বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ অনুযায়ী, দেশের ৬ থেকে ২৩ মাস বয়সী প্রায় অর্ধেক শিশু কোমল পানীয় এবং অতিরিক্ত লবণ ও চিনিযুক্ত প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণ করে। চিকিৎসক, পুষ্টিবিদ ও গবেষকেরা এসব খাবারকে অস্বাস্থ্যকর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
শিশুবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে এখন শিশুদের পছন্দের খাবারের তালিকায় রয়েছে চিপস, চানাচুর, চকলেট, চুইংগাম ও চাটনি। এসব খাবার শিশুদের ক্ষুধা কমিয়ে দেয় এবং সুষম খাবারের বিপরীত। এসব খাবারসহ অন্যান্য ফাস্ট ফুডের (যেমন পিৎজা, বার্গার, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই) অনিয়ন্ত্রিত প্রসার উদ্বেগজনক।
শিশুস্বাস্থ্যের ওপর ফাস্ট ফুডের ক্ষতিকর প্রভাব
যে খাবারগুলো দ্রুত তৈরি করা যায়, সাধারণত তা-ই ফাস্ট ফুড নামে পরিচিত। তুলনামূলকভাবে কম দাম, স্বাদ ও দ্রুত পাওয়া যায় বলে এই খাবার পুরো বিশ্বেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। শিশুদের মধ্যে এর জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি।
ফাস্ট ফুডে আছে উচ্চমাত্রার ক্যালরি, চর্বি, সম্পৃক্ত চর্বি, চিনি ও লবণ। তাই এর পুষ্টিগুণ কম। শিশুদের স্বাদগ্রন্থির গঠনের কারণে এসব খাবার তাদের বেশি ভালো লাগে। এ খাবারে পেট ভরার অনুভূতি হয় না বলে তারা বেশিও খেয়ে ফেলে। শাকসবজি ও ফলমূল খাওয়ার পরিমাণ কমে যায়। ফাস্ট ফুড খাওয়ার সঙ্গে ওজন বেড়ে যাওয়ার সরাসরি সম্পর্ক আছে বলে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। অতিরিক্ত ওজনের কারণে টাইপ ২ ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগ, হাইপার টেনশন, স্ট্রোক ও কয়েক ধরনের ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রে এক গবেষণায় দেখা গেছে, ফাস্ট ফুড দোকান থেকে দূরে বাস করা মানুষের তুলনায় হাঁটার দূরত্বের মধ্যে বাস করা মানুষের স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ১৩ শতাংশ বেশি।
ফাস্ট ফুড খাওয়ার ফলে শিশুরা আরও যে সমস্যায় ভোগে, তার মধ্যে আছে কোষ্ঠকাঠিন্য, রক্তশূন্যতা, ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি। ক্যালসিয়ামের অভাবে দাঁত ও নখের ক্ষতি হয়। ওজন বেড়ে যাওয়ার ফলে তারা খেলাধুলা বা শারীরিক কাজে কম সময় দিতে পারে। কারণ, তারা দ্রুত ক্লান্ত হয়ে যায়। তাদের মনোযোগ কমে যায়। অনেক ক্ষেত্রেই তারা হীনম্মন্যতায় ভোগে ও মানসিক চাপের শিকার হয়।
ফাস্ট ফুড নিয়ন্ত্রণে অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা
প্রায় ১৫ বছর আগেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন অস্বাস্থ্যকর খাবারের বিপণনকে জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি প্রধান উদ্বেগ হিসেবে শনাক্ত করেছে। সাম্প্রতিক কালে স্বীকার করা হয়েছে, এই ধরনের বিপণন শিশু অধিকার লঙ্ঘন করে।
কোনো দেশই ফাস্ট ফুড কোম্পানিগুলোর আগ্রাসী বিপণন এবং এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে শিশুদের রক্ষায় এখনো পুরোপুরি সফল হয়নি। তবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপের নানা দেশে ফাস্ট ফুড নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
যেমন স্কুলে পিৎজা ও বার্গারের মতো খাবারগুলো এমনভাবে তৈরি করা, যাতে পুষ্টিগুণ থাকে; ভেন্ডিং মেশিনগুলোতে চকলেট ও বেশি ক্যালরির পানীয় কম পরিমাণে রাখা; বিদ্যালয়ে শিশুদের জন্য সুষম খাবারের ব্যবস্থা করা; খাবারে কী কী উপাদান আছে তা বিস্তারিতভাবে মোড়কে উল্লেখ করা; নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি ক্যালরি থাকলে খাবারের সঙ্গে খেলনা বা শিশুদের আকৃষ্ট করে, এমন কিছুর বিক্রি নিষিদ্ধ করা; যেসব খাবার বিক্রির সময় উপহার দেওয়া হবে, সেসবে চিনি এবং চর্বির পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেওয়া; ইত্যাদি।
বাংলাদেশে ফাস্ট ফুডের প্রসার নিয়ন্ত্রণ
পশ্চিমা অনেক দেশে শিশুদের ওজন বেড়ে যাওয়া একটি জাতীয় উদ্বেগের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন দেশ সমস্যাটি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। বাংলাদেশে আমরা কী করছি? কয়েক দিন আগে এক ফাস্ট ফুড দোকানের মালিকের কাছে তাঁর ব্যবসার অবস্থা জানতে চেয়েছিলাম। সহাস্য উত্তর, ‘এই এলাকায় অনেক স্কুল-কলেজ। তাই বিক্রি বেশ ভালো।’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে যথেচ্ছভাবে ফাস্ট ফুডের দোকান খোলার অনুমতি দেওয়া বন্ধ করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে টেলিভিশন, পত্রিকা, বিলবোর্ড, ডিজিটাল মাধ্যমসহ নানাভাবে ফাস্ট ফুডের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে খাবারের সঙ্গে খেলনা দিয়ে শিশুদের আকৃষ্ট করা হচ্ছে। কোনো কোনো ফাস্ট ফুডের রেস্তোরাঁর মধ্যে খেলার স্থান থাকার কারণে শিশুরা সেসব স্থানে যাওয়ার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী।
ফাস্ট ফুডের বিক্রির ক্ষেত্রে খেলনা বা অন্যান্য উপহার দেওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং কোন খাবারে কতটুকু ক্যালরি আছে, তা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা দরকার। ফাস্ট ফুডের বিপণন নিয়ে একটা সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। ফাস্ট ফুডের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে জনসচেতনতা বাড়ানো জরুরি। দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই ফাস্ট ফুড নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগী হতে হবে।
শিশুদের স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গঠনে করণীয়
‘শিশুরা চিপস বা বার্গার পছন্দ করে’—এমন মন্তব্য প্রায়ই শোনা যায়। শিশুদের কি ক্রয়ক্ষমতা আছে? শিশুদের জীবনে খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে অন্য সব আচরণ তৈরিতে মা-বাবার ভূমিকাই প্রধান।
শিশুদের ঘরে তৈরি পুষ্টিকর খাবার গ্রহণে উৎসাহিত করতে হবে। রেফ্রিজারেটর কোমল পানীয় এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার না রেখে দুধ, ফলের রস, তাজা ফল রাখা উচিত। মোবাইল বা ল্যাপটপে অতিরিক্ত সময় কাটানোর পরিবর্তে শিশুদের খেলাধুলায় উৎসাহিত করা প্রয়োজন। মা-বাবাকে চেষ্টা করতে হবে যাতে শিশুরা শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকে।
পুরোপুরি এড়ানো না গেলেও ফাস্ট ফুডের ওপর শিশুদের অতিরিক্ত নির্ভরতা কমানো উচিত। মা-বাবা এবং অভিভাবকেরা শিশুদের শেখাতে পারেন যে ফাস্ট ফুড খাওয়ার ক্ষেত্রেও কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা যায়। যেমন এর সঙ্গে সালাদ বা সবজি খাওয়া যায়। মা-বাবা স্বাস্থ্যকর খাবার খেলে এবং সক্রিয় জীবন যাপন করলে সন্তানেরাও তাঁদের অনুসরণ করবে।
লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী