শ্রীলঙ্কার দুর্যোগে বাংলাদেশের ‘আলু কূটনীতির’ সুযোগ

‘বাংলাদেশের আলু শ্রীলঙ্কায় ত্রাণ হিসেবে পাঠানো শুধু মানবিক উদ্যোগই নয়, বরং দীর্ঘ মেয়াদে বাণিজ্যিক সম্ভাবনার দরজা খুলে দিতে পারে।’ছবি: এআই দিয়ে তৈরি

ঢাকায় যখন নতুন আলুর কেজি ৬০ টাকা আর হিমাগারের আলু ৩০ টাকার কমে বিক্রি হচ্ছে, তখন শ্রীলঙ্কায় এক কেজি আলু ৫০০ রুপিতেও মিলছে না। কেন?

গত ২৮ নভেম্বর শ্রীলঙ্কার স্থলভাগে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় দিতওয়া। এরপর তিন দিন ধরে ভারী বৃষ্টি এবং ঝোড়ো বাতাসে দেশটির ২৫টি জেলা প্লাবিত হয়েছে। শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুৎ–বিভ্রাট এবং যোগাযোগব্যবস্থায় মারাত্মক ব্যাঘাত দেখা দিয়েছে। বহু বছর দেশটির মানুষ এমন ধ্বংসযজ্ঞ দেখেনি। এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা ও ভূমিধসে অন্তত ৪১০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। এখনো নিখোঁজ রয়েছেন অন্তত ৩৩৬ জন।

এদিকে পাহাড়ধসের ঝুঁকি এখনো বলবৎ থাকায় জেলাগুলোতে রেড অ্যালার্ট জারি আছে। স্থানীয় লোকজন ‘আশ্রয়কেন্দ্রে’ গাদাগাদি করে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন।

আরও পড়ুন

মানবিক সংস্থায় পৃথিবীর নানা দেশে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে সুরজকান্তি ম্যানডিজের। সুনামির সময় তামিলনাড়ুতে আমরা একসঙ্গে কাজ করেছিলাম। সুরজ জানিয়েছেন, ‘অনেক জায়গায় সম্পূর্ণ কমিউনিটি উচ্ছেদ হয়ে গেছে, অনেক পরিবার এখনো অতিরিক্ত ভিড়ের মধ্যে গা–ঘেঁষাঘেঁষি করে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে থাকছে। সবাই কঠিন অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছে। সুরজ খুবই শক্ত মনের। তবু তাঁর গলা ধরে আসে, ভেতরের কান্না চাপা থাকে না।

শ্রীলঙ্কার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র (ডিএমসি) খুবই করিতকর্মা আর আমলাতান্ত্রিকতামুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান। গত মার্চে এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পেয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সাম্পথ কোনটুওয়েগোদা। ডিএমসির মহাপরিচালক জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সমন্বয়ে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।

প্রতিবেশী দেশগুলোও যে যার সাধ্যমতো এগিয়ে আসার অঙ্গীকার করেছে। এর মধ্যে একটি দেশ তাদের গুদামে থাকা ‘পূর্ব সংরক্ষিত’ মালামাল পাঠাতে গিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ খাদ্যদ্রব্য পাঠিয়ে মহাবিপাকে পড়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এটিকে ‘সহায়তা কূটনীতির প্রহসন’ বলে ব্যাপক সমালোচনা করা হয়েছে। শ্রীলঙ্কার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং বিদেশবিষয়ক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা পরিস্থিতিটিকে ‘গুরুতর উদ্বেগের’ বিষয় বলে অভিহিত করেছেন এবং দেশটির কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা চেয়েছেন।

ত্রাণ হিসেবে শ্রীলঙ্কায় আলু পাঠালে দেশেরও কিছু লাভ হতে পারে। এতে আমাদের ভুল নীতির কারণে প্রায় পথে বসা আলুচাষিরা দেরিতে হলেও লোকসান পোষানোর একটা সুযোগ পাবেন। এবারের লোকসানে অনেকেরই আলু চাষের শখ মিটে গেছে। তাঁদের চাষে ফেরাতে না পারলে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তাও ঝুলে যাবে।

বলে রাখা ভালো, দক্ষিণ এশিয়ার ওই দেশটিই নেপালের ভূমিকম্পের পর সেখানে ‘রেডি টু ইট ‘বা তৈরি খাদ্যদ্রব্য হিসেবে টিনজাত গরুর মাংস পাঠিয়ে বেহুদা পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। বলা বাহুল্য, নেপালে সাধারণের কাছে গরুর মাংস খাদ্যবস্তু নয়।

বাংলাদেশ ইতিমধ্যে প্রায় ১০ টন ত্রাণসামগ্রী একটি চালান বিমানযোগে নেপালে পাঠিয়েছে। ত্রাণসামগ্রীর মধ্যে আছে তাঁবু, শুকনো খাবার, মশারি, টর্চলাইট, গামবুট, ভেস্ট, হাতমোজা, উদ্ধারকর্মীদের হেলমেট এবং বিপুল পরিমাণ ওষুধ। এগুলো তাদের চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল হলেও বিপদে কাজে আসবে।

বন্যা আর অকল্পনীয় ভূমিধসের আগেই মারাত্মক খরার কারণে খাদ্যনিরাপত্তা হুমকিতে ছিল শ্রীলঙ্কা। জাতিসংঘের মূল্যায়ন বলছে, চলমান পরিস্থিতিতে সেই সংকট আরও গভীর হয়েছে। এখন ১৫ লাখের বেশি মানুষ মাঝারি থেকে উচ্চ মাত্রার খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে রয়েছে।

দেশটিতে সবজির দাম ২০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। চাল ও ডালের দামও বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিস্থিতির আরও অবনতি রোধে জাতিসংঘ জরুরি সহায়তার আহ্বান জানিয়েছে। খাদ্য ও নগদ সহায়তা ছাড়াও কৃষক ও জেলেদের জন্য সহায়তা দরকার, যাতে সংকট আর না বাড়ে।

আমাদের উদ্বৃত্ত আলু শ্রীলঙ্কার খাদ্যনিরাপত্তায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে

ঢাকায় যখন নতুন আলুর কেজি ৬০ টাকা আর হিমাগারের আলু ৩০ টাকার কমে বিক্রি হচ্ছে, তখন শ্রীলঙ্কায় এক কেজি আলু ৫০০ রুপিতেও মিলছে না। বন্যার আগে প্রতি কেজি আলুর দাম ছিল ৪০০ রুপি, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৫৮ টাকার সমান। আলু তাদের আমদানি পণ্য। ২০২২ সালে সর্বশেষ হালনাগাদ অনুযায়ী শ্রীলঙ্কায় মাথাপিছু বার্ষিক আলু খাওয়ার পরিমাণ ছিল ৮ দশমিক ১২ কেজি।

সাম্প্রতিক আরেক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, শ্রীলঙ্কায় বছরে মোট প্রায় ২ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন আলু ব্যবহৃত হয়েছে। খাদ্যসংকটে আলুর চাহিদা এবং ব্যবহার সেখানে আরও বাড়বে।

শ্রীলঙ্কার আমদানি করা আলুর পাঁচ ভাগের এক ভাগ যায় বাংলাদেশ থেকে।

গত আগস্টে কলম্বোয় অনুষ্ঠিত তিন দিনের সাউথ এশিয়া ট্রেড ফেয়ারে বাংলাদেশের আলু অনেকের আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল। উদ্বোধনের দিন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী দীনেশ গুনাবর্ধনে বাংলাদেশ স্টলে এসে আলু রপ্তানিকারকদের ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। পরিদর্শনের সময় তিনি বাংলাদেশে উৎপাদিত বিভিন্ন জাতের আলু সম্পর্কে তথ্য নেন এবং বাংলাদেশে উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের আলু ও এর পুষ্টি গুণাগুণ তাঁকে ব্যাখ্যা করা হয়।

কেন আমরা আলু পাঠাব

বাংলাদেশের আলু শ্রীলঙ্কায় ত্রাণ হিসেবে গেলেও সেখানে নতুন করে একটা বাজার তৈরি হবে। মানুষ জানবে বাংলাদেশ ভালো আর কম দামে আলু রপ্তানি করতে পারে।

আগেও নেপালের দুর্দিনে বাংলাদেশ বিমানযোগে তেল পাঠিয়েছিল। বিমানে আর কতটুকুই–বা তেল পাঠানো যায়! কিন্তু দুঃসময়ে পাশে দাঁড়ানো মনে রেখেছিল নেপালের লোকেরা। পরবর্তী সময়ে দুই দেশের বাণিজ্যেও তার প্রতিফলন আমরা দেখেছি।

ত্রাণ হিসেবে শ্রীলঙ্কায় আলু পাঠালে দেশেরও কিছু লাভ হতে পারে। এতে আমাদের ভুল নীতির কারণে প্রায় পথে বসা আলুচাষিরা দেরিতে হলেও লোকসান পোষানোর একটা সুযোগ পাবেন। এবারের লোকসানে অনেকেরই আলু চাষের শখ মিটে গেছে। তাঁদের চাষে ফেরাতে না পারলে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তাও ঝুলে যাবে।

বাংলাদেশের আলু শ্রীলঙ্কায় ত্রাণ হিসেবে পাঠানো শুধু মানবিক উদ্যোগই নয়, বরং দীর্ঘ মেয়াদে বাণিজ্যিক সম্ভাবনার দরজা খুলে দিতে পারে। এতে বাংলাদেশি আলুর মান ও প্রতিযোগিতামূলক দামের কথা আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত হবে। একই সঙ্গে কৃষককে টিকিয়ে রাখা, উৎপাদন ধরে রাখা এবং ভবিষ্যতে রপ্তানি বৈচিত্র্য বাড়ানোর ক্ষেত্রেও এটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

  • গওহার নঈম ওয়ারা লেখক, গবেষক। ই–মেইল: [email protected]

*মতামত লেখকের নিজস্ব