ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচন, নতুন নেতৃত্বের সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ

পৃথিবীর একমাত্র মহাদেশ ইউরোপ, যেখানে মহাদেশীয় পার্লামেন্ট রয়েছে। দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধের উত্থান যেই মহাদেশ থেকে, পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধ–বিগ্রহ করার অতীত তাদের রয়েছে। তারাই আবার এখন একই ছাদের নিচে নানা দেশ থেকে নির্বাচিত হয়ে আসা পার্লামেন্ট সদস্যরা মহাদেশটির কল্যাণে কাজ করছে।

৬ থেকে ৯ জুন হতে যাচ্ছে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের দশম নির্বাচন।

বিশ্বজুড়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টকে ইউরোপীয় জাতিসত্তার আয়না বলা হয়ে থাকে। ৭২০ আসনবিশিষ্ট এই পার্লামেন্ট নির্বাচনে ভোটারের সংখ্যা ৩৫০ মিলিয়ন।

১৯৫১ সালে ছয়টি দেশ দ্বারা গঠিত ইউরোপীয় কয়লা ও ইস্পাত সম্প্রদায় (ইসিএসসি) প্রতিষ্ঠার পর থেকে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ক্রমেই প্রসারিত হয়েছে।

যুক্তরাজ্য চলে যাওয়ার পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যসংখ্যায় রয়েছে ২৭টি দেশ। দেশগুলো হলো বেলজিয়াম, বুলগেরিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি, এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, গ্রিস, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, ক্রোয়েশিয়া, লাটভিয়া, লিথুনিয়া, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রিয়া, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, রোমানিয়া, সুইডেন, স্লোভাকিয়া, স্লোভেনিয়া, স্পেন, চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি ও সাইপ্রাস।

এই দেশগুলোয় ৬ থেকে ৯ জুন চার দিন ধরে দশম ইউরোপীয় সংসদ নির্বাচনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যরাষ্ট্রের সব নাগরিক ভোট দেওয়ার অধিকারী ভোটারদের বয়সসীমা ১৮ হলেও এই বছর জার্মানিতে এবং অস্ট্রিয়ায় ভোট দেওয়ার অধিকার ১৬ বছর বয়সে এবং গ্রিস এবং মাল্টায় ১৭ বছর বয়সে ভোট দেওয়ার যোগ্য বলে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। জার্মানিতে, প্রায় ৬৬ মিলিয়ন নাগরিক আগামী রোববার ৯ জুন ভোট দেবেন।

ইউরোপীয় সংসদ নির্বাচনে কোন দল থেকে ব্যক্তি বিশেষ সরাসরি ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় করতে পারেন না। শুধু দলভিত্তিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হয়। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দল ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সম্ভাব্য সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য তালিকা তৈরি করেন। যেকোনো দল তাদের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাত অনুযায়ী সংসদ সদস্য পদ লাভ করেন।

ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সংসদ সদস্য কোটা নির্ধারিত হয়, দেশটির লোকসংখ্যার অনুপাত অনুযায়ী। সেই হিসাবে ৮৩.৮ মিলিয়ন মানুষ–অধ্যুষিত জার্মানির  লোকসংখ্যার অনুপাতে সর্বোচ্চ আসনসংখ্যা ৯৬। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা সব সময় পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন।

যে উদ্দেশ্য নিয়ে ইউরোপীয় রাজনীতিকেরা এই উপমহাদেশীয় ঐক্যবদ্ধতাকে আরও এগিয়ে নিতে চাইছেন তাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সাম্প্রতিক কালের ইইউ জোটবিরোধী কট্টর জাতীয়তাবাদী দলগুলো, ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধ এবং বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমেরিকার সঙ্গে ইউরোপ স্নায়বিক বিরোধ।

যে উদ্দেশ্য ও ধারণা থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠিত হয়েছিল, তা ছিল পারস্পরিক বাণিজ্য ও সহযোগিতার সম্প্রসারণ। ইউরোপজুড়ে ‘সাধারণ বাজার’ সৃষ্টি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পর ইউরোপীয় একত্রীকরণকে আজও একটি ‘শান্তি প্রকল্প’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

ক্রমেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন ‘ইউরোপীয় আত্মা’ বলে পরিচিতি পাই। প্রথম দিকে ইউরোপীয় জনগণের মধ্যে বিষয়টি এত গুরুত্ব না পেলেও ইউরোপীয় সাধারণ বাজারের সুফল সদস্যদেশগুলোর জনগণের মধ্যে উৎসাহ তৈরি করে।

দীর্ঘ সময়জুড়ে ইউরোপীয় রাজনীতিকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ইইউ জোট বিশ্বে এখন একটি স্থিতিশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ইউরোপের অনেক দেশে রাজনীতি ডানপন্থার দিকে ঝুঁকছে।

অনেক দেশে জাতীয়তাবাদী ও পপুলিস্টরা শক্তি অর্জন করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ইউরোপীয় নির্বাচনে রক্ষণশীলদের এই ধারা অব্যাহত থাকবে। সে ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সামনে আরও চ্যালেঞ্জ আসছে।

প্রায় দুই বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ ইউরোপীয় ইউনিয়নকে নতুন সংকটের মধ্যে ফেলেছে। আগামী বছরগুলোয় এই জোটকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে কী আকারে এবং কী পরিমাণে ইউক্রেনকে সমর্থন অব্যাহত রাখা সম্ভব।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যদি ইউক্রেনের বাইরে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে তার আগ্রাসন চালায়, তবে তা শেষ পর্যন্ত কী পর্যায়ে যাবে, তা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা কমাতে কী পন্থা নেওয়া প্রয়োজন, সেই বিষয়সহ ইইউকে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি সামনে এসেছে।

প্রায় আট মাস ধরে চলা ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসন নিয়েও ইইউ জোটে ভিন্নমত রয়েছে।

ইউরোপের দক্ষিণপন্থীরা অভিবাসী, শরণার্থী, বর্ণবাদী ও ইসলামবিরোধী ভাবনার দক্ষিণপন্থীরা আবার ইউরোপ ঐক্যেরও বিরোধী। দেশ চালানোর মতো সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের কোনো ভালো মডেল দিতে না পারলেও স্লোগানসর্বস্ব রাজনীতি দিয়ে জনগণের মন জয়ের চেষ্টা করছে এবং এবারের নির্বাচনেও সেই পন্থায় এগিয়েছে।

২০১৯ সাল থেকে নির্বাচিত ইউরোপীয় কমিশনের সভানেত্রী ভন ডার লেয়েন দশম ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনের আগে বলেছেন, ‘পাঁচ বছর আগে আমরা ইউরোপীয় জনগণের কাছে বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, আমরা ইইউ নাগরিকদের প্রত্যাশা পূরণ করতে এবং নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা তারপর থেকে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে এবং আমরা আমাদের কথা রেখেছি।’

তিনি বৈশ্বিক মহামারি থেকে শুরু করে জলবায়ু পরিবর্তন-সম্পর্কিত ঘটনা, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ থেকে শুরু করে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ জ্বালানি–সংকট মোকাবিলার কথা বলেছেন।

ইউরোপের ২৭টি দেশের ভোটাররা ৬-৯ জুন আবারও পাঁচ বছরের জন্য তাদের ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করবেন। গতবারের ইইউ পার্লামেন্ট নির্বাচনে সর্বোচ্চসংখ্যক ১৭৬টি আসন পেয়েছিল ইউরোপের খ্রিষ্টান গণতান্ত্রিক ধারার জোট এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৩৯টি আসন পেয়েছিল সামাজিক গণতান্ত্রিকদের জোট এরপরেই ছিল লিবারেল গণতান্ত্রিক জোট এবং পরিবেশবাদী সবুজ দলের জোট।

ইউরোপীয় ইউনিয়নে তিনটি প্রধান প্রতিষ্ঠানের একটি হলো ইউরোপীয় পার্লামেন্ট। এ ছাড়া রয়েছে ইউরোপীয় কমিশন এবং  ইউরোপীয় কাউন্সিল।

ইউরোপীয় পার্লামেন্ট বা পার্লামেন্টের সদস্যরা মূলত জোটভুক্ত দেশগুলোর জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট, জোটের বিভিন্ন বিষয়ে আইনপ্রণেতা হিসেবে কাজ করে। জোটের বাজেটের ক্ষেত্রেও ইইউ পার্লামেন্টে সম্মতির প্রয়োজন হয়।

ইউরোপীয় কমিশন জোটের প্রশাসনিক বিষয়াদি এবং ইউরোপীয় কাউন্সিল সদস্যরাষ্ট্রগুলোর সরকারগুলোর প্রতিনিধিসংবলিত কমিটি। ইইউ পার্লামেন্টের সদস্যরাই তাঁদের পছন্দমতো ভোট দিয়ে পাঁচ বছরের জন্য ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেন।

ইউরোপ মহাদেশের ৪৭টি দেশের সবাই ইউরোপীয় পার্লামেন্টের অন্তর্ভুক্ত না হলেও নানা ভিন্ন জাতিসত্তার একই ছাদের নিচে পার্লামেন্টে বসা একটি বিরল দৃষ্টান্ত। ১৯৫৭ সাল থেকে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের কার্যক্রম শুরু হলেও সরাসরি জনগণের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন শুরু হয় ১৯৭৯ সাল থেকে।

যে উদ্দেশ্য নিয়ে ইউরোপীয় রাজনীতিকেরা এই উপমহাদেশীয় ঐক্যবদ্ধতাকে আরও এগিয়ে নিতে চাইছেন তাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সাম্প্রতিক কালের ইইউ জোটবিরোধী কট্টর জাতীয়তাবাদী দলগুলো, ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধ এবং বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমেরিকার সঙ্গে ইউরোপ স্নায়বিক বিরোধ।

ইউরোপীয় রাজনীতিকেরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে ইউরোপে যে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংস্কৃতি তথা মহাদেশীয় পার্লামেন্টারি প্রথা গড়ে তুলেছে, তা বিশ্বের কাছে সর্বদা দৃষ্টান্ত হয়ে রইবে।

  • সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর জার্মান প্রতিনিধি

[email protected]