মানব উন্নয়ন মানেটা কী?

বৈষম্যহীন বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের কথাই সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে স্থিত। তাই মানব উন্নয়ন বিষয়টি উঠে আসছে দেশের বর্তমান সংস্কারের আলোচনায়। যেমন আইন সংস্কারে মানব উন্নয়নের কথা আসছে মানুষের সম-অধিকারের পরিপ্রেক্ষিতে, জনপ্রশাসন সংস্কারের ক্ষেত্রে সেটি আসছে মানুষের অংশগ্রহণের বলয়ে, ব্যাংক-ব্যবস্থার বিষয়ে মানুষকে সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে মানব উন্নয়নটি প্রাসঙ্গিক।

প্রশ্ন উঠতে পারে, তা এত যে মানব উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে, মানব উন্নয়ন বিষয়টি কী? প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন সন্দেহ নেই। কারণ, আমরা অনেক সময়ই মানব উন্নয়নকে মানবসম্পদ উন্নয়নের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলি। ন্যূনতম মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণকেও অনেক সময় মানব উন্নয়নের সমার্থক বলে মনে করা হয়। ‘মানবকল্যাণই কি মানব উন্নয়ন?’—এমনটাও ভাবা হয় কখনো-সখনো।

আসলে কিন্তু মানব উন্নয়নের সংজ্ঞাটি ‘মানবসম্পদ উন্নয়ন’, ‘ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা’, কিংবা ‘মানবকল্যাণ’-এর ধারণা থেকে ব্যাপক ও বিস্তৃততর। মানবসম্পদ উন্নয়ন মানুষকে উৎপাদনপ্রক্রিয়ার একটি উপকরণ হিসেবেই দেখে, কিন্তু সেই প্রক্রিয়ার সুফলভোগী হিসেবে দেখে না।

ন্যূনতম মৌলিক চাহিদার ধারণাটি অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়ের মতো মানুষের সনাতন প্রয়োজনগুলো মেটানোর কথা বলে, কিন্তু মানুষের সক্ষমতা প্রসারের কথা বলে না। মানবকল্যাণ মানুষকে নিষ্ক্রিয় গ্রহীতা হিসেবে বিবেচনা করে, কিন্তু তাকে উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে বিবেচনা করে না।

মানব উন্নয়নের ধারণাটি উপরিউক্ত তিনটি ধারণার চেয়ে ব্যাপক ও বিস্তৃত। এককথায়, মানব উন্নয়ন মানে হচ্ছে মানুষের চয়নের ক্ষেত্রটি প্রসারিত করার প্রক্রিয়া এবং তা থেকে লব্ধ ফল। এখন মানুষের চয়নের ক্ষেত্রটি বর্ধিত করতে হলে দুটি জিনিস লাগবে—একদিকে মানুষের সক্ষমতার বিস্তার, অন্যদিকে সেই সক্ষমতা ব্যবহারের জন্য সুযোগের সৃষ্টি।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানুষের সক্ষমতা বাড়ানো যাবে এবং কর্মে নিয়োজন, উদ্যোক্তা সৃষ্টি এবং উদ্যোক্তা ঋণের মাধ্যমে সুযোগ তৈরি করা যাবে। সক্ষমতা ও সুযোগের মধ্যে যখন একটি ভারসাম্য থাকে, তখন মানব উন্নয়ন বর্ধিত হয়। সক্ষমতা যদি সুযোগের চেয়ে বেশি হয়, তাহলে সক্ষমতা নষ্ট হবে, অন্যদিকে সুযোগ যদি সক্ষমতার চেয়ে বেশি হয়, তাহলে সুযোগ নষ্ট হবে।

চূড়ান্ত বিচারে, মানব উন্নয়ন হচ্ছে মানুষের উন্নয়ন, মানুষের জন্য উন্নয়ন এবং মানুষের দ্বারা উন্নয়ন। মানুষের উন্নয়ন মানে মানবসম্পদের উন্নয়ন, মানুষের জন্য উন্নয়ন মানে উন্নয়নের সুফল সুষ্ঠু ও সমভাবে প্রত্যেকটি মানুষের কাছে সহজলভ্য করা এবং মানুষের দ্বারা উন্নয়ন মানে উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় মানুষ একটি নিষ্ক্রিয় উপাদান হবে না, বরং একটি সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে।

সুতরাং মানব উন্নয়নের ধারণা ‘মানবসম্পদ উন্নয়ন’, ‘ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা’, ‘মানবকল্যাণের’ ধারণাগুলো থেকে বিস্তৃততর। চয়নের ক্ষেত্র বিস্তার ও সক্ষমতার বৃদ্ধি যদি মানব উন্নয়নের ভিত্তিভূমি হয়, তাহলে প্রশ্ন ওঠে, কোন সক্ষমতার বৃদ্ধি।

এত দিন ধরে তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক দিক থেকে মানুষের যে সক্ষমতার ওপরে জোর দেওয়া হয়েছে, সেটা হচ্ছে তার জীবনযাত্রার মান কিংবা তার বস্তুগত কুশল।

তাই শিক্ষার কথা এসেছে, বলা হয়েছে স্বাস্থ্য ও পুষ্টির কথা, গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে আয় ব্যাপারটির ওপর। এর মানে হচ্ছে, মানব উন্নয়নে মানুষের কুশলকে একরৈখিকভাবে দেখা হয়নি। সেই সঙ্গে সবকিছুকে আয়ের নিরিখেও বিচার করা হয়নি। বলা প্রয়োজন যে মানব উন্নয়নের ধারণায় আয়ের ভূমিকাকে খাটো করে দেখা হয় না, কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও পরিষ্কার করে দেওয়া হয় যে আয়ই মানব উন্নয়নের একমাত্র নির্ধারক নয়।

এ সবকিছুর পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি কথা সুস্পষ্ট। প্রথমত, মানব উন্নয়ন একটি প্রক্রিয়া এবং চূড়ান্ত ফলাফলও। দ্বিতীয়ত, আয় মানুষের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক, কিন্তু একমাত্র নিয়ামক নয়।

আয় মানবজীবনের নানান মাত্রিকতার উন্নয়নের জন্য একটি উপকরণমাত্র। তৃতীয়ত, মানব উন্নয়নের মৌলিক দিকগুলো—শিক্ষা, স্বাস্থ্য অর্জিত হলে উন্নয়নের অন্যান্য দিকগুলোর অর্জন ত্বরান্বিত হয়। চতুর্থত, যেহেতু মানব উন্নয়ন প্রত্যেকটি মানুষের সক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলে, সুতরাং নারী-পুরুষের সমতার বিষয়টি এ ধারণায় সুপ্তভাবে অন্তর্ভুক্ত। পঞ্চমত, মানব উন্নয়ন শুধু বর্তমান প্রজন্মের কথাই বলে না, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথাও বলে।

মানুষের বস্তুগত কুশলের বাইরে যেসব গুরুত্বপূর্ণ সক্ষমতা মানব উন্নয়নের আলোচনার মধ্যে আসেনি, সেগুলো হচ্ছে কণ্ঠস্বর ও স্বায়ত্তশাসনের সক্ষমতা, অংশগ্রহণের সক্ষমতা, পরিবেশের সঙ্গে মানবজীবনের ভারসাম্যের সক্ষমতা। এ বিষয়গুলো মানুষের সামগ্রিক কল্যাণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মানুষ শুধু বস্তুগত অর্জন নিয়ে তুষ্ট থাকতে পারে না, সে তার মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা ও ক্ষেত্র চায়। যেসব বস্তু, ঘটনাপ্রবাহ ও সিদ্ধান্ত তার জীবনকে প্রভাবিত করে, সেখানে সে অংশগ্রহণ করতে চায়, সেসব ক্ষেত্রের সক্ষমতা অত্যন্ত জরুরি। মানুষ অনেক সময় তাদের জীবনে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের প্রভাব বুঝতে পারে না। অনেক সময় তারা মনে করে যে এটা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তাদের জন্য নয়। কিন্তু পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানব উন্নয়নের জন্য জরুরি।

ধরা যাক, সমাজের একটি অংশ কোনো কোনো সক্ষমতা বাড়াতে চায়, অন্যদিকে অন্য একটি অংশ অন্য ধরনের সক্ষমতা বাড়াতে চায়। এ অবস্থায় যৌথ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মানব উন্নয়নের পথ ও গতিধারা কী হবে, তা নির্ণয় করা যায় না। ব্যক্তিকেন্দ্রিক মানব উন্নয়নের সঙ্গে বিভাজিত যৌথ সিদ্ধান্তকে কী করে সম্পৃক্ত করা যাবে, তা-ও মানব উন্নয়ন বিশ্লেষণ কাঠামোতে আলোচিত হয়নি।

তাই মানুষকে পরিবেশ ও মানুষের মধ্যকার ভারসাম্যটির গুরুত্ব বুঝে সে ভারসাম্য রক্ষার জন্য সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।

সেই সঙ্গে সক্ষমতার ধারণার বিশ্লেষণাত্মক কাঠামোর মধ্যে অসমতা ও বৈষম্য ব্যাপারটি প্রত্যক্ষভাবে আসেনি, পার্শ্ব আলোচনার মধ্যে এসেছে। একটি বৈষম্যহীন সমাজ অর্জন করতে চাইলে মানব উন্নয়নের প্রক্রিয়া এবং ফলাফল—দুটোই সমতা ও সাম্যভিত্তিক হতে হবে। সুতরাং বর্ধিত সক্ষমতা সৃষ্ট এই সুযোগে অসমতা ও অসাম্য থাকতে পারবে না।

মানবাধিকার মানব উন্নয়নের ভিত্তি বলে উল্লেখ করা হলেও মানব উন্নয়ন ও মানবাধিকারের সম্পর্কটি খুব সুস্পষ্ট নয়। তেমনি মানব উন্নয়ন ও মানবনিরাপত্তার সংযোগগুলো পরিষ্কারভাবে স্থাপিত হওয়া দরকার। মানব উন্নয়নকে আরও পরিশীলিত করার পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়গুলো বিগত সময়ে নানান আলোচনায় এসেছে।

কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, মানব উন্নয়ন ও সক্ষমতা মানুষের জীবনের কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে স্পর্শ করেনি। যেমন উন্নয়নের একটি নৈতিক দিক আছে। কিন্তু উন্নয়ন আলোচনায় মানুষের নৈতিক দিকটি উঠে আসে না। এর ফলে সক্ষমতার দিক থেকে নৈতিক উন্নয়নকেও অগ্রাধিকার দিতে হবে। সেই সঙ্গে মানুষকে শ্রদ্ধার সক্ষমতা, মানবিক মর্যাদাদানের সক্ষমতাও আমাদের অর্জন করতে হবে। আমরা বস্তুগত সক্ষমতা অর্জন করলেও মানবিকতা ও নৈতিকতার সক্ষমতা এখনো অর্জন করতে পারিনি।

আমরা মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করি, মানুষকে শ্রদ্ধা বা মর্যাদা দান করি না। আমাদের সক্ষমতায় ঘাটতি আছে সহনশীলতার ও পরমত সহিষ্ণুতার। মানব উন্নয়নের জন্য এগুলোও গভীরভাবে প্রয়োজন।

সেই সঙ্গে এটাও বলা প্রয়োজন যে তাত্ত্বিক দিক থেকে মানব উন্নয়নের ধারণাটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক। একটি সমাজের প্রতিটি মানুষের জীবনযাত্রার মান যদি উন্নত হয়, তাহলে সামগ্রিকভাবে সমাজ উন্নত হবে—এটা আংশিক সত্য। কিন্তু ব্যক্তি মানব উন্নয়নের সঙ্গে যৌথ মানব উন্নয়নের একটি দ্বন্দ্ব উপস্থিত হতে পারে।

ধরা যাক, সমাজের একটি অংশ কোনো কোনো সক্ষমতা বাড়াতে চায়, অন্যদিকে অন্য একটি অংশ অন্য ধরনের সক্ষমতা বাড়াতে চায়। এ অবস্থায় যৌথ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মানব উন্নয়নের পথ ও গতিধারা কী হবে, তা নির্ণয় করা যায় না। ব্যক্তিকেন্দ্রিক মানব উন্নয়নের সঙ্গে বিভাজিত যৌথ সিদ্ধান্তকে কী করে সম্পৃক্ত করা যাবে, তা-ও মানব উন্নয়ন বিশ্লেষণ কাঠামোতে আলোচিত হয়নি।

সুতরাং চূড়ান্ত বিচারে মানব উন্নয়ন শুধু বস্তুগত কুশলতা বা জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন নয়, সেখানে কণ্ঠের স্বাধীনতা, স্বায়ত্তশাসন, অংশগ্রহণের সক্ষমতা, পরিবেশের সঙ্গে মানুষের জীবনের ভারসাম্যও জরুরি। মানব উন্নয়নের বিশ্লেষণাত্মক কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে হবে মানবাধিকার ও মানবনিরাপত্তার বিষয়গুলো। উন্নয়নকে সম্পৃক্ত করতে হবে নৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে।

মানব-নৈতিকতাসম্পৃক্ত বিষয়গুলো—মানুষকে সম্মান ও মর্যাদা দেওয়ার সক্ষমতা এবং সহনশীলতা ও পরমত সহিষ্ণুতার সক্ষমতাও সামগ্রিক মানব উন্নয়নের অংশ।

  • সেলিম জাহান ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র