ট্রেনের হকার সাগর বা হীরালাল, অর্থনীতির অন্য আয়না

‘আজকে বরেন্দ্র ট্রেনে একজন হকারকে ধরে জরিমানা করার উদ্যোগ নিলাম। কী মনে হলো, ধরে কেবিনে নিয়ে এলাম। এক কাপ কফি খাওয়ালাম। এরপর তার পরিবার ও আয় সম্পর্কে খোঁজখবর নিলাম। পরিশেষে ট্রেনের ভিতর উঠে হকারি না করতে মোটিভেট করলাম। সে আমার অনুরোধ পালন করার প্রতিশ্রুতি দিল। ছেলেটির নাম সাগর, বাড়ি চাটমোহর।’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এই পোস্ট দিয়েছেন বাংলাদেশ রেলওয়ের একজন বড় কর্মকর্তা।

বনফুলের ‘ক্যানভাসার’ নামে একটি গল্প আছে। গল্পটির একটা অংশ এমন, স্ত্রী কাত্যায়নীর কাছে যে ভৈরবকে শুনতে হয়, ‘এক কড়ার মুরোদ নেই, বিয়ে করতে যাওয়া কেন তার?’ সেই ভৈরবই আবার ক্যানভাসার হীরালালকে স্টেশনে এ-ই বলে ধাক্কা দেয়, ‘আপনারা হচ্ছেন দেশের শত্রু। দুনিয়ার যত শৌখিন বাজে জিনিস জুটিয়ে এনে দেশটাকে রসাতলে দিচ্ছেন। বুঝলেন?’

রাষ্ট্রীয় সমর্থন ছাড়া বড় পুঁজি এখনো দাঁড়াতে পারবে না হকার অর্থনীতির সামনে। রাস্তার পাশের রেস্তোরাঁয় যে নানরুটির দাম ৫০ টাকা, তারই পাশে বা একটু দূরে টিনের দোকানে তা ১০ টাকা। গরিব যাত্রীটি কই যাবেন

ক্যানভাসার যখন তার শুভ্রসুন্দর দাঁত বিকশিত করে নিজের আবির্ভাব সদর্পে সমর্থন করতে লাগল, তখন ক্রুদ্ধ ভৈরব তার গণ্ডদেশে প্রচণ্ড চপেটাঘাত করে বসল। সঙ্গে সঙ্গে দাঁতের মাজনের সুখ্যাতিকারের নকল দন্তপাটি, নিয়তির অট্টহাসির মতোই ছিটকে বেরিয়ে এল। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, প্রহারের পরও মুখে হাসি টেনে ক্যানভাসার করুণ স্বরে বলছে, ‘কেন মারধর করছেন মশাই? গরিব মানুষ—এই করে কষ্টেসৃষ্টে সংসার চালাই। বুড়ো বয়সে উপযুক্ত ছেলেটি মারা গেছে।’

তারপর ভৈরব একটা মাজনের কৌটা কিনে নেয় ক্যানভাসার হীরালালের কাছ থেকে। যদিও আমাদের রেলওয়ের কর্তাটি হীরালালের চরিত্রের সাগরকে ডেকে কফি খাইয়েছেন।

বঙ্গবন্ধু সেতু যখন হয়নি, তখন রেললাইনের পাশের গাঁয়ের লোকজন কলসিতে করে পানি আনতেন। আমরা চার আনা, আট আনা দিয়ে পানি খেতাম। স্থানীয় জনগণের আয়রোজগারের জায়গা ছিল। এখন বোতলজাত পানি ২০ টাকা দিয়ে খেতে হয়। রোজগারটা চলে গেল দু-চারজন পুঁজিপতির হাতে। নগদে পেলাম পরিবেশের বারোটা বাজানো প্লাস্টিক। অথচ ট্রেনে শৌচাগারের জন্যই পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায় না। পানির মান এমন—মুখ ধোয়াই অসম্ভব। খাওয়ার পানির ব্যবস্থাই আজ অবধি করা হলো না। টিকিট কালোবাজারিসহ আরও নানা অব্যবস্থাপনায় ওই বড় কর্তারা তখন কই থাকেন?

দুই.

বাংলাদেশের কত ভাগ মানুষ শপিং মলে সদাই করে? নিজেদের ঘরের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, অধিকাংশ পণ্যই ফুটপাত বা হকার থেকে কেনা। মাছ কিনি, তা-ও রাস্তা থেকে। চা খাই, তা-ও ফুটপাতে। মোবাইলের যন্ত্রপাতি, তা-ও ফুটপাত বা ট্রেনে কেনা। কটনবাড, আনাজ কাটার উপকরণ, তা-ও। যে জিনিস রাস্তায় কিনি ২০ টাকায়, তা শপিং মলে ৫০ টাকা। কাগজের ঠোঙায় যে বাদামের দাম ১০ টাকা, পলিথিনের প্যাকেটে তা ২০ টাকা। ট্রেনে যে খাবার ১৮০ টাকা, হকারের কাছে তা ৮০ টাকা।

বিশ্ববাণিজ্যে বাংলার বহুকাল ধরে উদ্বৃত্ত ছিল। পাল আমলের আগে থেকে শুরু করে ১৮০০ সাল পর্যন্ত। তখন কয়েকজন চৌকিদার ও কৃষি আমলা ছাড়া সমাজ রাষ্ট্রকে অহেতুক হস্তক্ষেপ করতে দেয়নি। তারপর শহরে কারখানা হলো রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদে।

শুরুতে হাতে গোনা কিছু কারিগর সেসব কারখানায় কাজ করলেও গ্রামজুড়ে যে উৎপাদনব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল হাজার বছর ধরে, সেটিই এখানকার অর্থনীতির বড় ভিত ছিল। যেটিকে আমরা আলাদা করে গ্রামীণ অর্থনীতি বলে সংজ্ঞায়ন করে থাকি।

বড় পুঁজি ছিল সব সময় মূলত নগরভিত্তিক। তারা ব্যবসা বাড়ানোর জন্য গ্রামের উপাদানব্যবস্থার ওপর বা উৎপাদন বাড়ানোর জন্য চাপ দিতে পারত না। গ্রামের উৎপাদন ও এর বাজারজাতকরণ ছিল নিজস্ব নিয়মেই। হাটবাজারের বাইরে ফেরি করে বা হকারি করে পণ্য বেচাবিক্রির সংস্কৃতি এখানে অনেক পুরোনো।

রাষ্ট্রীয় সমর্থন ছাড়া বড় পুঁজি এখনো দাঁড়াতে পারবে না হকার অর্থনীতির সামনে। রাস্তার পাশের রেস্তোরাঁয় যে নানরুটির দাম ৫০ টাকা, তারই পাশে বা একটু দূরে টিনের দোকানে তা ১০ টাকা। গরিব যাত্রীটি কই যাবেন? আমি নিজেই নিয়মিত বঙ্গবন্ধু সেতু স্টেশনে কখন খিচুড়িওয়ালা আসবেন, তাঁর অপেক্ষায় থাকি ৪০ টাকা দিয়ে এক প্লেট ডিম-খিচুড়ি খাব বলে।

হকার সিস্টেমটা মূল ভিত্তি হলো কেন্দ্রহীনতা। এখানে যত বিক্রেতা, তত উৎপাদক। এ যেন এক রক্তবীজের ধারা। কোনো কেন্দ্র নেই। ফলে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন। আড়াই শ বছরের নানান বহুজাতিক ধাক্কায়ও টিকে থাকে। এ ব্যবস্থায় বড় কারখানা তৈরির সুযোগ ছিল না। ছিল না বলে কোনো কারিগরের পক্ষে গোটা গ্রামের কারিগরদের বাড়িতে বাড়িতে চলা কারখানাগুলোকে গায়ের জোরে, রাষ্ট্র আর বড় পুঁজির মদদে কিনে নেওয়া অসম্ভবপ্রায়।

একটা বড় কারখানা তৈরি করে একা বা কয়েকজন মালিক হয়ে গোটা বিক্রির লাভ নিজের পকেটে ঢোকানো—সে অবস্থা আজও নেই হকার উৎপাদনব্যবস্থায়। বড় পুঁজির পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্র আর করপোরেট এবং বড় পুঁজি সে তত্ত্ব জানে বলেই তার পক্ষে এই উৎপাদনব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষক হওয়া আত্মঘাতী। ফলে প্রথম থেকেই করপোরেট তাকে প্রতিযোগী হিসেবে বেছে নিয়ে হটিয়ে দিতে উদ্যোগী।

আর এই বহুজাতিকের আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত সমাজ, টেলিভিশন ও ফেসবুক। ফোর্ট উইলিয়ামের শিক্ষিত সমাজ ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুবিধাভোগীদের দিয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই স্বীকৃতিই তো আদায় করেছে। ফলে তাঁদের সামনে মেহনতি হকার সমাজ তো নিগৃহীত হবেনই। শ্রেণিভেদে এই ঘৃণাবোধ তো নতুন নয়।

● নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক

[email protected]