
বর্তমান সংসদে তাঁদের আসনসংখ্যা ৮। নৌকা ধার নিয়েও সেটি ধরে রাখতে পারবেন কি না সন্দেহ। আগের নির্বাচনগুলোতে নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিল না। এবারে নৌকার বিপরীতে আওয়ামী লীগ থেকেই অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
৭ জানুয়ারির নির্বাচনে জোটের জট খুললেও দেশে যে রাজনৈতিক সংকট চলছে, তার অবসান হবে না।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
ই–মেইল: [email protected]