পাট বেচে কৃষক কি ফুলতোলা শাড়ি কিনতে পারবে না

কুড়িগ্রামের কৃষক বলছেন, গতবারের চেয়ে এবার পাটের উৎপাদন বেশি হলেও দাম কম
ফাইল ছবি

চরশাখাহাতী। গত এক মাসে ৩০ বছর বয়সী চরের পশ্চিম ও উত্তর অংশের অর্ধেক ব্রহ্মপুত্রে পেটে চলে গেছে। এখনো ভাঙছে। চতুর্দিকে বাড়ি ভাঙার হাহাকার। আগে চরের পশ্চিম দিকের ঘাট থেকে চরশাখাহাতী স্কুলে পৌঁছাতে লাগত আধা ঘণ্টা, এখন দুই মিনিট। স্কুলটা থাকবে কি না, ঠিক নেই।

মিলন মিয়া (৩৪)। ওই চরের স্কুলের দপ্তরি ও কৃষক। তিনি বলেন, ‘৯০ ভাগ লোকের পাট নাই। খরায় গাছ মরে গেছে। মাত্র ১০ ভাগ লোকের খেত টিকছে। তারা মেশিন দিয়ে সেচ দিছে। বিঘাপ্রতি (৬৩ শতক) ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা লস হইছে। তিন হাল দেওয়া লাগছে। প্রতি হাল ৯০০ টাকা। ৫০০ টাকার বীজ, সার বাবদ ৩ হাজার। নিড়ানি যারা দিছে, তাদের ৪ হাজার আর যারা ঘাস মারা বিষ দিছে, তাদের ১ হাজার ২০০। মানে সাড়ে ৭ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পুরাই ক্ষতি।’

মিলন মিয়া আরও বলেন, যাঁরা আবাদ তুলতে পেরেছেন, তাঁদের পানি, আঁশ ছড়ানো, শুকানোর বাড়তি খরচ তো গেছে। এক বিঘা জমিতে ঘণ্টা তিনেক পানি দেওয়া লাগছে তিনবার। ১ ঘণ্টায় নেয় ৩০০ টাকা। মানে পানি বাবদ গেছে ২ হাজার ৭০০ টাকা। আঁশ ছড়ানোর জন্য লাগছে ৯ জন কামলা। ৬০০ টাকার নিচে কামলা নেই। এখানে গেছে ৫ হাজার ৪০০ টাকা।

মিলন মিয়ার হিসাবে, ‘পাটের গাছোত এবার ডাল হইছিল, পানি না পায়া গাছ ছোট হইছে। আগের বছর বিঘায়, মানে ৬৩ শতকে আসছিল ১৬ থেকে ১৭ মণ, এবার ১০ থেকে ১২ মণ। খরচ উল্টো বাড়ছে।’

এখন উপজেলা ও জেলা শহর থেকে পাট ক্রয়কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। খোদ চিলমারীতেই পাট প্রক্রিয়াজাতকরণের কারখানা ছিল ১০ থেকে ১২টি। সেই জায়গাজমি এখন ভোগ করছে প্রভাবশালীরা। কৃষক কি পাট বেচে ফুলতোলা শাড়ি কিনতে পারবে না? বাংলাদেশ কি ভুলে গেছে তার জন্মের দফা!

জোড়গাছ হাটে বুধবার হাট বসে। নদীর তীরের পাটের স্তূপ। হাটুরেদের চলাচলে অসুবিধা। তবু সবাই যুগ যুগ ধরে এসব মেনে নিয়েছেন। সেখানেই দেখা জাহেদুল আলমের (৪৫) সঙ্গে। হাটেই পাট কেনেন, হাটেই পাট বেচেন। তিনি বলেন, ‘গতবারের চেয়ে এবার পাটও ভালো, আবাদও কম হইছে। তবু গতবারের চেয়ে দাম কম। দাম কমি গেইছে না! দাম ২ হাজার ৪৫০, মাঝারি ২ হাজার ২০০ আর খারাপটা ১ হাজার ৯০০ টাকা।’

জিয়া মিয়া (৪৩)। দেখা হলো জোড়গাছ হাটেই। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন ১৯৯৩ সালে। নদীভাঙনের পর পড়ালেখাই বাদ। এখন গয়ছল (চেয়ারম্যান) মহাজনের পাট কেনেন। জিয়া মিয়া বলেন, ‘গতবার ৩ হাজার ২০০ টাকায় কেনা ৫০০ মণ পাট এলাও ঘরোত আছে। আগস্ট মাসের প্রথম দিকে চলেছে ২ হাজার ৭০০, পরে ২ হাজার ৬০০, তারপরে ২ হাজার ৪০০। সেপ্টেম্বরে ২ হাজার ৪০০–তেও নেয় না।’

ফোনে কথা হয় মুখ্য পাট পরিদর্শক ফিরোজ মাহমুদের সঙ্গে। তখন তিনি ছিলেন রৌমারী হাটে। তিনি জানান, এ বছর পাটের মান ভালো। বৈশ্বিক কারণে পাটের দাম কমে গেছে। দেশীয় বাজারে পাটের চাহিদা তৈরির চেষ্টা তাঁরা করছেন। ১৯টি পাটজাত পণ্য আছে, সেগুলোর ব্যবহার বৃদ্ধির দিকে নজর দিচ্ছেন। আর কুড়িগ্রামে যে একমাত্র চটকলটি আছে, পুরোনো যন্ত্রপাতি হওয়ায় তার সক্ষমতাও অনেক কম। তবে একটি বেসরকারি কোম্পানি দৈনিক ৬০০ টন পাটজাত পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে নামছে, এটা আশার খবর।

রংপুর শহরের পাট ব্যবসায়ী সুপেন চন্দ্র সাহা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, বর্তমানে তাঁরা প্রতি মণ পাট ২ হাজার ১০০ থেকে ২ হাজার ৩০০ টাকা দরে কিনছেন। বিদেশে পাট যাচ্ছে না, তাই তাঁরা পাট কিনে গুদামজাত করে রাখছেন। কৃষকদের কাছ থেকে কেনা পাট তাঁরা জুট মিলে বিক্রি করতে পারবেন কি না, এরও কোনো নিশ্চয়তা নেই।
সুপেন চন্দ্র সাহা আরও বলেন, ‘গত বছর কৃষকদের কাছ থেকে প্রতিমণ পাট ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকা দরে কিনেছিলাম। বিদেশে পাট রপ্তানি হওয়ায় লাভবানও হয়েছিলাম। এ বছর আমি ৫ হাজার মেট্রিক টন পাট কেনার প্রস্তুতি নিয়েছি। গত বছর কিনেছিলাম ৭ হাজার মেট্রিক টন।’

জোড়গাছ হাট কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার বিখ্যাত হাট। ব্রহ্মপুত্র নদের সব কটি চর থেকে এখানে চাষিরা আসেন। পাট নিয়ে ফুলমিয়ারা কেউ এসেছেন রৌমারীর ফলুয়ার চর থেকে, কেউ দাঁতভাঙা থেকে। তাঁরা জানান, পাট বেচেয়া কিছুই থাকে না বাহে!

‘কইন্যা, তুই ভাবিত করিস কী/ চিন্তা করিস কী/ এবার পাটা বেচেয়া কিনিয়া দেইম তোক/ ফুলতোলা শাড়ি।’ গানটি জনপ্রিয় ভাওয়াইয়াশিল্পী কছিম উদ্দীনের। পাট বিক্রির টাকা দিয়ে পূর্ব বাংলার কৃষকের সন্তানেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেছেন। এই সন্তানেরাই পরে ভাষা আন্দোলন করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে। সেই গণ-অভ্যুত্থানের ১১ দফার দু–দুটি দফা ছিল পাট নিয়ে: ব্যাংক, বিমা, পাটকলসহ সব বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণ ও কৃষকদের ওপর থেকে কর ও খাজনা হ্রাস এবং পাটের সর্বনিম্ন মূল্য ৪০ টাকা ধার্য করা। মানে বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে পাটের দামের সম্পর্ক ছিল। চিলমারী বন্দরে কবি আরিফ আখতার (৩৭) বলেন, ‘আগে রাজনৈতিক দলগুলো পাটের দাম নিয়া কথা বলত, এখন কেউ বলে না।’

এখন উপজেলা ও জেলা শহর থেকে পাট ক্রয়কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। খোদ চিলমারীতেই পাট প্রক্রিয়াজাতকরণের কারখানা ছিল ১০ থেকে ১২টি। সেই জায়গাজমি এখন ভোগ করছে প্রভাবশালীরা। কৃষক কি পাট বেচে ফুলতোলা শাড়ি কিনতে পারবে না? বাংলাদেশ কি ভুলে গেছে তার জন্মের দফা!