বাজেট প্রণয়নে যে বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে

বাজেট নিয়ে যতই আদর্শিক কথাবার্তা বলি না কেন, বাংলাদেশের মতো বিকাশমান বা উন্নয়নশীল দেশে দিনের শেষে বাজেট মূলত সরকারের আয়-ব্যয়ের হিসাব, কিছুটা উন্নয়ন অর্থায়নের পরিকল্পনা, সাধারণ জনগণকে কিছুটা আশ্বস্ত আর কিছুটা সহায়তা করার রূপকল্পতেই পরিণত হয়।

অতীতে বাজেট প্রণয়ন, বিশেষ করে গুণগত মান বজায় রেখে বাজেট বাস্তবায়ন বেশ কঠিন হলেও উন্নয়ন সহযোগী, বিশেষত বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় আমাদের সিভিল ব্যুরোক্রেসি বা সরকারি কর্মকর্তারা ধীরে ধীরে অনেকটা দক্ষ হয়ে উঠেছেন। মাঠপর্যায়ে তহবিল বা বরাদ্দ ব্যবস্থাপনায়ও মুনশিয়ানা এসেছে।

তা সত্ত্বেও অনেকটা স্বল্প অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আয় বা স্বল্প পুঁজির দেশে সক্ষমতা–ঘাটতি এবং সম্পদ ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতির কারণে প্রায়ই আমাদের সাফল্যে বাধা পড়ে। বাজেট বাস্তবায়নে আমরা আকাঙ্ক্ষিত ফলাফল নিশ্চিত করতে পারি না। অপরিকল্পিত আর ছোট ছোট প্রকল্পের ভারে আমাদের মূল উদ্দেশ্য হয় ব্যাহত। স্থানীয় রাজনৈতিক প্রাধান্যের কাছে অর্থনৈতিক প্রাধান্য হয় প্রায়ই পরাজিত হয়। বৃহত্তর জনস্বার্থ হয় অবহেলিত।

আরও পড়ুন
মূল্যস্ফীতির চাপে নিম্ন আয়ের মানুষ খুব কষ্টে আছে। তাই এ শ্রেণির মানুষকে স্বস্তি দিতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানোর পাশাপাশি প্রচলিত ধারায় ব্যয় বাড়াতে হবে ওএমএস কার্যক্রমে

উপরিউক্ত বাস্তবতার পাশাপাশি বেশ কিছুদিন ধরেই চাপে রয়েছে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক। এমন পরিস্থিতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে ইতিমধ্যে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাজেটের আকার নিয়ে বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফের সাবধানবাণীর আগে থেকেই ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নেও অনেক ক্ষেত্রে ব্যয় সংকোচনমূলক নীতির পথে হাঁটছে সরকার।

সংকোচনমূলক নীতির কারণে চলতি অর্থবছরের তুলনায় বাজেটের আকার বাড়ছে খুব সামান্য। চলতি বাজেটের তুলনায় এই আকার বাড়ছে মাত্র ৪ দশমিক ৬২ শতাংশ। পত্রপত্রিকার খবরে জানা গেছে, আগামী বাজেটের আকার ধরা হচ্ছে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেটের আকার আগের অর্থবছরের তুলনায় বেড়েছিল ১২ দশমিক ৩৫ শতাংশ।

আরও পড়ুন

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রের তথ্যানুসারে, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাস পর্যন্ত অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো বেশ চাপে থাকায় সরকারের ব্যয়ে বড় ধরনের কাটছাঁট করে সম্প্রতি বাজেট সংশোধন করা হয়েছে। প্রায় দুই বছর ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার বাড়ানোসহ সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। এবার একই উদ্দেশ্যে সরকারি ব্যয়ও কমানো হচ্ছে।

জানা গেছে, বর্তমানে রাজস্ব আদায়ে জ্ঞাত ঘাটতি সত্ত্বেও নতুন বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৫ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে ২ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বাজেট–ঘাটতি মেটানোর লক্ষ্যমাত্রাও নির্ধারণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ১ লাখ কোটি টাকার বিদেশি ঋণ পাওয়া যাবে বলে আশা করছে সরকার। বাকি ১ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকা দেশের ব্যাংকিং খাতসহ অন্যান্য উৎস থেকে ঋণ নেওয়া হবে।

এ ছাড়া বেশ কয়েক মাস মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে থাকলেও আগামী অর্থবছরে এটি গড়ে সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যে রাখতে চায় সরকার। একই সঙ্গে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

আমাদের হয়তো জানা আছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট দেয় সরকার। তবে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় চলতি বাজেট বাস্তবায়নের শুরুতেই টাকা খরচের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ওপর কয়েকটি বিধিনিষেধ দেওয়া হয়। তা ছাড়া জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা। এসবের প্রভাবে অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে মোট বাজেটের মাত্র ২৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ ব্যয় হয়েছে।

অন্য একটি সূত্রে জানা গেছে, ৯ মাসে তার পরিমাণ ৪২ শতাংশ। এমন পরিস্থিতিতে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে সরকারি ব্যয় প্রায় ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ কমানো হয়েছে। যেখানে গত অর্থবছর সংশোধিত বাজেটে ব্যয় কমানো হয়েছিল মাত্র ২ দশমিক ৫৯ শতাংশ।

অনেকেরই ধারণা, বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারি ব্যয় বাড়ানোর সুযোগ নেই। বিশেষ করে এই মুহূর্তে খুব প্রয়োজন নেই—এমন উন্নয়ন প্রকল্প হাতে না নেওয়াই উচিত। একই সঙ্গে এসব ব্যয়ে আরও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।

মূল্যস্ফীতির চাপে নিম্ন আয়ের মানুষ খুব কষ্টে আছে। তাই এ শ্রেণির মানুষকে স্বস্তি দিতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানোর পাশাপাশি প্রচলিত ধারায় ব্যয় বাড়াতে হবে ওএমএস কার্যক্রমে। তা ছাড়া সার্বিকভাবে অর্থনীতির জন্য কিছু খারাপ হলেও মূল্যস্ফীতির কশাঘাত থেকে জনগণকে কিছুটা হলেও সুরক্ষা দিতে নীতি সুদহারের পাশাপাশি ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার আরও বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ বাড়াতে আমদানিকারকদের আলোচিত সিন্ডিকেট ভাঙার পাশাপাশি যথাযথভাবে মনিটরিং কার্যক্রমও পরিচালনা করতে হবে।

তারপরও শুধু ব্যয় সংকোচন আর কিছু প্রকল্প কাটছাঁট করলেই আকাঙ্ক্ষিত ফল মিলবে না। রাজস্ব আয় বাড়ানো ও ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন প্রণোদনার জন্য ব্যাপক সংস্কারেরও যে কোনো বিকল্প নেই, সে কথাও জোরের সঙ্গে বলা হচ্ছে।

উচ্চারিত হচ্ছে, ‘হোয়াই উই আর পুওর বিকজ উই আর পুওর’ বা সক্ষমতার অভাব, এমনকি ‘হোয়াট টুক আস হেয়ার মে নট টেক আস দেয়ার’ বা যে অর্জন বা দাওয়াইগুলো আমাদের সাফল্যের এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে, সেই একই দাওয়াই আমাদের ভবিষ্যতে সম্ভাব্য গন্তব্যে না–ও নিয়ে যেতে পারে।

এর জন্য প্রয়োজন সরকার, ব্যক্তি খাত আর উন্নয়ন সহযোগীদের সম্মিলিত প্রয়াস। প্রয়োজন বাজেট প্রণয়ন, বিশেষ করে সম্পদ সঞ্চালন ও সঠিক ব্যবহারে অভিনব উদ্যোগ। বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোয় আরও জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার প্রতিফলন প্রয়োজন।

● মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক