ট্রাম্প কি শেষ পর্যন্ত ভোটে দাঁড়াতে পারবেন

ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত ভোটে দাঁড়াতে পারবেন কি না, তার ফয়সালা হতে এখনো বাকি আছেছবি: এএফপি

২০২৪ সালের নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকানদের হয়ে কে প্রার্থী হবেন, তা ঠিক করতে আগামী ৫ মার্চ কলোরাডোতে অনুষ্ঠেয় ‘প্রাইমারি ইলেকশনে’ মার্কিন ভোটাররা ভোট দেবেন। প্রাইমারি ভোটের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই এই প্রশ্ন সামনে আসছে, কলোরাডোয় রিপাবলিকান পার্টির প্রাইমারিতে দলটির ব্যালটে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম থাকছে কি না।

সম্প্রতি কলোরাডোর সুপ্রিম কোর্ট ট্রাম্প নির্বাচন করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে একটি রায় দিয়েছেন। এই রায়কে কেউ ‘বিস্ফোরক’; কেউ ‘বোমা ফাটানো’; কেউবা ‘গণতন্ত্রের একটি মাহেন্দ্রক্ষণ’ বলে আখ্যায়িত করছেন। রায়টি হলো—‘না’। অর্থাৎ কলোরাডোর সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী, ট্রাম্প কলোরাডোর প্রাইমারিতে দাঁড়াতে পারবেন না।

কলোরাডোর শীর্ষ আদালতের সাতজন বিচারপতির চারজন চতুর্দশ সংশোধনীর ৩ নম্বর ধারা অনুযায়ী ট্রাম্পের নির্বাচনী কপালে সিলগালা মেরে দিয়েছেন। কারণ, ৩ নম্বর ধারায় ফেডারেল কিংবা অঙ্গরাজ্যের সামরিক-বেসামরিক দপ্তরের দায়িত্ব গ্রহণের ক্ষেত্রে ‘দেশদ্রোহীদের’ বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাখা হয়েছে।

আরও পড়ুন

২০২০ সালের শেষ দিকে এবং ২০২১ সালের শুরুতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা মসৃণভাবে হস্তান্তরের পথে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী যে বিদ্রোহ হয়েছিল, তাতে ট্রাম্প জেনেশুনে ঠান্ডা মাথায় জড়িত হয়েছিলেন মর্মে কলোরাডো অঙ্গরাজ্যের নিম্ন আদালত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। সেই সিদ্ধান্ত অনুসরণ করে রাজ্য সুপ্রিম কোর্ট ট্রাম্পকে ভোটে দাঁড়ানোর অযোগ্য বলে রায় দিয়েছেন।

নির্বাচনে কারসাজি হয়েছে বলে ট্রাম্প মিথ্যা অভিযোগ তুলেছিলেন; তিনি ইলেকটোরাল ভোট গণনায় বাধা দিতে সমর্থকদের উত্তেজিত করেছিলেন এবং বিভিন্ন কেন্দ্রে নির্বাচনী ফল ঘোষণা দেওয়ার এখতিয়ার রাখা নির্বাচকদের স্বাক্ষরের জায়গায় ভুয়া নির্বাচকদের স্বাক্ষর প্রতিস্থাপনের পরিকল্পনায় তিনি জড়িত ছিলেন বলে প্রমাণিত হয়েছে। আদালত তাঁর রায়ে উপসংহার টেনেছেন: এসব কাজ মার্কিন সংবিধানের বিরুদ্ধে সক্রিয় বিদ্রোহের সমান।

ট্রাম্পের এসব কর্মকাণ্ড তাঁকে অতীতের সেই সব সরকারি কর্মকর্তার কাতারে নিয়ে এসেছে, যাঁরা ১৮৬০ এবং ১৮৬১ সালে তাঁদের অঙ্গরাজ্যগুলোকে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের অপচেষ্টায় জড়িত ছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে আমেরিকার কনফেডারেট স্টেটস প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় অংশ নিয়েছিলেন। দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর তাঁদের সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল।

আরও পড়ুন

পরে একগুচ্ছ সাংবিধানিক সংশোধনীর (যেটিকে আমেরিকার ‘দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠা’ বলেও মনে করা হয়) মধ্য দিয়ে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পরিসমাপ্তি (১৮৬১-৬৫) হয়েছিল। এগুলোর মধ্যে ত্রয়োদশ সংশোধনী দাসপ্রথার সমাপ্তি ঘটিয়েছিল; পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সর্বজনীন পুরুষ ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং চতুর্দশ সংশোধনী ‘সকল ব্যক্তি’কে যথাযথ প্রক্রিয়ার ফেডারেল অধিকার ও সমান সুরক্ষা দিয়েছিল।

চতুর্দশ সংশোধনীর ৩ নম্বর ধারায় সংবিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ব্যক্তিদের সরকারি পদে নিষিদ্ধ করে গণতন্ত্রকে অধিকতর সুরক্ষিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল।

৩ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি যদি সিনেটর বা কংগ্রেসের সদস্য, প্রেসিডেন্টের বা ভাইস প্রেসিডেন্টের নির্বাচক, কোনো দপ্তরের প্রধান কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় অথবা অঙ্গরাজ্যের অধীন সামরিক অথবা বেসামরিক কর্মকর্তা হিসেবে শপথ নেওয়ার পর সেই শপথ ভঙ্গ করে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন বা বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত থাকেন বা সংবিধানের শত্রুদের কোনো ধরনের সহায়তা দেন, তাহলে তিনি আর ওই সব পদে বসতে পারবেন না।’

আরও পড়ুন

কলোরাডোর নিম্ন আদালত ও অঙ্গরাজ্যটির সুপ্রিম কোর্ট উভয়েই ট্রাম্পের ‘বিদ্রোহে জড়িত’ থাকার বিষয়ে নিশ্চিত। তবে ট্রাম্প ভোটে দাঁড়াতে পারবেন কি না, তা নিয়ে এই দুই আদালতের আইনি বিশ্লেষণে ফারাক রয়েছে।

নিম্ন আদালত ট্রাম্পকে কলোরাডোর প্রাইমারি ইলেকশনে অংশগ্রহণের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করার বিষয়টি উড়িয়ে দিয়েছেন। নিম্ন আদালতের যুক্তি হলো, ‘অফিসার’ বা ‘কর্মকর্তা’ শব্দটি প্রেসিডেন্ট পদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। নিম্ন আদালতের বক্তব্য হলো, প্রেসিডেন্ট যদি সংবিধানদ্রোহী হন, তাহলে তিনি আর পরবর্তী সময়ে সরকারি দপ্তরের দায়িত্ব নিতে পারবেন না—এমন কথা এই অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা নেই। ফলে এই অনুচ্ছেদ ট্রাম্পের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।

কিন্তু নিম্ন আদালতের এই ব্যাখ্যাকে কলোরাডোর সুপ্রিম কোর্ট অযৌক্তিক বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। এই রাজ্য সুপ্রিম কোর্টের মতে, সংশোধনীর খসড়া যে সময়ে প্রণয়ন করা হয়েছিল, সে সময়কার ‘অফিস’ শব্দটির ব্যবহার মাথায় রাখলে সহজেই বোঝা যায়, ‘অফিস’ শব্দের সরল অর্থ সন্দেহাতীতভাবে প্রেসিডেন্টের অফিস বা প্রেসিডেন্টের পদটিকেও অন্তর্ভুক্ত করে। তা ছাড়া সুপ্রিম কোর্ট উল্লেখ করেছেন, যিনি একটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি, তাঁকে শপথভঙ্গের সাজার বাইরে রেখে অন্য শপথ ভঙ্গকারীদের গুরুত্বপূর্ণ পদে অযোগ্য ঘোষণা করার কোনো মানেই হতে পারে না।

আরও পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রের একজন সিনেটর এবং সমরমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর সংবিধানদ্রোহী হয়ে কনফেডারেসির প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন জেফারসন ডেভিস। এরপর তাঁর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্যতা ছিল—এমন কথা কেউ বিশ্বাস করত না, সেটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়। এই চতুর্দশ সংশোধনীর ৩ নম্বর ধারা নিয়ে সে সময় কংগ্রেসে দীর্ঘ বিতর্ক হয়েছিল। সেসব বিতর্কের যাবতীয় রেকর্ডপত্র ওপরের ধারণাকেই দ্ব্যর্থহীন সমর্থন দেয়।

তবে এই যুক্তিতর্কের শেষ কোথায়, অর্থাৎ ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত ভোটে দাঁড়াতে পারবেন কি না, তার ফয়সালা হতে এখনো বাকি আছে। যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টে এ নিয়ে শুনানি হওয়ার বাকি আছে। এই ফয়সালা যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের মনে এখনো গোপন রয়ে গেছে। তবে শিগগিরই তা রায় হিসেবে প্রকাশ করা হবে। আপাতত ব্যালটে ট্রাম্পের নাম থাকছে। কারণ, কলোরাডো সুপ্রিম কোর্ট তাঁর রায়কে আগামী ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত স্থগিত রেখেছেন। ওই তারিখের আগে অঙ্গরাজ্যটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সে রাজ্যের প্রেসিডেনশিয়াল প্রাইমারির ব্যালটে প্রার্থীদের নাম সত্যায়ন করতে হবে। ফলে শেষ পর্যন্ত কলোরাডোর প্রাইমারিতে ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত দাঁড়াতে পারবেন কি না, তা স্থগিতাদেশের তারিখের আগে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট কী রায় দেবেন, তার ওপর নির্ভর করছে।

এখন কথা হলো, কলোরাডো সুপ্রিম কোর্টের রায় উচ্চ আদালতে উল্টে যাওয়ার বিরাট সম্ভাবনা আছে। কারণ, উচ্চ আদালতে কট্টর দক্ষিণপন্থী বিচারপতিদের সংখ্যা বেশি। কলোরাডোর নিম্ন আদালত ও রাজ্য সুপ্রিম কোর্টের ট্রাম্পের সংবিধানদ্রোহ–সংক্রান্ত রায় যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট খারিজ করে দিতে পারেন। নিম্ন আদালতের তদন্ত প্রতিবেদনে দ্বিমত পোষণ করার প্রবণতা সাধারণত উচ্চতর আদালতের মধ্যে দেখা যায়।

আরেকটি বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট অদ্যাবধি কোনো প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে অযোগ্য ঘোষণার ক্ষেত্রে চতুর্দশ সংশোধনীর ৩ নম্বর ধারাকে যথেষ্ট বলে রায় দেননি। ফলে কলোরাডোর সুপ্রিম কোর্টের রায় সেই প্রেক্ষাপটে উল্টে যেতে পারে। তবে এ কথাও ঠিক, বিচার বিভাগের মন ঘুরে যাওয়ার নজির আছে। যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট যদি কলোরাডোর আদালতের সিদ্ধান্তকে আমলে নেন এবং ‘অফিস’ শব্দটিকে যদি প্রেসিডেন্টের দপ্তরের আওতাভুক্ত বলে বিবেচনা করেন, তাহলে ট্রাম্পের প্রার্থিতা ঝুলে যেতে পারে।

রিচার্ড কে শেরউইন নিউইয়র্ক ল স্কুলের আইনের ইমেরিটাস অধ্যাপক

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত