মহাকাশবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে যেতে আমাদের তরুণদের সুযোগ

উদ্ভাবনী ও জ্ঞানভিত্তিক রাষ্ট্রবিনির্মাণে কাজ করছে সরকার। মেট্রোরেল, পাতালরেল, টানেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও স্যাটেলাইট ইত্যাদির মতো উচ্চপ্রযুক্তির ঘন প্রকল্প একদিকে যেমন তরুণ প্রজন্মকে উদ্ভাবনীমূলক কাজে নিয়োজিত করবে, অন্যদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে সহায়তা করবে। আধুনিক মহাকাশবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চা ছাড়া কোনো দেশই উন্নত কাতারে যেতে পারে না।

দেশে প্রথমবারের মতো ১২ মে ২০১৮ সালে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উদ্বোধন করা হয়।

প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সুরক্ষা, দেশের সীমানা, সমুদ্রসীমা, সমুদ্রের তলদেশে সম্পদের অনুসন্ধান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, স্বাস্থ্যসেবার নিরাপত্তা, সাইবার নিরাপত্তা, অধিক কৃষিজাতপণ্য উৎপাদন ও তার সুরক্ষা, মৎস্য, বন ও পরিবেশগত অবস্থা ইত্যাদি তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করার নিমিত্তে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ নামে আরেকটি স্যাটেলাইট এই বছর উদ্বোধন করার কথা রয়েছে। এই সংবেদনশীল তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে আমাদের ভিন দেশের স্যাটেলাইটের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। এতে দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা রক্ষায় ব্যবহার ছাড়াও তথ্য-উপাত্ত ও ছবি আদান-প্রদানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে স্যাটেলাইটের বাণিজ্যিক ব্যবহারের যথেষ্ট সুযোগ আছে।

বোঝা গেল স্যাটেলাইট চালু এবং এর সম্প্রসারণ দেশের মহাকাশবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চা ও উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। মাঝেমধ্যে দেখতে পাই কিছু কিছু তরুণ নিজ উদ্যোগে রকেট বানাচ্ছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যারোনটিকস এবং স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নাসা) কিংবা ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি)–এর মহাকাশ প্রযুক্তি–সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ কোর্সে তাঁরা অংশগ্রহণ করছেন। আবার অনেকে দেখি তাত্ত্বিক ও হাতে-কলমে গভীর জ্ঞান অর্জনের জন্য সঠিক প্রতিষ্ঠানে পড়ার আগ্রহ প্রকাশ করছেন।

তাহলে দৃষ্টি দেওয়া যাক এ বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও দক্ষ জনবল তৈরির উদ্যোগের বিষয়টি। মহাকাশবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি একটি স্পর্শকাতর ও উচ্চ প্রযুক্তিঘন বিদ্যা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও দক্ষ জনবল না থাকলে আমাদেরকে নির্ভর করতে হবে বিদেশি প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবলের ওপর। এতে যেমন নিরাপত্তার বিষয়টি বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তেমনি প্রযুক্তির পরনির্ভশীলতার কারণে টেকসই অর্থনৈতিক বিষয়টি সামনে চলে আসে।

আমার জানা মতে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস ইউনিভার্সিটি এবং বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন (স্পারসো) এই দুই প্রতিষ্ঠান মহাকাশবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে তাত্ত্বিক পড়াশোনা ও গবেষণার জন্য বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান হিসেবে তৈরি করেছে সরকার।

আবার নভোথিয়েটার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর এসব প্রতিষ্ঠান রকেট বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার প্রসার ও তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় করার জন্য কাজ করে থাকে। কিন্তু তরুণদের আকাঙ্ক্ষাও যুগের চাহিদা অনুযায়ী হাতে-কলমে দক্ষ করে গড়ে তুলতে কী পরিমাণ ভৌত অবকাঠামো ও দক্ষ জনবলের সক্ষমতা রয়েছে, তা আমার জানা নেই।

মোদ্দাকথা তরুণ শিক্ষার্থীরা যাঁরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে পড়াশুনা করছেন, তাঁদেরকে রকেট বিজ্ঞানে পড়ার আগ্রহ এবং যোগ্য ও দক্ষ করে গড়ে তোলার উদ্যোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনের সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। ফলে মহাকাশবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে তরুণদের হাতে-কলমে শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জনে কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি (জ্যাক্সা) কিবো এবিসি প্রোগ্রামের মাধ্যমে এশিয়ার সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর তরুণদের এ বিষয়ে শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জনে সুযোগ দেয়। জ্যাক্সা সদস্য হতে হলে ফিবছর প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়। বাংলাদেশ জ্যাক্সার সদস্য নয় বিধায় বাংলাদেশের তরুণেরা এ বিষয়ে কোনো ধরনের সহযোগিতা পেতেন না।

কিন্তু এমআইটির মহাকাশ বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী মিজানুল চৌধুরী তাঁর নিজ উদ্যোগে ২০১৯ সালে তৈরি স্টেমএক্স ৩৬৫ নামক অলাভজনক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানটি জাপানের জ্যক্সার সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশি তরুণদের জন্য বিনা পয়সায় মহাকাশবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত করেন। মিজানুল চৌধুরীর স্টেমএক্স ৩৬৫ প্রতিষ্ঠানটি এমআইটির জিরোরোবটিকস ল্যাবের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করেন।

স্টেমএক্স ৩৬৫ প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে দেশের বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় এ অধ্যয়নরত মেধাবী তরুণেরা কোডিং, প্রোগ্রামিং শিখছেন, রোবট বানাচ্ছেন, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করছেন। ইতিমধ্যে স্টেমএক্স ৩৬৫ প্রতিষ্ঠানটির পৃষ্ঠপোষকতায় আন্তর্জাতিক কিবো রোবটিকস প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় ২০২১ সালে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে এবং বিশেষ কৃতিত্বের জন্য ২০২১–২২ সালে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন ক্রু সম্মানজনক পুরস্কার লাভ করে।

বর্তমানে স্টেমএক্স ৩৬৫ প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন যুক্তরাষ্ট্রের নাসা, জাপানের জ্যাক্সা ও এমআইটির জিরো রোবটিকস এবং দেশের জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর এবং জাতীয় বায়োটেকনোলজি ইনস্টিটিউটের সঙ্গে মহাকাশবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি–সম্পর্কিত শিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ে কাজ করছে।

স্টেমএক্স ৩৬৫ প্রতিষ্ঠানটি মহাকাশবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জনে দেশের তরুণদের জন্য একটি অফুরন্ত সুযোগ তৈরি করেছে। শিক্ষা ও গবেষণা ছাড়াও এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সেমিনার, সভা, কর্মশালা, ইন্টার্নশিপ ও শিক্ষা বিনিময়ের সুযোগ রয়েছে। দেশের সব আগ্রহী স্টেম শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক স্টেমএক্স ৩৬৫ প্রতিষ্ঠানসহ দেশের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর পৃষ্ঠপোষকতায় মহাকাশবিজ্ঞান, প্রযুক্তি শিক্ষায় ও দক্ষতায় দেশকে অনন্য উচ্চতায় নিক—এই আমাদের প্রত্যাশা।

  • ড. মো. শফিকুল ইসলাম ভিজিটিং অধ্যাপক ও ফুলব্রাইট স্কলার, নিউক্লিয়ার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি), যুক্তরাষ্ট এবং অধ্যাপক, নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: [email protected]