মায়ের অভিভাবকত্বের স্বীকৃতি: নারীর অধিকার আদায়ে বড় অর্জন

সেই মায়ের কথাই বলতে চাইছি, যে মা সন্তানকে জন্ম দিয়েছেন ১০ মাস ১০ দিন বা তার চেয়ে কম বা বেশি দিন গর্ভে ধারণ করে। সন্তান প্রসবের সময় মা যে ভয়াবহ যন্ত্রণা ভোগ করেন, তা অকল্পনীয়। কিন্তু এরপরও মায়েরা বারবার সন্তান ধারণ করেন, দীর্ঘ অনেক মাস বয়ে চলেন নিজের দেহের ভেতরে, নিজের খাবার সেই অনাগত শিশুর সঙ্গে ভাগ করে খান, কথা বলেন গর্ভস্থ সন্তানের সঙ্গে। এরপর একদিন পৃথিবীর আলো-বাতাসে তাকে নিয়ে আসেন।

অনেক ধাপ পার হয়ে একজন নারী মা হতে চান, সন্তানের মুখে ‘মা’ ডাকটা শুনতে চান, কোলেপিঠে সন্তানকে মানুষ করতে চান। কিন্তু মায়ের দুর্ভাগ্য যে তিনি যত কিছুই করুন না কেন, এই সমাজে মা সন্তানের ‘অভিভাবক’ নন। যেহেতু মায়ের গর্ভ থেকেই সন্তানের জন্ম, কাজেই মায়ের পরিচয়ই সন্তানের প্রথম পরিচয় হওয়া উচিত। কিন্তু তা হয়নি, এতগুলো বছরে বাংলাদেশের মায়েরা কোনো ক্ষেত্রেই সন্তানের অভিভাবক হিসেবে স্বীকৃতি পাননি। সব দায়দায়িত্ব পালন করার পরও শুধু মা-ই থেকে গেছেন, অভিভাবক হতে পারেননি।

স্বাধীনতার ৫১ বছর পর আদালতের একটি রায়ের মাধ্যমে মায়েরা, বিশেষ করে একক মায়েরা (সিঙ্গেল মাদার) নিজ পরিচয়ে সন্তানকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করাতে পারবেন। এ রায় ভুক্তভোগী মায়েদের জন্য কতটা স্বস্তিদায়ক হলো, তা শুধু তারাই অনুভব করতে পারবেন। তাদের জন্য সামাজিক এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করাটা খুব কষ্টকর ছিল। এই গ্লানি ও অসম্মানের মধ্যে দিয়ে যাঁদের যেতে হয়নি, তাঁরা বুঝতেই পারবেন না এই একটুখানি পাওয়া তাদের জন্য কতটা বেশি পাওয়া।

শিক্ষাক্ষেত্রে মায়ের অভিভাবকত্বের স্বীকৃতি দিয়ে উচ্চ আদালতের এই রায় নারীর অধিকার অর্জনের প্রথম ধাপ বলে মনে করছেন অনেকে। এই রায়ের পর সমাজে প্রতিষ্ঠিত একজন নারী তাঁর ফেসবুকে স্ট্যাটাসে লিখেছেন, বৈবাহিক স্ট্যাটাস বদলে যাওয়ার পর তিনি সন্তানের অভিভাবকত্ব নিয়ে অনেক যুদ্ধ করেছেন। যে বাবা তাঁর সন্তানকে ছেড়ে চলে গেছেন, বাধ্য হয়ে সেই বাবারই পরিচয় বহন করতে হয়েছে বারবার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্তানের ভর্তি, পাবলিক পরীক্ষায় আবেদন থেকে শুরু করে প্রতি স্তরে সেই ব্যক্তির নাম-ঠিকানা দিতে হয়েছে, কিন্তু কেন দিতে হলো?

আরও পড়ুন

সন্তানের বাবা তো তার কোনো খোঁজ রাখেননি, একটা টাকাও ব্যয় করেননি, ঈদে-উৎসবে সন্তানের হাতে একটি উপহার তুলে দেননি। অথচ সেই লোকটিই সন্তানের অভিভাবক, মা নন। এর চেয়ে বড় বৈষম্য আর কী হতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো কাগজে বাবার পরিচয় দেবে না বলে, সেই মা শিক্ষামন্ত্রীর কাছে পর্যন্ত গেছেন এবং সফলও হয়েছেন। কিন্তু অধিকাংশ মায়ের পক্ষে সেখানে পৌঁছানো সম্ভব নয়।
আশা করা যায়, এবার সেই মায়েরা কিছুটা হলেও সন্তানের ওপর তাঁদের অধিকার ভোগ করবেন। কারণ, বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে সব ফরমে এখন থেকে অভিভাবকের ঘরে মা, বাবা অথবা আইনগত অভিভাবকের নাম লেখা থাকবে বলে হাইকোর্ট রায় দিয়েছেন। সব ফরমে তিনটি বিকল্প বাধ্যতামূলকভাবে সংযুক্ত করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট।

হাইকোর্টের এই রায় এসেছে ১৪ বছর আগে করা একটি রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে। আগে শিক্ষা ফরমে শুধু বাবার নাম থাকলেও, ২০০০ সালে সেখানে মায়ের নাম লেখাও বাধ্যতামূলক করা হয়। কিন্তু হাইকোর্টের এই রায়ের ফলে এখন থেকে শুধু মায়ের পরিচয়েও যেকোনো সন্তান শিক্ষার অধিকার পাবেন। অর্থাৎ অভিভাবক হিসেবে যাঁর নাম লিখতে চাইবেন, তাঁর নামই লেখা যাবে। সেটা বাবা, মা বা আইনগত অভিভাবকের নাম হতে পারে।

মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার (এসএসসি) পর্যায়ে বাবার নাম না দিয়ে মায়ের নাম দিয়ে রেজিস্ট্রেশন ফরম পূরণের সুযোগ নিয়ে ১৪ বছর আগে করা এক রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে হাইকোর্ট এ রায় দেন। ‘বাবার পরিচয় নেই, বন্ধ হলো মেয়ের লেখাপড়া’ শিরোনামে ২০০৭ সালের ২৮ মার্চ প্রথম আলোয় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। উল্লেখ্য, মা ও সন্তানকে কোনো রকম স্বীকৃতি না দিয়ে বাবা চলে গিয়েছিলেন এবং মেয়েটি মায়ের কাছে থেকেই বড় হয়েছে, পড়াশোনা শিখেছে। অথচ বাবা তাঁর নিজের নাম ব্যবহার করতে দিতে অস্বীকার করায়, মেয়েকে পরীক্ষা দিতে গিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছিল।

এই রায়ের মাধ্যমে মা হয়তো সন্তানের সম্পূর্ণ অভিভাবকত্ব পাচ্ছেন না, কিন্তু এখন মায়ের অধিকার আংশিক প্রতিষ্ঠিত হলো। অনেক মায়ের জন্য এই অধিকারটুকু দরকার ছিল। আর যেসব শিশু পরিচয়হীন, তাদেরও শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত হলো। তা ছাড়া সন্তানের ওপর মায়ের অভিভাবকত্বের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে এটাও একটি বড় অর্জন।

আরও পড়ুন

পিতৃপরিচয়হীন বলতে আদালতে যা উপস্থাপন করা হয়েছে, তা হচ্ছে যৌনকর্মীর সন্তান, সারোগেসি/আইভিএফ টেকনোলজির মাধ্যমে জন্মগ্রহণকারী সন্তান, ধর্ষণের শিকার নারীর সন্তান বা ধর্ষণকারীর ওরসজাত সন্তান, বাবার ফেলে যাওয়া সন্তান বা বাবার পরিচয় দিতে না পারা সন্তান।

যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, বাবার পরিচয় দিতে পারছে না বলে তাদের সন্তানেরা স্কুলে ভর্তি হতে পারছে না। তখন তাদের অন্য মানুষ, আত্মীয়স্বজনের পরিচয়ে স্কুলে ভর্তি করাতে হয়। কাউকে কাউকে এ জন্য মোটা টাকাও খরচ করতে হয়।

২৫ বছর বয়সী রানী প্রেম করে যাকে বিয়ে করেছিলেন, সে তাঁকে বিক্রি করে দিয়েছিল যৌনপল্লিতে। সেখানেই একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়, যে তাঁকে বিয়ে করে যৌনপল্লি থেকে বের করে এনেছিল। কিছুদিনের মধ্যে গর্ভে সন্তান এলে রানী আক্তারের স্বামী তাঁকে একা ফেলে চলে যায়। সেই সন্তানকে লালন-পালন করে বড় করেছেন রানী। কিন্তু স্কুলে ভর্তি করানোর সময় বাবার পরিচয় নেই বলে তাঁকে টাকার বিনিময়ে অন্যের সাহায্যে সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাতে হয়েছিল।

যৌনকর্মীর সন্তান হওয়ায় রুনার মেয়েও বিপদের মধ্যে পড়েছিল। বাবার পরিচয়পত্র ও বাবার নাম না থাকায় স্কুল তাদের ভর্তি করতে চাইছিল না। তাই সন্তানের পরিচয়ের জন্য রুনাকে বোনের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল। এ রকম আরও বহু উদাহরণ আছে।

সন্তানের শিক্ষা কার্যক্রমে মায়ের অভিভাবকত্বের অধিকারবিষয়ক রায়, নারী অধিকারকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়েছে। সন্তান ও স্ত্রীকে ফেলে একদম উধাও হয়ে যাওয়া বা অন্যত্র বিয়ে করে সংসার করার নজির অনেক আছে আমাদের সমাজে। কাজেই সেসব একক নারীর যুদ্ধের কথা ভেবে যে রায় আমরা পেলাম, তা কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

এ ছাড়া যে মায়েরা সন্তানের দায়িত্ব পালন করেন, প্রায়ই দেখা যায় সন্তানের জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো তিনি করতে গেলে বাধার মুখে পড়ছেন। কারণ, তিনি আইনগতভাবে সন্তানের অভিভাবক নন। এ রকম একটা অধিকার প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে জটিলতা কমার যাত্রা শুরু হলো বলে আমরা আশা করতে পারি।

রিটকারী সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জুবেইদা পারভীন বলেছেন, সন্তানের পরিচয়ে মায়ের নামের অন্তর্ভুক্তি সমাজে নারীর সাম্য ও সমতা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। যে মায়েরা একা দায়িত্ব পালন করেন, শুধু তাঁরাই নন, আমরা দেখে আসছি, আমাদের পরিবারগুলোতে মায়েরা সতত বিরাজ, তাঁরা কর্মঠ ও দায়িত্ব পালনকারী শক্তি। সংসারে মায়ের ভালোবাসা, সেবাযত্নœও কাজের ভার, কারও চেয়ে কম নয়, বরং বেশি। বাবারা আয় করেন, কিন্তু সেই নির্ধারিত আয়ে সবার মুখে খাওয়ার তুলে দেওয়ার দায়িত্ব মায়ের। কাজেই সন্তানের ওপর মায়ের অধিকার সর্বোচ্চই হওয়া উচিত।

উল্লেখ্য, গত কয়েক বছরের মধ্যে আমরা দেখেছি নারী ও প্রান্তিক মানুষের অধিকার ও স্বার্থের কথা ভেবে এমন কিছু আইন প্রণয়নের কথা ভাবা হয়েছে, যা ইতিহাসে লেখা হয়ে থাকবে। যেমন হিজড়াদের সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আইন প্রণয়নের কথা ভাবা হয়েছে। ২০১৯ সালে তাঁরা ভোটাধিকারও পেয়েছেন তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে।

শুধু হিজড়া ইস্যুতেই নয়, প্রধানমন্ত্রী ২০১৯-এর আইনগত সহায়তা দিবসের অনুষ্ঠানে ‘পুত্র’ বা ‘কন্যার’ পরিবর্তে আইনে শুধু ‘সন্তান’ শব্দটি ব্যবহার করার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাতে করে সন্তানের লৈঙ্গিক পরিচয় নিয়ে ভাবার দরকার হবে না।
ধর্ষণের শিকার নারী এবং তার পরিবারের কাছে ‘সাক্ষ্য আইন’ ছিল মারাত্মক অভিশাপের মতো। ২০২১-এর ৩ নভেম্বর বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে যখন ‘ধর্ষণ মামলায় ভুক্তভোগীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না’ আইনটি পাস হয়, তখন সেটি ধর্ষণের শিকার নারী, তাঁর পরিবার ও নারী অধিকার সংগঠনগুলোর কাছে ছিল বড় আশীর্বাদ।

এরই ধারাবাহিকতায়, সন্তানের শিক্ষা কার্যক্রমে মায়ের অভিভাবকত্বের অধিকারবিষয়ক এই রায়, নারী অধিকারকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়েছে। সন্তান ও স্ত্রীকে ফেলে একদম উধাও হয়ে যাওয়া বা অন্যত্র বিয়ে করে সংসার করার নজির অনেক আছে আমাদের সমাজে। কাজেই সেসব একক নারীর যুদ্ধের কথা ভেবে যে রায় আমরা পেলাম, তা কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

  • শাহানা হুদা সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন