এরশাদের মতো জিএম কাদেরকে নিয়েও কি ‘খেলা’ হচ্ছে

হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ও জিএম কাদের

ক্ষমতা দখলের ৯ বছর পর ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে গণ-অভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি ও স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। কিন্তু দেশের বড় দুই দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির সুবিধাবাদিতা ও নীতিহীনতার কারণে তিনি দ্রুতই রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হন। আজ থেকে ১৬ বছরের বেশি সময় আগে ‘এরশাদ: বিচারব্যবস্থার প্রশ্নচিহ্ন’ শিরোনামে প্রয়াত সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান লিখেছিলেন, ‘...দুই শাসক দল যখন যেভাবে এরশাদকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে চেয়েছে, তারা যেন সফলকাম হয়েছে। আইনের নিজস্ব গতি তাদের রাজনৈতিক গতিরোধ করেনি। তবে এরশাদ-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মামলার বিভিন্ন প্রক্রিয়া বিশ্লেষণে বলা চলে, একজন এরশাদকে ঘিরে যে নির্বাহী, আইনসভা ও বিচার বিভাগীয় উপাখ্যান তৈরি হলো, তা অনেক স্বৈরশাসকের জন্য ঈর্ষণীয় ঠেকতে পারে…. ’ (প্রথম আলো, ৯ আগস্ট ২০০৬)।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—দুটি দলই বিভিন্ন সময়ে এরশাদকে নানা সুবিধা দিয়ে তাঁর সমর্থন পেতে চেয়েছে এবং একই কারণে তাঁকে নিয়ন্ত্রণেও রাখতে চেয়েছিল। এরশাদ ও জাতীয় পার্টিকে (জাপা) নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে বড় ‘হাতিয়ার’ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলো। এরশাদের পতনের পর বিভিন্ন অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে মোট ৪৩টি মামলা হয়। তার মধ্যে কয়েকটি মামলায় তিনি নিম্ন আদালত থেকে বেকসুর খালাস পান। কয়েকটি মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। তিনটি মামলায় নিম্ন আদালতে তাঁর সাজার আদেশ হলেও হাইকোর্ট থেকে একটিতে খালাস পান। বাকি দুই মামলায় তিনি সাজা খাটেন।

জীবনের শেষ দিকে এরশাদের গলার কাঁটা হয়েই ছিল মঞ্জুর হত্যা মামলা। জোট আর ভোটের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির সমর্থন পেতে মামলাটির বিশেষ ভূমিকা ছিল বলে অনেকেই মনে করেন। মামলার কথা বিবেচনায় রেখে এরশাদ নিজে এবং জাতীয় পার্টি ‘স্বাধীনভাবে’ রাজনীতি করতে পারেননি বলেও দলটির নেতারা বিভিন্ন সময় আক্ষেপ করেছেন।

২০১৯ সালের ১৪ জুলাই এরশাদ মারা গেছেন। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে এখন দায়িত্ব পালন করছেন তাঁর ছোট ভাই জিএম কাদের। কিন্তু জাতীয় পার্টি এখনো ‘স্বাধীনভাবে’ রাজনীতি করতে পারছে না এবং এই না করতে পারার অন্যতম কারণ, আবারও সেই মামলা। তবে এই মামলা দুর্নীতি বা হত্যার অভিযোগে নয়, মামলা হয়েছে তাঁর দলীয় পদ-পদবি নিয়ে। মিজানুর রহমান খানের লেখার অনুকরণে বলতে হচ্ছে, জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলো নিয়ে আদালতের ভূমিকাও বিরাট এক ‘প্রশ্নচিহ্ন’ তৈরি করেছে।

একটা দল কীভাবে চলবে বা কী সিদ্ধান্ত নেবে তা ঠিক হবে দলটির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী। কোনো দলের গঠনতন্ত্র যদি ‘অগণতান্ত্রিক’ বলে প্রতীয়মান হয় কিংবা দলটির চেয়ারম্যানকে অবাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে, সে ক্ষেত্রেও গঠনতন্ত্রে বর্ণিত নিয়ম অনুসরণ করেই সেটা পরিবর্তন করতে হবে। এ ধরনের দলীয় বা সাংগঠনিক বিষয় মীমাংসা করার ‘এখতিয়ার’ আদালতের নেই।

গত মাসে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা করেন দলটির দুই সাবেক নেতা জিয়াউল হক এবং মসিউর রহমান (রাঙ্গা)। দুটি মামলাতেই জিএম কাদেরকে জাপার চেয়ারম্যান হিসেবে অবৈধ ঘোষণার ডিক্রি চেয়ে আবেদন করেন তাঁরা। জিয়াউল হকের করা মামলায় জিএম কাদেরের ওপর দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেন ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ মাসুদুল হক। মসিউর রহমানের করা মামলাতেও দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে জিএম কাদেরের ওপর কেন নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে না, সে ব্যাপারে তাঁকে কারণ দর্শাতে বলেন একই আদালত। প্রথম মামলাটিতে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারির আদেশ প্রত্যাহার চেয়ে করা আবেদন ১৬ নভেম্বর খারিজ করে দেওয়া হয়।

জিএম কাদেরের ওপর আদালতের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক বলেন, ‘...তাঁর রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে বন্ধ রাখার বিষয়টি রাজনৈতিক। সংবিধান কথা বলার, রাজনৈতিক দল করার, নেতৃত্ব দেওয়ার যে অধিকার দিয়েছে, এই নিষেধাজ্ঞা সাংবিধানিক অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে যায়…’ (প্রথম আলো, ১৭ নভেম্বর ২০২২)।

জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে হওয়া মামলায় আদালত যে আদেশ দিয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটা খুবই সংগত। এ রকম দলীয় বা সাংগাঠনিক প্রশ্নের মীমাংসা আদালতে হতে পারে কি? একটা দল কীভাবে চলবে বা কী সিদ্ধান্ত নেবে তা ঠিক হবে দলটির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী। কোনো দলের গঠনতন্ত্র যদি ‘অগণতান্ত্রিক’ বলে প্রতীয়মান হয় কিংবা দলটির চেয়ারম্যানকে অবাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে, সে ক্ষেত্রেও গঠনতন্ত্রে বর্ণিত নিয়ম অনুসরণ করেই সেটা পরিবর্তন করতে হবে। এ ধরনের দলীয় বা সাংগঠনিক বিষয় মীমাংসা করার ‘এখতিয়ার’ আদালতের নেই।

মামলা ও আদালতের ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ ভূমিকার প্রেক্ষাপটে জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্র’ হচ্ছে বলে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা দাবি করেছেন। তিনি বলেন, মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা দিয়ে একটি রাজনৈতিক দলের নেতার কণ্ঠ রোধ করার অপচেষ্টা নজিরবিহীন (যুগান্তর অনলাইন, ২২ নভেম্বর ২০২২)। এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে রওশন এরশাদের পরিবর্তে জিএম কাদেরকে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা করার প্রস্তাবটির সুরাহা এখনো হয়নি। গত ১ সেপ্টেম্বর এ বিষয়ে লিখিত প্রস্তাব পাঠিয়েছিল জাপার সংসদীয় দল। প্রস্তাবটি প্রায় তিন মাসের মতো জাতীয় সংসদের স্পিকারের দপ্তরে ঝুলে আছে। এই ‘ঝুলিয়ে’ রাখাও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কি না, সেই প্রশ্নটাও জোরেশোরে সামনে এসেছে।

সামনে নির্বাচন। সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ বা জোট ও ভোটের প্রশ্নে জাতীয় পার্টির ভূমিকা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য ‘ভাগ্য নির্ধারণী’ বিষয় হতে পারে। নির্বাচন নিয়ে জিএম কাদের সম্প্রতি এমন কিছু কথাবার্তা বলেছেন যা সরকারের পছন্দ হয়নি বলেই স্বাভাবিকভাবে ধারণা করা যায়। এ কারণে জিএম কাদেরকে নিয়ে ‘খেলতে’ অর্থাৎ তাঁকে চাপে রাখতে সরকার নানারকম কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে—এমন ধারণা অমূলক নয়।

রাজনীতিতে কৌশল থাকবে, কূটকৌশলও থাকতে পারে, এগুলো খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু কৌশল করতে গিয়ে আদালতকে দলীয় বা রাজনৈতিক বিষয়ে জড়িয়ে ফেলা ভালো লক্ষণ নয়। কৌশল অর্থাৎ রাজনীতির খেলা খেলতে গিয়ে সরকার যদি আদালতের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, আদালত ও বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা আরও কমবে।

  • মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক