গ্রামের স্কুলে নারীবান্ধব টয়লেট, মাসিকভীতি থেকে মিলেছে মুক্তি

দেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনো নারীবান্ধব টয়লেটের সুব্যবস্থা নেই। পুরুষশাসিত সমাজে নারীর এই মৌলিক চাহিদার বিষয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সুদীর্ঘকাল ধরে উপেক্ষিত হচ্ছে। এ রকম বাস্তবতায় গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রামের মেয়েরা আধুনিক স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট–ব্যবস্থার সুযোগ পেলে তারা অনেক বেশি দ্বিধাহীন এবং পড়াশোনায় মনোযোগী হতে পারে। নারীবান্ধব টয়লেট স্কুলছাত্রীদের জীবনে কী ইতিবাচক পরিবর্তন এনে দিতে পারে, তা নিয়ে লিখেছেন সৈয়দ সা’দ আন্দালিবমু. ইব্রাহীম খলিল

ঝালকাঠী জেলার গ্রামীণ এলাকায় ছেলেমেয়ে একত্রে পড়াশোনা করে এমন একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে তিন বছর আগে মেয়েদের জন্য আলাদা একটি টয়লেট স্থাপন করা হয়। নারীর প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে সামাজিক কুসংস্কার ও পরিচ্ছন্নতাবিষয়ক সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য এটি স্থাপন করার চিন্তা করা হয়।

নারীবান্ধব একটি টয়লেট যে কিশোরীদের আত্মবিশ্বাসী ও জীবনের প্রতি আস্থাশীল করে তুলবে এবং আরও অনেক উপকারে আসবে, সেটিও বোধগম্য ছিল। এ ছাড়া প্রকল্পটির উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষক, মা-বাবা, স্কুলটি যে এলাকায় অবস্থিত, সেখানকার স্থানীয় নেতারা, এমনকি কিশোরদের মনোভাব পরিবর্তন করা।

টয়লেটটি নির্মাণের পরপরই করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়ায় নারীবান্ধব টয়লেটটির প্রভাব জানা–বোঝার বিষয়টি স্থগিত রাখতে হয়। দুই বছর বিরতির পর ২০২২ সালে আবার স্কুল খোলা হয়। এরপর প্রকল্পটি মেয়েদের জীবনে কী প্রভাব ফেলেছে, সে বিষয়ে মূল্যায়ন করার কাজ হাতে নেওয়া হয়।

বাইরে একটি কক্ষ দ্বারা বেষ্টিত টয়লেটটিতে প্রবহমান পানির সুবিধাসহ দুটি ওয়াশরুম আছে। সেখানে স্যানিটারি প্যাড, সাবান ও লিকুইড হ্যান্ডওয়াশ রাখা আছে। যখন প্রয়োজন, মেয়েরা তাদের ব্যবহৃত প্যাডটি পরিবর্তন করতে পারে এবং ব্যবহৃত প্যাড পলিব্যাগে মুড়িয়ে একটি নির্দিষ্ট ঝুড়িতে ফেলতে পারে। এ ছাড়া মাসিকের তারিখ লেখার জন্য সেখানে একটি হোয়াইট বোর্ডও রয়েছে। একটি কক্ষ দ্বারা পরিবেষ্টিত দুটি ওয়াশরুম বাইরের কারও নজর এড়িয়ে মেয়েদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা প্রদান করে।

এই লেখায় আমরা তুলে ধরব টয়লেটটি স্কুলের মেয়েদের জীবনে কী ধরনের প্রভাব ফেলেছে। একটি কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নমালা ব্যবহার করে গুণগত সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে স্কুল প্রাঙ্গণে অষ্টম থেকে দশম শ্রেণির ছাত্রীদের কাছ থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে এই গবেষণা পরিচালনা করা হয়।

এ ক্ষেত্রে স্কুলের মেয়েদের জীবনে, বিশেষ করে স্কুলে উপস্থিতি, শ্রেণিকক্ষে মনোযোগ, তাদের শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং মাসিকের সময়ে তারা যেসব প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে—এ বিষয়গুলো জানার চেষ্টা করা হয়েছে। কয়েকটি বিষয়বস্তুর আওতায় এই আলোচনা করা হলো।

নীরবতা ভঙ্গ

একজন ছাত্রী জানান, অতীতে মেয়েদের পিরিয়ড বা মাসিক বিষয়ে সমাজের অন্যান্য স্থানের মতো স্কুলেও আলোচনা একটি ‘নিষিদ্ধ’ বিষয় ছিল। এটি বয়ঃসন্ধিকালীন মেয়েদের শারীরবৃত্তীয় একটি সাধারণ প্রক্রিয়া ও সুস্থতার লক্ষণ। এরপরও অভিভাবক কিংবা শিক্ষক—কেউই স্কুলে এটি নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন না।

স্কুলগামী মেয়েরা তাদের ব্যাগে স্যানিটারি প্যাড আনতে চাইত না। বরং মাসিকের সময়ে তারা স্কুলে না এসে বাড়িতে অবস্থান করতে পছন্দ করত। নারীবান্ধব টয়লেটটি নির্মাণের পর নারী শিক্ষকেরা এটি ব্যবহার বিষয়ে স্কুলের মেয়েদের ধারণা প্রদান করেন। ফলে পরিচ্ছন্নতা এখন স্কুলে একটি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বড়-ছোটনির্বিশেষে মেয়েরা এখন তাদের মধ্যে মাসিক বিষয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে আলোচনা করে। অভিভাবকেরাও বিষয়টি নিয়ে মেয়েদের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলেন। এভাবে একটি ‘নিষিদ্ধ’ বিষয় স্কুলে এখন স্বাভাবিক আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে।

দুর্গন্ধ থেকে পরিত্রাণ

স্কুলের মেয়েরা জানায়, অপরিচ্ছন্নতা ও অনবরত দুর্গন্ধ ছড়ানোর কারণে আগে তারা স্কুলের টয়লেট ব্যবহার করতে অস্বস্তি বোধ করত। নির্মাণকাজে ত্রুটি, প্রবহমান পানি ও টয়লেট পেপারের অভাব ছিল মূল সমস্যা।

এ ছাড়া ছাত্রীর তুলনায় টয়লেটের সংখ্যা কম হওয়ার কারণে কখনো কখনো তাদের লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হতো। এতে কারও কারও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বিঘ্নিত হতো। উপরন্তু পুরোনো টয়লেটে ব্যবহৃত স্যানিটারি প্যাড ফেলানোর কোনো পাত্র বা ঝুড়ি ছিল না। বর্তমানে নারীবান্ধব টয়লেটটির ভেতরে এসব সুবিধাসহ যেমন পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ রয়েছে, তেমনি মেয়েরা দুর্গন্ধ থেকে পরিত্রাণ পেয়েছে।

মাসিকভীতি থেকে মুক্তি

একজন ছাত্রী জানায়, ‘একদিন আমি আমার তলপেটে ব্যথা অনুভব করতে লাগলাম। আমি টয়লেটে গিয়ে দেখি আমার পিরিয়ড শুরু হয়ে গেছে। আমি বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেলাম এবং স্কুল থেকে বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।’

মেয়েদের কেউ কেউ জানায়, তারা তাদের মাসিক শুরুর তারিখ সব সময় মনে রাখতে পারে না। আবার এটি সময়মতো শুরু না–ও হতে পারে। তা ছাড়া এক মাস থেকে অন্য মাসে মাসিকের তারিখ পরিবর্তন হতে পারে। কখনো হঠাৎ পিরিয়ড শুরু হয়ে যায়। ফলে তারা মানসিক চাপে ভোগে। বাড়ি থেকে স্যানিটারি প্যাড ব্যাগে বহন করে নিয়ে আসতেও তারা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না।

তবে এখন টয়লেটের ভেতরে স্যানিটারি প্যাড থাকার কারণে তারা খুব সামান্যই মানসিক চাপে ভোগে। ফলে পিরিয়ড শুরু হলেও তাদের আর স্কুলে যাওয়া বন্ধ করতে হয় না কিংবা স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে আসতে হয় না। টয়লেটের ভেতরে হোয়াইট বোর্ড থাকায় তারা সেখানে মাসিক শুরুর তারিখও লিখে রাখতে পারে। এসব সুবিধা তাদের মাসিকভীতি থেকে মুক্তি দিয়ে স্কুলে উপস্থিতি স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তুলেছে।

স্কুলে উপস্থিতি এবং ক্লাসে মনোযোগ বৃদ্ধি

ইতিপূর্বে মানসম্মত টয়লেটের অভাবে মেয়েরা সারা দিন অস্বস্তি বোধ করত। অস্বস্তি আরও বৃদ্ধি পেত যদি হঠাৎ মাসিক শুরু হয়ে যেত। ফলে তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে যেত এবং ক্লাসে মনোযোগী হতে পারত না। এ ছাড়া তারা নিয়মিত স্কুলে উপস্থিত হতেও পারত না। কেউ কেউ বেশ কয়েক দিন স্কুলে উপস্থিত হতে পারত না। ক্লাসে অনুপস্থিতি তাদের লেখাপড়ায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলত।

এখন মাসিক শুরু হলেও আর তাদের বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকতে হয় না। স্কুলে হঠাৎ মাসিক শুরু হলেও তারা অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এখন স্বাভাবিক সময়ে বাড়ি যেতে পারে।

স্যানিটারি প্যাডের ব্যবহার বেড়েছে

আগে মেয়েরা মাসিকের সময়ে স্যানিটারি প্যাডের পরিবর্তে পুরোনো কাপড় ও অস্বাস্থ্যকর কিছু ব্যবহার করত। পুরোনো কাপড় পরিচ্ছন্ন না হলে ইনফেকশন দেখা দিতে পারত। অধিকন্তু স্কুলে সে রকম পরিবেশ না থাকায় তারা প্যাড পরিবর্তনও করতে পারত না। তারা এখন স্কুলে বিনা মূল্যে প্যাড পাচ্ছে। এটি তাদের জীবনকে সহজ করেছে বলে মেয়েরা মন্তব্য করেছে।

ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও নিরাপত্তাবোধ বৃদ্ধি

ছেলেদের সঙ্গে একসঙ্গে স্কুলে অধ্যয়নের ক্ষেত্রে মেয়েদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সাবান ও অন্যান্য প্রসাধনীর পাশাপাশি ব্যবহৃত প্যাডগুলো নিঃসংকোচে পরিবর্তন ও সেগুলো পরিবেশসম্মতভাবে ফেলে দেওয়ার সুযোগ তাদের জন্য অত্যন্ত স্বস্তিদায়ক।

নারীবান্ধব টয়লেটটি এখন ছেলেদের টয়লেট থেকে দূরে অবস্থিত হওয়ায় মেয়েরা খুবই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে থাকে। টয়লেটে কোনো সমস্যা দেখা দিলে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেগুলো সমাধানে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। এটি প্রকৃতপক্ষেই তাদের জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন এনে দিয়েছে বলে ছাত্রীরা মতামত দিয়েছে। মেয়েরা মনে করে, নবনির্মিত নারীবান্ধব টয়লেটটি তাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সুরক্ষায় ও স্কুলে যেতে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে।

মানসিক প্রশান্তি

মেয়েরা জানায়, আগে মাসিকের সময়ে তাদের মধ্যে অস্থিরতা কাজ করত ও লজ্জাবোধ হতো। এখন স্কুলে তাদের জন্য প্রবহমান পানি, প্যাড, প্রসাধনীসহ পরিচ্ছন্ন ও আরামদায়ক একটি টয়লেট রয়েছে। এখানে তারা প্রয়োজনমতো প্যাড পরিবর্তন করতে পারে। ফলে স্কুলে এখন তাঁরা দৈহিকভাবে সতেজ ও মানসিকভাবে প্রফুল্ল বোধ করে। তারা মনে করে, নারীবান্ধব টয়লেটটি স্থাপনের ফলে তাদের জীবন আগের তুলনায় অনেক ভালো হয়েছে।

শেষ কথা

ওপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে একটি সাধারণ, কার্যকর ও সুরক্ষিত টয়লেট স্কুলছাত্রীদের জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন এনে দিতে পারে। পুরুষশাসিত সমাজে নারীর এই মৌলিক চাহিদার বিষয়টি বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সুদীর্ঘকাল ধরে উপেক্ষিত হচ্ছে। এ রকম একটি বাস্তবতায় একটি গ্রামের মেয়েরা আধুনিক স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট–ব্যবস্থার সুযোগ পেলে তারা অনেক বেশি দ্বিধাহীন এবং পড়াশোনায় মনোযোগী হতে পারবে।

বাংলাদেশের একটি সাধারণ গ্রামের স্কুলের এই দৃষ্টান্ত ও এর প্রভাব অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। নারীদের জন্য এ ধরনের টয়লেট–ব্যবস্থা বা টয়লেটে নারী স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রাথমিক কিন্তু অতিপ্রয়োজনীয় সমস্যার সমাধান করতে পারলে তাদের জীবন অনেক বেশি স্বচ্ছন্দময় ও অবাধ হবে। ফলে এটি আমাদের দেশে ক্রমশ এগিয়ে আসা কর্মজীবী মেয়েদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক অভ্যাসে পরিণত হবে। সে ক্ষেত্রে একজন নারীর অনেক কর্মঘণ্টা সাশ্রয় হবে। এটি নিঃসন্দেহে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে অবশ্যই ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

  • ড. সৈয়দ সা’দ আন্দালিব ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ইমেরিটাস, পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র; সাবেক ফ্যাকাল্টি, আইবিএ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক উপাচার্য, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

  • ড. মু. ইব্রাহীম খলিল সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি ব্রজমোহন কলেজ, বরিশাল