৩২ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভের বিনিময়ে কী পেলাম

অর্থনীতির মন্দা ও পুনরুদ্ধার নিয়ে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ মিলটন ফ্রিডম্যানের একটি তত্ত্ব আছে—গিটার স্ট্রিং থিওরি অব রিসেশনস। এভাবে এর ব্যাখ্যা দেওয়া যায়, একটা গিটারের তার কল্পনা করুন, গিটারের সেই তারকে নিচের দিকে জোরে টেনে ধরার পর হাত ছেড়ে দিলে তারটি দ্রুত আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে।

মিলটন ফ্রিডম্যান বলেছিলেন, অর্থনীতিও অনেকটা গিটারের এই তারের মতোই আচরণ করে। যখন কোনো মন্দা আসে, অর্থনীতিকে নিচের দিকে টেনে ধরে। তখন উৎপাদন কমে, আয় কমে, কর্মসংস্থানও কমে। কিন্তু যখন মন্দার কারণগুলো চলে যায়, চাহিদা বাড়ে, সুদহার কমে, নীতি সহায়তা দেওয়া হয়, তখন অর্থনীতি দ্রুত আগের অবস্থায় ফিরে আসে। অর্থাৎ যত গভীর মন্দা, পুনরুদ্ধারও তত দ্রুত হওয়ার কথা।

মিলটন ফ্রিডম্যানের এই তত্ত্ব নিয়ে প্রথম প্রশ্ন উঠল ২০০৮-০৯ সালের গভীর বৈশ্বিক মন্দার পর। তখন অর্থনীতির পুনরুদ্ধার দ্রুত হলো না; বরং তা ছিল ধীর, দুর্বল ও অসম। অর্থনীতিবিদেরা বললেন, অর্থনীতি সব সময় গিটার স্ট্রিং তত্ত্বের মতো কাজ করে না। কেননা কখনো মন্দা এত গভীর হয় যে তারটি টানার পর ছিঁড়ে যায়। অর্থাৎ অর্থনীতির কাঠামোগত এমন ক্ষতি হয় যে পুনরুদ্ধার ধীরে হয় বা অসম্পূর্ণ থাকে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি অনেকটাই বেসরকারি খাতনির্ভর। ফলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ না বাড়লে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয় না, আয়ও বাড়ে না। সরকারি তথ্যই বলছে, মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেছে। মজুরি বৃদ্ধির তুলনায় এখনো মূল্যস্ফীতি বেশি। আবার ৫০ হাজারের বেশি শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়ে চাকরি হারানো শ্রমিকেরা পরিবার নিয়ে কীভাবে টিকে আছেন, আমরা সেটা জানি না। সরকারও জানে না।

বাংলাদেশের অর্থনীতি কার্যত মন্দার মধ্যে আছে ২০২০ সাল থেকে। মন্দার প্রথম কারণ ছিল কোভিড-১৯ মহামারি এবং পরে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ। এই দুই কারণে অর্থনীতি নিয়ে তখন বিপাকে ছিল বিশ্বের প্রায় সব দেশই। কিন্তু কোভিডের পর তারা প্রায় সবাই মন্দা অবস্থা থেকে বের হয়ে গেছে। যারা পারেনি, তাদের মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। আসলে তারটা ছিঁড়ে ফেলেছিল সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারই। নষ্ট করে ফেলেছিল সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা।

১৯৯০ সালের পর থেকে নিয়মিত বিরতিতে সরকারের বদল হলেও কখনোই খুব একটা অস্থিতিশীল হয়নি। দুর্নীতি, অর্থ পাচার, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অব্যাহত টাকা ছাপানো, উচ্চ খেলাপি ঋণ, টাকার ব্যাপক অবমূল্যায়ন, বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়া, রিজার্ভের অতি দ্রুত পতন—সবই দেখা গিয়েছিল অর্থনীতিতে।

আরও পড়ুন

এখন আওয়ামী লীগ সরকার নেই। দায়িত্বে অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু গিটারের তার এখনো আগের জায়গায় ফেরেনি। তবে উন্নতি যে নেই, তা বলা যাবে না। রিজার্ভের যে দ্রুত পতন ঘটছিল, তা ঠেকানো গেছে।

মোট হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এর সঙ্গে ডলারের দর স্থিতিশীল রাখার গভীর সম্পর্ক আছে। কেননা ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। লেনদেনে ভারসাম্যও এসেছে। রিজার্ভ বৃদ্ধির পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল প্রবাসী আয়ের। তারপরই আছে রপ্তানি আয়। আবার এ জন্য আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে। বিনিয়োগে মন্দা থাকায় এ সময় ডলারের চাহিদাও কম ছিল। ফলে রিজার্ভ বাড়াতে খুব সমস্যা হয়নি। সরকারের সদিচ্ছাও ছিল।

তবে সমস্যা হচ্ছে সামষ্টিক অর্থনীতির এ স্থিতিশীলতা অর্থনীতিতে চাঞ্চল্য ফেরাতে পারেনি। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, ৩২ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভের বিনিময়ে অর্থনীতি আসলে কী পেল, দেশের মানুষ কী পেয়েছে।

আরও পড়ুন

চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে অর্থনীতির গতি এখনো শ্লথ, বিনিয়োগে চরম মন্দা, আয় বাড়ছে না মানুষের। রপ্তানি আয় পরপর দুই মাস কমে গেছে। আমদানি আগের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে বলে ডলারের দামের ওপরেও চাপ পড়েছে। ডলারের দর স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত ২১২ কোটি ৬০ লাখ ডলার কিনেছে।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা সামষ্টিক অর্থনীতি অনেকটা ঠিক পথে আনতে পারলেও অন্তর্বর্তী সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে। অর্থনীতির মূল সংকট এখনো এটাই। বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি মাত্র ৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ।

বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি অনেকটাই বেসরকারি খাতনির্ভর। ফলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ না বাড়লে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয় না, আয়ও বাড়ে না। সরকারি তথ্যই বলছে, মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেছে। মজুরি বৃদ্ধির তুলনায় এখনো মূল্যস্ফীতি বেশি। আবার ৫০ হাজারের বেশি শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়ে চাকরি হারানো শ্রমিকেরা পরিবার নিয়ে কীভাবে টিকে আছেন, আমরা সেটা জানি না। সরকারও জানে না।

আরও পড়ুন

সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সর্বশেষ জাতীয় খানা আয় ও ব্যয় জরিপ করছিল ২০২২ সালে। তখন দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। এরপর আর সরকারি পর্যায়ে কোনো জরিপ হয়নি।

তবে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) গবেষণা করে দেখিয়েছে, দেশে এখন দারিদ্র্যের হার ২৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এ ছাড়া আরও ১৮ শতাংশ মানুষ যেকোনো সময় গরিব হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। অর্থাৎ দারিদ্র্য আদৌ জাদুঘরে স্থান পায়নি; বরং শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে, দেশের এখানে আর ওখানে দারিদ্র্যের করুণ চিত্র যথেষ্ট দৃশ্যমান।

এখন জরুরি প্রশ্ন হচ্ছে, একটি অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে আসলেই কি বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব? বাংলাদেশের তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন থাকার ইতিহাস আছে। এই ইতিহাস বলে তারা নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠীকে লালন-পালন করে না; দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও আমলাতন্ত্রকে উৎসাহ দেয় না; আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে ভালো রাখে।

আরও পড়ুন

সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি কিন্তু এবার হয়নি। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট করেছে। চাঁদাবাজিও বন্ধ হয়নি। মব–সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। এর পাশাপাশি ছিল নির্বাচন নিয়ে সংশয়, সন্দেহ। এসব কারণেই দেশে একধরনের অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা তৈরি হয়। আমরা সবাই জানি, অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা হচ্ছে বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় শত্রু।

অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে অনিশ্চয়তার ভূমিকা নিয়ে ১২ বছর আগে একটি গবেষণা করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক নিকোলাস ব্লুম। গবেষণায় তাঁর সহযোগী ছিলেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) আরও দুই অর্থনীতিবিদ আইহান কোসে (বর্তমানে বিশ্বব্যাংকের উপপ্রধান অর্থনীতিবিদ) ও অধ্যাপক মার্কো তেররোনেস।

গবেষণায় বলা হয়েছে, অতিরিক্ত অনিশ্চয়তা অর্থনীতির পুনরুদ্ধারকে আটকে রাখে। নীতি ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয় ও সন্দেহ থেকেই অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়। যখন অনিশ্চয়তা বাড়ে, তখন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো নতুন বিনিয়োগ স্থগিত রাখে। মানুষও বড় কেনাকাটা বন্ধ রাখে। কোম্পানিগুলো নতুন কর্মী নেওয়ার পরিকল্পনা পিছিয়ে দেয়। ব্যাংকগুলোও বেশি ঝুঁকি দেখে বলে ঋণের সুদ বাড়ায় বা ঋণ কমায়। সব মিলিয়ে অনিশ্চয়তা যত বাড়ে, নীতি নিয়ে ভয় ও দ্বিধা যত বৃদ্ধি পায়, প্রবৃদ্ধি তত কমে।

আরও পড়ুন

গবেষণাটি ১২ বছর আগের হলেও এখনকার বাংলাদেশের জন্য এটি পুরোপুরি প্রযোজ্য। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো নতুন বিনিয়োগ স্থগিত রেখেছে, ব্যাংকগুলো কম ঋণ দিচ্ছে, নতুন কর্মী নেওয়াও কমে গেছে। এসবের ফল হচ্ছে নিম্ন প্রবৃদ্ধি।

তাহলে পরিত্রাণের পথ কী? অবশ্যই অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা কমাতে হবে। বাংলাদেশ প্রায় পাঁচ বছর ধরে অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে আছে। এ থেকে পুনরুদ্ধার না ঘটলে মানুষের দুরবস্থা আরও বাড়বে, সমাজে অস্থিরতাও তত বৃদ্ধি পাবে। এ অবস্থায় একটা ভালো নির্বাচন হয়তো বিদ্যমান অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা অনেকখানি দূর করতে পারবে। আর নির্বাচনের পরে নতুন যাঁরা আসবেন, তাঁরা দুর্নীতি রোধ, অবকাঠামোর সমস্যা, ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থা, চাঁদাবাজি বন্ধের মতো কাজগুলো যত দক্ষতার সঙ্গে সমাধান করতে পারবেন, অর্থনীতির পুনরুদ্ধার তত দ্রুত হবে।

নিকোলাস ব্লুমের গবেষণায় অনিশ্চয়তা মাপার বেশ কিছু উপায়ের কথা বলা হয়েছিল। এর মধ্যে অন্যতম ছিল গণমাধ্যমে ‘অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা’ কথাটি কতবার ব্যবহৃত হয়েছে, তা দেখা। গবেষণা মেনে আমিও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা কথাটা এখানে অনেকবার ব্যবহার করলাম। এখন দেখা যাক, এ কথার ব্যবহার গণমাধ্যমে কবে বন্ধ হয়। এরও দুটি উপায় আছে। একটি হচ্ছে, সব অনিশ্চয়তা দূর করে অর্থনীতি ঠিকঠাক করা অথবা অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা কথাটি আর লেখা যাবে না—এ নির্দেশ দেওয়া। এখন দেখা যাক, কোনটি ঘটে।

  • শওকত হোসেন প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন

    [email protected]

    *মতামত লেখকের নিজস্ব