যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় প্রযুক্তিমানবদের স্বপ্নভঙ্গ

যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন টেক জায়ান্ট কোম্পানিতে ভারতীয় বংশোদ্ভূত শীর্ষ কর্মকতা

যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চদক্ষতাসম্পন্ন কর্মী ভিসাকে বলা এইচ-ওয়ান বি ভিসা। এই ভিসা নিয়ে সম্প্রতি বিতর্ক শুরু হয়েছে। এই বিতর্ক ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ (মাগা) আন্দোলনের গভীর বিভাজনকে তুলে ধরেছে। একসময় ‘আদর্শ সংখ্যালঘু’ হিসেবে প্রশংসিত ভারতীয় প্রযুক্তিকর্মীরা এখন তীব্র মতাদর্শিক বিভক্তির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছেন।

এই বিতর্কের এক পক্ষ অভিবাসনকে শুধু প্রযুক্তিশিল্পের প্রয়োজনীয়তার খাতিরে হলেও সমর্থন করেন। আরেক পক্ষ জাতীয়তাবাদের শুদ্ধতা রক্ষার লোকেরা। তাঁরা অভিবাসনকে হুমকি হিসেবে দেখেন। এই বিতর্ক যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক ও রাজনৈতিক মতবিরোধের প্রতিফলন।

ভারতীয় অভিবাসীদের উত্থানকে কোনো আকস্মিক ঘটনা হিসেবে দেখলে ভুল হবে। এটা ছিল উচ্চশিক্ষিত ভারতীয়দের বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও যুক্তরাষ্ট্রের উদার অভিবাসন নীতির মিলিত ফল। ১৯৬৫ সালের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্ট জাতিগত কোটার বিলুপ্তি ঘটিয়ে দক্ষ পেশাদারদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দ্বার উন্মুক্ত করেছিল। ভারতীয় প্রকৌশলী, চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা এই সুযোগ গ্রহণ করে মার্কিন জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেন।

তবে এই তথাকথিত ‘মেধাকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থা’র কিছু অন্ধকার দিকও আছে। এই ব্যবস্থায় শুধু যোগ্যতা নয়, বরং অভিবাসীদের সামাজিক কাঠামোর সুবিধা থাকায় সেখানে বিশেষ শ্রেণির এগিয়ে যাওয়ার কথাও বলে। ভারতীয় প্রযুক্তিকর্মীরা হয়ে উঠেছিলেন উদারনৈতিক স্বপ্নের প্রতীক। বিশ্বব্যাপী ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উত্থান এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়ে যাওয়ায়, এই অভিবাসীদের অবস্থান নতুনভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।

১৯৯০-এর দশকে ভারতের অর্থনীতি উন্মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডটকম যুগের উত্থান ঘটে। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রতিবছর দক্ষ কর্মী তৈরি হচ্ছিল। তারা বিল গেটসের মতো প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে সিলিকন ভ্যালির দিকে ছুটে যান। কিন্তু ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর এই স্বপ্ন ভেঙে পড়তে শুরু করে। ইউরোপ ও আমেরিকার শিল্পোত্তর অর্থনীতি সংকুচিত হয়, প্রযুক্তি ও আর্থিক খাতে চাকরির বাজার সংকটে পড়ে।

যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় পেশাদারদের সাফল্যের জন্য এক গোপন মূল্য চুকাতে হয়েছে। প্রযুক্তি খাতে তাঁদের উত্থান যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যমান জাতিগত বৈষম্যকে অস্বীকার করেই সম্ভব হয়েছিল। তাঁরা সচেতনভাবেই এই সামাজিক কাঠামোর সঙ্গে জড়িত হননি। ফলে তাঁরা এমন একটি ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখেছিলেন, যেখানে এক সংখ্যালঘু গোষ্ঠী এগিয়ে যেতে পারলেও অন্য সংখ্যালঘুরা তা পারেননি।

ভারতে, উচ্চবর্ণের অভিজাতদের ক্ষমতা ও মূলধন বৃদ্ধির সমান্তরাল একটি প্রক্রিয়া চলেছে। ১৯৯০-এর দশকে অর্থনৈতিক উদারীকরণ নেহরুবাদী অর্থনীতির কৃষক ও শ্রমিককেন্দ্রিক নীতিকে ধ্বংস করে দেয়। এর বদলে ভারত বাজারভিত্তিক প্রবৃদ্ধি ও ব্যক্তিগত সম্পদ সঞ্চয়ের দিকে ঝুঁকেছিল। উচ্চবর্ণীয় অভিজাতরা এই সংস্কারের সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সংযোগ ঘটিয়েছিল। তারা দেশীয় মূলধনের পক্ষপাতী ছিল, কিন্তু বৈশ্বিক প্রতিযোগিতাকে প্রতিরোধ করেছিল।

বিদেশে ভারতীয় অভিবাসীদের বর্ণবাদকে নীরব থেকে সহযোগিতা করেছে। আর ভারতে ঘটেছে উচ্চবর্ণীয় অভিজাতদের ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস। এভাবে বিশেষ শ্রেণির সুবিধাভোগীরা বারবার নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রেখেছে। উভয় ক্ষেত্রেই তারা কাঠামোগত বৈষম্যকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের সুবিধা নিশ্চিত করেছে। কিন্তু কখনোই জবাবদিহির মুখোমুখি হতে চায়নি।

২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচিত হলেন। ট্রাম্পবাদ শ্বেত জাতীয়তাবাদীদের ক্ষোভকে উসকে দিয়েছিল। এই ট্রাম্পবাদ উচ্চবর্ণের ভারতীয় অভিবাসীদেরও আকৃষ্ট করেছিল। বিশেষ করে যাঁরা বিশ্বরাজনীতির পালাবদলে নিজেদের প্রভাব কমতে দেখছিলেন।

ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির প্রতি ভারতের প্রবাসী অভিজাতদের একাংশের সমর্থন ধরা পড়েছিল বিবেক রামাস্বামী ও কাশ প্যাটেলের মতো ব্যক্তিদের মাধ্যমে। তাঁরা ট্রাম্পের বর্ণবাদী ও অভিবাসনবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাপক উৎসাহে প্রচার করেছিলেন। একই সময়ে, ট্রাম্পের নরেন্দ্র মোদির প্রতি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা থেকে দেখা গেল যে কীভাবে বিশ্বব্যাপী ডানপন্থী রাজনীতিবিদেরা একে অপরকে আপন মনে করছেন।

তবে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ আদর্শের সঙ্গে ভারতীয় পেশাদারদের স্বার্থের সমঝোতা ছিল কাঁচা। সেই সমঝোতা এখন ভেঙে পড়ছে। একসময়ের স্বপ্নের সিঁড়ি এইচ-ওয়ান বি ভিসা এখন মতাদর্শগত লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।

একদিকে, ট্রাম্পের সরকার-চালনায় দক্ষতা বাড়ানোর স্বঘোষিত নীতিবিদ ইলন মাস্ক ও বিবেক রামাস্বামী এই ভিসাকে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার জন্য অপরিহার্য বলে ব্যাখ্যা করেছেন।

অন্যদিকে আমেরিকান নেটিভিস্টরা একে শ্বেতাঙ্গ খ্রিষ্টান পরিচয়ের জন্য হুমকি হিসেবে দেখছেন। এই দ্বন্দ্বের পরিণতি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ট্রাম্প প্রশাসন ‘ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিশিয়েন্সি’-তে রামাস্বামীকে নিয়োগের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সরিয়ে দেয়। এই পদচ্যুতি দেখিয়ে দেয় যে কম খরচে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা ও শ্বেত জাতীয়তাবাদীদের ক্ষোভের মধ্যে সমঝোতা করা যাচ্ছে না।

শ্বেত জাতীয়তাবাদ অভিবাসন সীমিত রেখে একটি জাতিগত রাষ্ট্র গড়তে চায়। ভারতীয় পেশাদারেরা এইচ-ওয়ান বি ভিসার মতো কর্মসূচির ওপর ভরসা করে আমেরিকান স্বপ্নে বিভোর থাকে। এই স্বপনে অনেকেই মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে বিপুল ঋণের বোঝা মাথায় নেন।

একসময় বিশ্বায়ন নিয়ে অসন্তোষ, সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা এবং ইসলামবিদ্বেষের মতো অভিন্ন ক্ষোভের জায়গা থেকে ভারতীয় অভিবাসীরা ও শ্বেত জাতীয়তাবাদীরা এক অস্থায়ী জোট গড়ে তুলেছিল। কিন্তু স্বার্থের সংঘাত সেই জোট ভেঙে যাচ্ছে। এই জোট এখন টিকে থাকার লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। ভারতীয়দের বিরুদ্ধে অনলাইনে বর্ণবাদী আক্রমণের পরিমাণ বাড়ছে।

ভারতীয় অভিবাসীরা শ্বেত জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করেছে বলে দাবি করে। কিন্তু বাস্তবে তা ছিল আত্মরক্ষামূলক এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই লোকদেখানো। বাস্তব সত্য হলো, ভারতীয় পেশাদাররা শ্বেত জাতীয়তাবাদের আদর্শকে টিকিয়ে রাখা ব্যবস্থার মধ্যে নিজেরা উন্নতি করেছেন। সেখানে অন্য অভিবাসীদের প্রবেশের পথ ছিল সংকীর্ণ।

যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাধ্যমে তারা নিজেদের শাসকশ্রেণির অংশ হিসেবে গড়ে তুলেছে। সঞ্চয় করেছে ক্ষমতা ও সম্পদ। কিন্তু এখন সেই ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয়ে উঠছে। এখন এটি পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে নীরবতা সব সময় কাজে দেয় না।

  • দীপ্যমান চক্রবর্তী লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সের পিএইচডি করছেন

  • সৈয়দ ফ্যায়জান ফ্লেচার স্কুল অব ল অ্যান্ড ডিপ্লোমেসির স্নাতক প্রার্থী

আল–জাজিরার ইংরেজি থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদ জাভেদ হুসেন