খুলনা মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের স্থাপত্য বিভাগ থেকে স্নাতক হওয়ার পরও তাইয়াবা খানম ইরার কর্মসংস্থান হয়নি। ২০২১ সালে তিনি একটি স্বল্পমেয়াদি আইটি কোর্স করেন এবং এরপর ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ শুরু করেন। যদিও এর মাধ্যমে তিনি শ্রমবাজারে একটি অবস্থান তৈরি করতে পেরেছেন, এখন তাঁর সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ ডিজিটাল দক্ষতা আরও উন্নত করা এবং ক্রমাগত পরিবর্তনশীল কর্মজীবনকে সঠিকভাবে মোকাবিলা করা।
রোযেন পাত্র একজন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর তরুণ। তিনি সিলেট টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইনস্টলেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স বিষয়ে প্রশিক্ষণ শেষ করেছেন। বর্তমানে তিনি প্রাণ গ্রুপে কর্মরত মেশিন অপারেটর হিসেবে। তবে তাঁর স্বপ্ন ফ্লোর ম্যানেজার হওয়ার। প্রশ্ন হলো, কীভাবে তিনি নিজের দক্ষতা আরও বাড়াতে পারেন এবং সেই কাঙ্ক্ষিত অবস্থানে পৌঁছাতে প্রয়োজনীয় সহায়তা পেতে পারেন?
বাংলাদেশ এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়ে, যেখানে বিপুল সম্ভাবনার পাশাপাশি রয়েছে বিশাল ঝুঁকি। প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করেন।
প্রশ্ন হলো, আমরা কত দ্রুত তাঁদের দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে পারব এবং প্রশিক্ষণকে কীভাবে বাস্তব কর্মসংস্থানের সঙ্গে কার্যকরভাবে যুক্ত করতে পারব?
আমাদের তাঁদের নিয়ে আরও ভাবতে হবে, যাঁরা ইতিমধ্যে শ্রমবাজারে রয়েছেন। তাঁদের কীভাবে নতুন প্রযুক্তি অনুযায়ী প্রশিক্ষিত করা যায়, যাতে তাঁরা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারেন, সে বিষয়ে আমাদের ভাবতে হবে।
প্রায়ই এসব চ্যালেঞ্জের জবাবে আমরা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা আর পঞ্চবার্ষিক প্রকল্পে আটকে থাকি। কিন্তু আমাদের তরুণদের অপেক্ষা করার সময় নেই। এখন দরকার তাৎক্ষণিক ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ, যা আজকের চাকরির বাজারের উপযোগী দক্ষতা গড়ে তুলতে তরুণসমাজ, শ্রমিক ও উদ্যোক্তাদের সহায়তা করবে।
সব প্রশিক্ষণই দুই বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা হতে হবে, এমন নয়। তিন মাস বা তার কম সময়ের ছোট, দক্ষতা ও চাহিদাভিত্তিক কোর্স, যেমন মেশিন অপারেশন, বেসিক কোডিং, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিক্রয়, কেয়ারগিভিং এবং সৌরশক্তি মানুষকে খুব দ্রুত কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুত করতে পারে।
এক বছর পর কেমন হবে চিত্রটা? শুধু প্রোগ্রামার বা টেক-পেশাজীবীরাই নন, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে বাংলাদেশের তরুণদের ‘কো-পাইলট মানসিকতা’ গ্রহণ করতে হবে। কাজেই এআইকে প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং সহকর্মী হিসেবে দেখতে হবে। এর জন্য জটিল প্রোগ্রামিং জানার দরকার নেই। দরকার কেবল মৌলিক এআই জ্ঞান ও টুল ব্যবহারে দক্ষতা।
বর্তমানে অনেক তরুণ জানেনই না বাজারে কোন কোন দক্ষতার চাহিদা রয়েছে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে পেশাগত পরামর্শ ও কর্মসংস্থান সহায়তায় বিনিয়োগ জরুরি, যাতে তরুণেরা সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং চাকরির বাজারের সঙ্গে দক্ষতার মিল তৈরি হয়।
নতুন কর্মজীবনে পা রাখা ব্যক্তি হন বা একজন উদ্যোক্তা—আপনি কীভাবে দ্রুত বদলাতে পারছেন এবং এআই টুলগুলো আয়ত্ত করে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে পারছেন, তার ওপর ভিত্তি করেই আপনি টিকে থাকবেন।
যেসব ব্যক্তি এআইভিত্তিক দক্ষতায় (যেমন প্রম্পট ইঞ্জিনিয়ারিং, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ভিডিও সম্পাদনা, গ্রাফিক ডিজাইন, নো-কোড অটোমেশন, কনটেন্ট ক্রিয়েশন ও ডিজিটাল মার্কেটিং) এগিয়ে, তাঁদের জন্য দ্বার উন্মুক্ত।
অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউট (২০২২) অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অনলাইন শ্রমবাজার বাংলাদেশের। কিন্তু বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে। আন্তর্জাতিক এই বাজার ফ্রিল্যান্সারদের কাছ থেকে (হোক সে ভার্চ্যুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট, ডিজাইনার বা কনটেন্ট ক্রিয়েটর) এআই টুল ব্যবহারে পারদর্শিতার প্রত্যাশা করে।
এখনো সময় শেষ হয়ে যায়নি। আপনি যদি প্রযুক্তি-সচেতন হন, ব্যবসা পরিচালনা করেন বা আপনার ক্যারিয়ার ভবিষ্যতের জন্য সুরক্ষিত করতে চান, তাহলে এখনই সময় এগিয়ে আসার।
এই সুযোগের জানালা এখনো খোলা, কিন্তু চিরকাল খোলা থাকবে না।
গত দুই দশকে বাংলাদেশ সরকার একটি শক্তিশালী কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ (টিভেট) ব্যবস্থা তৈরি করেছে। এনটিভিকিউএফের অধীনে দক্ষতাভিত্তিক প্রশিক্ষণ, পূর্ব দক্ষতার স্বীকৃতি (আরপিএল), অ্যাপ্রেন্টিসশিপ ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রোগ্রাম হাজার হাজার মানুষকে কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনে সহায়তা করেছে।
এই প্রতিষ্ঠিত ভিত্তির ওপর এখনই সময়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ডিজিটাল দক্ষতা একীভূত করার।
বাংলাদেশের মানবসম্পদের পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগানোর জন্য এই মুহূর্ত আমাদের কাজে লাগাতে হবে। সময়টি কাজে লাগাতে হবে দেশীয় ও বৈদেশিক শ্রমবাজার উভয়ের জন্য। এর অর্থ হচ্ছে, কেবল নতুন প্রবেশকারীদেরই নয়, বর্তমান কর্মীদেরও পুনরায় দক্ষ করে তোলা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে।
অনেক শ্রমিকই প্রশিক্ষণ নিতে দ্বিধা করেন। কারণ, তাঁরা কর্মসংস্থানকে হুমকির মধ্যে ফেলতে চান না। বিদ্যমান শ্রম আইনের আওতায় অ্যাপ্রেন্টিসশিপ ব্যবস্থা করার মতো কারখানাভিত্তিক শেখার ব্যবস্থা করে এখানে নিয়োগকর্তা ও সরকার ভূমিকা রাখতে পারে।
এই পদ্ধতি নারীদের, নিম্ন আয়ের পরিবারের যুবকদের এবং বিদেশফেরত কর্মীদের জন্য জীবন বদলে দেওয়া অনুঘটক হয়ে উঠতে পারে।
বর্তমানে অনেক তরুণ জানেনই না বাজারে কোন কোন দক্ষতার চাহিদা রয়েছে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে পেশাগত পরামর্শ ও কর্মসংস্থান সহায়তায় বিনিয়োগ জরুরি, যাতে তরুণেরা সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং চাকরির বাজারের সঙ্গে দক্ষতার মিল তৈরি হয়।
অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করা লাখো শ্রমিকের হাতে-কলমে দক্ষতা আছে, কিন্তু কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই। তাঁদের দক্ষতাকে মূল্যায়ন বা প্রদর্শনের মাধ্যমে জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি প্রদান করলে তাঁরা আরও ভালো পারিশ্রমিকে চাকরি পেতেন বা নিজস্ব ব্যবসা শুরু করতে পারবেন।
সময় আমাদের পক্ষে নেই। বিশ্বব্যাপী চাকরির বাজার দ্রুত রূপ বদলাচ্ছে, স্বয়ংক্রিয়করণ ব্যবস্থা বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তরুণদের এখনই প্রস্তুত হতে হবে, না হলে তাঁরা পিছিয়ে পড়বেন।
আমাদের বিশাল সংস্কার বা বাজেটের অপেক্ষা করতে হবে না। সমাধান—স্বল্পমেয়াদি কোর্স, ডিজিটাল প্রশিক্ষণ, ক্ষুদ্র অনুদান এবং ক্যারিয়ার নির্দেশনা; যা আমাদের হাতের নাগালেই রয়েছে।
এখন দরকার সাহসী উদ্যোগ, দ্রুত বাস্তবায়ন এবং সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা। দক্ষতা উন্নয়নকে আর আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে ভাবা যাবে না। এটি হোক আজকের অগ্রাধিকার।
পেদ্রো জুনিয়র বেলেন অফিসার ইনচার্জ, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও), বাংলাদেশ