যে খেলা অপরাধ কমায় সে খেলা খেলব কোথায়

খেলার জগতে এ বছর সেই যে ক্রিকেটে টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ দিয়ে শুরু, তার পর থেকে একনাগাড়ে ফুটবল–ক্রিকেট চলছেই। কয়েক মাস আগে আমাদের মেয়েরা ফুটবলে সাফ চ্যাম্পিয়ন হলো। আরও আগে নারী ক্রিকেটাররা এশিয়া কাপ শিরোপা জিতে।

ইতিমধ্যে দেশের মাটিতে ভারতের বিরুদ্ধে ক্রিকেটে সিরিজ জয়ও সম্পন্ন হয়েছে। এখন কাতারের ফুটবল বিশ্বকাপ নিয়ে পৃথিবীব্যাপী ভক্তকুলের রাতের ঘুম হারাম। গত দু–তিন মাসের পত্র-পত্রিকা ঘেঁটে দেখলাম, এ সময়ে হত্যা, ধর্ষণ, উত্ত্যক্ত, নির্যাতনের খবর উল্লেখযোগ্য হারে কম।

শিশু-কিশোর-তরুণদের মধ্যে মুঠোফোন–আসক্তি চরমে। এই ছোট পরিবারের যুগে মা–বাবা শিশুদের হাতে মুঠোফোন-ট্যাব ধরিয়ে দিয়ে কাজ করেন ঘরে ও বাইরে। অনেকেই এসব অভিভাবকদের দোষ দেন যে, তাঁরা টিভি সিরিয়াল বা ইউটিউব দেখবেন না সন্তানের দিকে নজর দেবেন।

অপর দিকে ছোট পরিবার, নারীদের ঘরে-বাইরে কাজের দ্বিগুণ চাপ, ঘরের কাজে পুরুষের অসহযোগিতা, লেখাপড়া, কোচিংয়ের চাপ—সর্বোপরি খেলার মাঠের অভাব শিশু-কিশোরদের ক্রমশ ডিভাইসমুখী করে তুলছে। যেসব শিশু–কিশোরের দাদা-দাদি, নানা-নানি সঙ্গে থাকেন, তারাও আসলের চেয়ে সুদ নিয়ে এত আহ্লাদ শুরু করেন যে এতে হিতে বিপরীত হয়।

অপর দিকে শিল্পায়ন ও নগরায়ন খেলার মাঠের টুটি চেপে ধরে নিজেদের কলেবর বিস্তৃত করে চলেছে। খেলার উপযুক্ত মাঠ দিলে ছেলেপিলেদের ডিভাইস–আসক্তি নিয়ে অভিভাবকদের মাথাব্যথা কমত। এই যে ক্রিকেট–ফুটবলের মৌসুম আর খেলাপ্রেমীদের যে উৎসাহ–উদ্দীপনা—তা দেখে সহজেই বোঝা যাচ্ছে, মাঠের খেলা তারা কতটাই না উপভোগ করে এবং খেলতে না পারাটা কতটা কষ্টদায়ক!

শাহবাগ আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে শাহবাগ চত্বরে রাত–দিন ছেলেমেয়েরা গিজগিজ করতেন। এমনকি অনেক অচেনা সহমর্মী পানি-খাবার সঙ্গে এনে ক্ষুধার্ত নেতা-কর্মীদের পরিবেশন করতেন। সে সময় কেউ শোনেননি শাহবাগে কোনো মেয়েকে কেউ উত্ত্যক্ত বা যৌন হয়রানি করেছে। সবার মন ও মনন দখল করে ছিল আন্দোলনের ঈপ্সিত সাফল্য।

একটা শুভতার লড়াই মানুষকে সুকুমার করে তোলে। তৈরি হয় শুদ্ধ সংযোগ, কবিতা, গান, গল্প, নাটক, শিল্প, ভালোবাসা। মাঠের খেলাও তেমনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, হলসহ দেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছোট হয়ে আসা পৃথিবীর মতো মাঠে ডিজিটাল পর্দায় খেলা দেখছে খেলাপ্রেমী মানুষজন। ছেলেমেয়ে সবাই একসঙ্গে। কোনো অঘটন নেই।

বাড়িতে রাত জেগে খেলা দেখবে বলে শিশু–কিশোররা সন্ধ্যায় লেখাপড়া সেরে রাখছে। প্রিয় ট্যাব বা মুঠোফোন নিয়ে সময় কাটাচ্ছে না। কিন্তু প্রিয় টিম হেরে গেলে কষ্ট পাচ্ছে, জিতলে তো কথাই নেই! কিশোরী-তরুণীরাও দর্শক। কিন্তু তাদের মায়েদের আগ্রহ থাকলেও চা-নাশতা পরিবেশন করতে গিয়ে মেসির গোল আর সাকিবের ব্যাটিং দেখা হয়ে ওঠে না। ঈদ-পার্বণের মতো সব উৎসবে নারীর কাজের চাপ দ্বিগুণ।

একবার গ্রামের যে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছি, তা দেখতে গিয়ে কিছুই চিনতে পারছিলাম না। টিনের ছাউনির স্কুলঘরটা পাকা দালান হয়েছে ঠিকই, কিন্তু স্কুলের সামনে যে বিশাল মাঠ ছিল, সেটা সেখানে নেই। যেখানে ঈদের জামাতও হতো। কারা যেন সেখানে ফসল রাখার গুদাম করেছে, দোকানপাট হয়েছে। যেটুকু আছে, সেটাকে ঈদগাহ করার জন্য একই ধর্মের দুই তরিকার ধার্মিকেরা দীর্ঘদিন ধরে বিবাদ–বিসংবাদে জড়িয়ে আছেন।

আরও পড়ুন

বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা বলে যে একটা বিষয় ছিল, এখনকার বাচ্চারা সেটার অর্থ কী, তা জানার জন্য অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। বড় বড় শহরগুলোতে হাতে গোনা কয়েকটা প্রতিষ্ঠিত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বাকি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেবল নাতিদীর্ঘ ভবনে অবস্থিত। খেলার মাঠ তো দূর কি বাত, একটু চওড়া বারান্দাও নেই। কোনো কোনো ভবনের নিচে ব্যাংক ও ডিপার্টমেন্টাল স্টোর।

শৈশবে বাড়ির পাশের খোলা বাগানে যখন সন্ধ্যা নামত, তখন খেলা ফুরিয়ে যাওয়ার দুঃখে মন কেঁদে উঠত। কাল কখন বিকেল হবে, কখন সাথিরা এক জোট হয়ে দৌড়ে দৌড়ে আবার বুড়ি ছুঁতে যাবে! নিজেদের সান্ত্বনা দিয়ে কেউ বলে উঠত—চল এবার বাড়িতে, মাঠের খেলা মাটিতে।

যা-ই হোক, খেলার এ মৌসুম বুঝিয়ে দিল, মাঠের খেলা কত আকাঙ্ক্ষিত। শুধু খেলা দেখেই কি আর প্রাণ ভরে? খেলতে কার না ইচ্ছা করে? গ্রামের স্কুল-কলেজের মাঠ মরে যাচ্ছে। আমাদের মফস্‌সল শহরে দুটো খেলার মাঠ ছিল, এ-টিম ও বি-টিম। এ-টিম মাঠটিতে নাকি স্টেডিয়াম হবে, তাই ইতিমধ্যেই শপিং মলের জায়গা দখল করে মাঠ সংকীর্ণ করে ফেলা হয়েছে।

আর বি-টিম মাঠ রাজনৈতিক ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের হিমাগার অর্ধেকই গিলে ফেলেছে। আবাসিক এলাকাগুলোর গা লাগোয়া ভবনের কোনো ফাঁকে একটু দৌড়ে বেড়ানোর সবুজ নেই। গাড়ি যাতায়াতের জন্য তৈরি কংক্রিটের পথের ওপর শিশুরা প্লাস্টিকের স্টাম্প বসিয়ে ক্রিকেট খেলে, নেট ঝুলিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলে, আস্তে করে ফুটবলে পা চালায়, যাতে কোনো ভবনের জানালার কাচ না ভাঙে।

আর হুটহাট গাড়ির আসা-যাওয়ায় কেউই খেলার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারে না। মাঠের খেলা দেয় সংশ্লিষ্টতা, প্রাণপ্রাচুর্য, শরীর গঠন, শৃঙ্খলা, প্রতিযোগিতা, বন্ধুত্ব, অপরাধহীনতা। মাঠ হারানো ডিভাইস–আসক্ত ঘরকুনো ছানাপোনারা এসব গুণের একটাও না পেয়ে স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক, অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠলে পরিবার-দেশ-জাতি কী পাবে?