‘খাঁচার পাখিটি কেন গান গায়?’

‘খাঁচার পাখিটি কেন গান গায়, আমি তা জানি’—বেহালার সুরের মতো প্রতিবছর নারী দিবসে আটলান্টিকের ওপার থেকে বাক্যটি ভেসে আসে।

মার্কিন কবি মায়া অ্যাঞ্জেলোর কালজয়ী আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থের নাম এটি। শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিসংবলিত এই ‘মহাকাব্যের’ নিজেই খাঁচার পাখি। আদতে অনুবাদটা হওয়া উচিত ‘খাঁচার পাখিটি কেন কাঁদে’। কারণ, তাঁর এই জীবনীগ্রন্থ পড়ে আমরা আজও শুনতে পাই তাঁর কান্নার সুর।

উত্তর আমেরিকার একটি বর্ণবাদী সমাজে জন্ম কবি মায়া অ্যাঞ্জেলোর, যেন নারী নিগ্রহের জ্বলন্ত উপমা। যিনি একাধারে নারী, কৃষ্ণাঙ্গ, শ্রমজীবী, শৈশবেই ধর্ষণের শিকার এবং তারপর যৌনকর্মী, কিন্তু অবশেষে বিশ্বের সেরা সাহিত্যিকদের একজন। আমাদের সময়ের নারীদের জন্য এক অফুরন্ত প্রেরণার উৎস কবি মায়া অ্যাঞ্জেলো।

নারীবাদের উদ্দেশ্য হলো, এককথায় রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক সমতা। তিনিই নারীবাদী, যিনি বিশ্বাস করেন, শুধু লিঙ্গের কারণে নারী বৈষম্যের শিকার, নারী হওয়ার কারণে তাঁর ন্যায্য পাওনা সমাজ দিতে অস্বীকার করে এবং এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য দরকার আমূল পরিবর্তন তথা বিপ্লব।

এই বিপ্লবের জন্য দরকার সর্বাত্মক আন্দোলন। বিপ্লব মানেই মনজাগতিক পরিবর্তন। ‘পুরুষ নারীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ’—এই ধারণা নারী, পুরুষ উভয়ের মস্তিষ্কে স্থায়ীভাবে প্রোথিত, যা নারীর বন্দিত্বের প্রধান কারণ।

এখানে জন স্টুয়ার্ট মিলকে উদ্ধৃত করি: ‘লৈঙ্গিক ভিন্নতার কারণে, জৈবিকভাবে, নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। নারী-পুরুষের মধ্যে যে প্রকৃতিগত পার্থক্যের কথা বলা হয়, তা-ও পুরুষতন্ত্রের সৃষ্টি এবং প্রথাভিত্তিক।’ তার মানে, পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা ভুল। তাহলে নারী-পুরুষ উভয়েরই মনোজগৎ থেকে এই ধারণা উপড়ে ফেলতে হবে।

অতীতের নারী আন্দোলন থেকে বর্তমান সময়ের নারীদের শিক্ষা নেওয়া দরকার। শিক্ষাটা সর্বাত্মক আন্দোলনের শিক্ষা। সর্বাত্মক আন্দোলন মানে সমাজের খোল নলচে পাল্টে ফেলার আয়োজন। শুধু নারী নন, পুরুষকেও সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে এই আন্দোলনে।

পুরুষের অংশগ্রহণ ছাড়া নারীবাদী আন্দোলন সফল হতে পারে না। প্রশ্ন উঠতে পারে, নারীর অধিকার আন্দোলনে পুরুষ কেন অংশগ্রহণ করবে? নীতি-আদর্শের কথা যদি বাদ-ও দিই, পুরুষের নিজের স্বার্থেই নারীর ক্ষমতায়নের পক্ষে দাঁড়ানো উচিত।

একটি দেশের মোটামুটি ৫০ শতাংশই নারী থাকেন। ক্ষমতায়নের একটি প্রধান উপাদান হলো লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন, তথা কর্মে নিযুক্তি। এই হার যত বেশি হবে, দেশের উৎপাদন তত বেশি হবে।

নিজের পরিবারের স্ত্রী, কন্যা বা ভগিনির কর্মে নিযুক্তি থেকে সরাসরি যে উপকার আসবে, তার বাইরে, রাষ্ট্রের নিট গেইন তথা নিট লাভ থেকেও পুরুষ উপকৃত হবেন। আর নীতি-আদর্শের কথা বলতে গেলে বলতে হয়, যে সমাজে পুরুষের সমান মর্যাদা নারী পায় না, সে সমাজ পশ্চাৎপদ সমাজ। যে ব্যক্তি নারী-পুরুষের সমতায় বিশ্বাস করেন না, তিনি অনাধুনিক।

ওপরে মায়া অ্যাঞ্জেলোর কথা উল্লেখ করেছি। তিনি কখনোই শুধু নারী অধিকার নিয়ে কাজ করেননি। মানবাধিকার, কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার, পিছিয়ে পড়া সব মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মার্টিন লুথার কিংসহ তৎকালীন সব বড় নেতার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছেন তিনি।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অনেক আগেই, আঠারো শতকের শুরু থেকেই ভোটাধিকার, শ্রম অধিকার, মিতাচার আন্দোলন, শান্তিবাদী আন্দোলনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণ চোখে পড়ে।

নারীর মুক্তি কীভাবে ঘটবে? সংক্ষেপে উত্তর হলো বিজ্ঞানের ও মনস্তত্ত্বের শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে। বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি ও মনস্তত্ত্বের জ্ঞানের অভাবে, অর্থাৎ অজ্ঞতার কারণেই পুরুষ ও নারী উভয়েই পুরুষকে শ্রেষ্ঠ মনে করে। এ জন্য দরকার একটা বিজ্ঞান ও যুক্তিনির্ভর শিক্ষার ব্যবস্থা (লক্ষ করুন, এখানে ‘শিক্ষাব্যবস্থা’ বলা হয়নি, বলা হয়েছে ‘শিক্ষার ব্যবস্থা’)।

মাত্র কয়েকজনের নাম উল্লেখ করি—নারীর জন্য ভোটাধিকার আন্দোলনের ব্রিটিশ নেত্রী এমেলিন পেট্রিক-লরেন্স, ব্রিটিশ শান্তিবাদী ও ভোটাধিকার আন্দোলনের নেত্রী হেলেনা সনউইক, জার্মানির ক্লারা জেটকিন মূলত একজন সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মী ছিলেন, কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তিবাদী আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলেন।

একই কাজ করেছেন, কার্ল মার্ক্সের কন্যা ইলিয়নোর মার্ক্স ও লেনিনের জীবনসঙ্গিনী নাদেঝদা ক্রুপস্কয়া। জীবনীকার র‍্যাচেল হোমজ, ইলিয়নোর মার্ক্স সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, তিনি সমাজতন্ত্রের সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত করেছেন নারীবাদ, যা শ্রমজীবী নারীর মুক্তি নিশ্চিত করে। ক্রুপস্কয়া তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন কারখানার শ্রমিকদের শিক্ষাদানের মধ্য দিয়ে, তারপর যোগ দেন আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট স্টাডি গ্রুপে। গড়ে তোলেন কারখানা শ্রমিকদের সংগঠন। ১৮৯৯ সালে লিখে ফেলেন ‘দ্য উওম্যান ওয়ার্কার’শিরোনামে এক বিখ্যাত পুস্তিকা।

ধারণা করা হয়, এই পুস্তিকাই রাশিয়ায় রুশ নারীর অবস্থার অনুপুঙ্খ বর্ণনার প্রথম মার্ক্সীয় ও নারীবাদী লেখা। তিনি মূলত শিক্ষা বিস্তারে আজীবন নিরলস কাজ করে গেছেন, সরকারের উচ্চ পদে আসীন ছিলেন কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির পতাকার নিচে।

পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে নারীর জন্য পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা মানে নারীর মুক্তির পথে মাত্র এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া। এই অধিকার দৃশ্যমান হতে পারে সম্পদে ও উৎপাদনযন্ত্রে নারীর মালিকানা লাভের মধ্যে, কাজে ও আয়-উপার্জনে নারীর জন্য পুরুষের সমান অধিকারের মধ্যে। সম্পদে ও উৎপাদনযন্ত্রে মালিকানা লাভের প্রক্রিয়াটাও হতে হবে লিঙ্গনিরপেক্ষ।

আরও পড়ুন

পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে সিদ্ধান্ত তৈরিতে ও নীতি প্রণয়নে নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠাই নারীর ক্ষমতায়ন। আর নারীর ক্ষমতায়নই নারীবাদের মূল কথা। স্থূলভাবে, নারীর ক্ষমতায়নই নারীর মুক্তি। কিন্তু আদতে, এই ক্ষমতায়নে কি নারীর পুরোপুরি মুক্তি ঘটে? ঘটে না।

নারীর মুক্তি ঘটা মানে ‘পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের’যে মানসিকতা নারী ও পুরুষ উভয়ই ধারণ করে, তা থেকে মুক্তি। নারীর মুক্তির জন্য ওই মানসিকতা থেকে শুধু নারী মুক্ত হলেই হবে না, মুক্ত হতে হবে পুরুষকেও। পুরুষের মুক্তি ছাড়া নারীর মুক্তি ঘটবে না।

তাহলে নারীর মুক্তি কীভাবে ঘটবে? সংক্ষেপে উত্তর হলো বিজ্ঞানের ও মনস্তত্ত্বের শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে। বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি ও মনস্তত্ত্বের জ্ঞানের অভাবে, অর্থাৎ অজ্ঞতার কারণেই পুরুষ ও নারী উভয়েই পুরুষকে শ্রেষ্ঠ মনে করে। এ জন্য দরকার একটা বিজ্ঞান ও যুক্তিনির্ভর শিক্ষার ব্যবস্থা (লক্ষ করুন, এখানে ‘শিক্ষাব্যবস্থা’ বলা হয়নি, বলা হয়েছে ‘শিক্ষার ব্যবস্থা’)।

কারণ, জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে পরিবার থেকে, পরিপার্শ্ব থেকে শিশু প্রথম গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পেয়ে থাকে, যা তার মানসিকতা তৈরি করে দেয়, যা থেকে বের হওয়া কঠিন। এমন একটা জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা ও সর্ব ক্ষেত্রে একটা শিক্ষা গ্রহণের প্রক্রিয়ার ও সুযোগের জন্য চাই প্রগতিবাদী রাজনীতি। কারণ, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বা উদ্ভাবনের ও ভালো অর্থনৈতিক নীতির সুফল মানুষের জীবনে পৌঁছাবে কি না, তা নির্ধারণ করে রাজনীতি।

একটা প্রগতিবাদী রাজনৈতিক দলই রাষ্ট্রক্ষমতায় গিয়ে পারে এমন একটা শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষার প্রক্রিয়া চালু করতে। অতএব, নারী যদি মুক্তি চান, তাঁকে ব্যাপকভাবে রাজনীতিতে সক্রিয় হতে হবে, বিরাজমান কোনো দলে ঢুকে সেটাকে প্রগতির দিকে নিতে হবে অথবা নতুন দল গঠন করতে হবে এবং নারীবাদী নারী ও নারীবাদী পুরুষকে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে হবে এবং সমতার দর্শনকে মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করে একটা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়তে হবে। কারণ, সর্বক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠা ছাড়া নারীর জন্য পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব।

মায়া অ্যাঞ্জেলোর কবিতা নারীর জন্য আজও অফুরন্ত প্রেরণার উৎস হয়ে আছে। ‘স্টিল আই রাইজ’ কবিতায় তিনি ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকেও মাথা উঁচু করে আবার উঠে দাঁড়াতে চান। আমি অনুবাদ করেছি এভাবে:

‘ইতিহাসের লজ্জার কুঁড়েঘর থেকে

আমি জেগে উঠি,

বেদনার অতীত থেকে

আমি জেগে উঠি,

আমি যেন কালো সমুদ্র সফেন

আমি সবকিছু সহ্য করি আর জেগে উঠি,

আতঙ্ক আর ভয়ের রাতগুলো পেছনে ফেলে

আমি জেগে উঠি,

নতুন সূর্যের আলোয়

আমি জেগে উঠি,

ক্রীতদাসের স্বপ্ন আর আশা হয়ে

আমি জেগে উঠি, জেগে উঠি, জেগে উঠি…’

  • এন এন তরুণ ইউনিভার্সিটি অব বাথ, ইংল্যান্ড। সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। [email protected]