রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে চীনের শান্তি পরিকল্পনা কি শুধুই বাকোয়াজ

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছরে এসে চীন শান্তি পরিকল্পনা দিয়েছে
ছবি: রয়টার্স

ইউক্রেনে রাশিয়ার সর্বাত্মক সামরিক অভিযানের এক বছর পূর্ণ হলো গত সপ্তাহে। এই রকম একটি সময়ে চীন এই সংঘাত অবসানের উপায় নির্দেশক ১২ দফাবিশিষ্ট একটি ‘শান্তি পরিকল্পনা’ প্রকাশ করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন এবং হোয়াইট হাউসের জাতীয় প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভানসহ ঊর্ধ্বতন মার্কিন কর্মকর্তারা যখন রাশিয়াকে মারণঘাতী অস্ত্র দিয়ে চীন সহায়তা করার পরিকল্পনা করছে বলে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন, ঠিক সেই সময় চীনের এই শান্তি পরিকল্পনা জনসমক্ষে প্রকাশ করা হলো।

পশ্চিমা নীতিনির্ধারকেরা ভুলে যাননি, মস্কো পুরো মাত্রায় হামলা শুরু করার কয়েক সপ্তাহ পরই চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন একটি বিরল বৈঠক করেছিলেন এবং বৈঠক শেষে তাঁরা যে যৌথ বিবৃতি দিয়েছিলেন, তাতে দুই দেশের ‘সীমাহীন অংশীদারির’ কথা উল্লেখ ছিল। পশ্চিমাদের প্রধান উদ্বেগের বিষয় হলো, চীনের সঙ্গে তাদের ক্রমবর্ধমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা চীন ও রাশিয়া—এই দুই ঘোর কর্তৃত্ববাদী শাসনকে উত্তরোত্তর ঘনিষ্ঠ করছে, যা গোটা বিশ্বব্যবস্থার আদলকেই বদলে দেওয়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

তবে চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম ও সরকারপন্থী পণ্ডিতেরা এই মতকে প্রত্যাখ্যান করে থাকেন। তাঁদের ভাষ্যমতে, বেইজিংয়ের বিশ্বদর্শন বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থাকে সমর্থন করে; কারণ, এই বর্তমান ব্যবস্থা চীনের জন্য লাভজনক। তাঁরা মনে করেন, চীনের এই শান্তি পরিকল্পনা ইউক্রেন সংঘাতের বিষয়ে চীনের দায় ও নিরপেক্ষ অবস্থানকে প্রতিফলিত করে। অনেকে এটিকে সরাসরি পুতিনের প্রকাশ্য সমালোচনা হিসেবেও দেখছেন, কেননা এই পরিকল্পনায় সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতার লঙ্ঘন না করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে; পাশাপাশি এতে সংঘাত নিরসনের প্রতি স্পষ্ট সমর্থন ও পারমাণবিক ঝুঁকিকে খাদের কিনারে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে স্পষ্ট বিরোধিতার কথা বলা হয়েছে।

যেমন সিংহুয়া ইউনিভার্সিটির অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক কর্নেল ঝৌ বো বেইজিংয়ের রাশিয়াপন্থী অবস্থানসংক্রান্ত পশ্চিমা দাবিগুলোকে উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘চীন মোটেও ইউক্রেন সংঘাত নিরসনের সদিচ্ছা থেকে সরে থাকেনি। চীন যদি সত্যি সত্যি রাশিয়ার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধত, তাহলে এত দিনে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যেত। চীনের সবচেয়ে বড় অবদান হলো, এই সংঘাতের আগুনে ঘি ঢালতে অস্বীকৃতি জানানো এবং শান্তি আলোচনায় সব পক্ষকে উৎসাহ দেওয়া।’

দিন শেষে এটিই প্রতীয়মান হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের মধ্যে কথোপকথন থেকে দৃষ্টি সরানোর একটি ধোঁয়াশা-পর্দা হিসেবে চীনের এই শান্তি পরিকল্পনা। চীন শুরু থেকেই বস্তুনিষ্ঠতা ও নিরপেক্ষতার কথা বলে এলেও গত এক বছরে তার কাজকারবারে স্পষ্ট হয়েছে, বিশ্বসভায় নিজের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করতে ‘দায়িত্বশীল পরাশক্তি’র মতো আচরণ না করে চীন সংকীর্ণজাতীয় স্বার্থকেই প্রাধান্য দিচ্ছে।

‘আগুনে ঘি ঢালা’ বলতে চীনের নেতারা ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সামরিক সহায়তা দেওয়াকে বুঝিয়ে থাকেন। এই শব্দবন্ধ গত সোমবার চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং ব্যবহার করেছেন। তিনি পশ্চিমের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলে বলেছেন, পশ্চিমারা এই যুদ্ধে একটি পক্ষের শিবিরে ‘৩ হাজার ২০০ কোটি ডলারের অস্ত্র ঢেলে’ যুদ্ধটিকে দীর্ঘায়িত করে এখন চীনের ঘাড়ে দোষ চাপানোর চেষ্টা করছে। তিনি বলেছেন, ‘এটি নিঃসন্দেহে আধিপত্যবাদী মানসিকতাপূর্ণ দ্বিচারিতা ও নির্জলা ভণ্ডামি ছাড়া কিছু নয়।’

উপরন্তু ‘একজনের নিরাপত্তার বিনিময়ে আরেকজনের নিরাপত্তা নিশ্চিতের চেষ্টা’ করার নীতির বিরুদ্ধে থাকা চীনের শান্তি পরিকল্পনা সরাসরি ক্রেমলিনের নীতির বিরুদ্ধে যায়। বেইজিং মনে করে, ন্যাটো সম্প্রসারণের চেষ্টাকে ব্যর্থ করার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে একটি সার্বভৌম দেশের অভিযানকে যৌক্তিক বলে স্বীকৃতি দেওয়া যেতে পারে। চীন এখনো এই সংঘাতকে যুদ্ধ হিসেবে উল্লেখ না করে রাশিয়ার ভাষ্য অনুযায়ী, ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ বলে উল্লেখ করে থাকে।

গত সেপ্টেম্বরে সি চিন পিং পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করার পর থেকে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার টেলিফোনে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন। এখন তিনি আবার পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করার পরিকল্পনা করছেন। অন্যদিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিও সি চিন পিংয়ের ফোন আসার জন্য অপেক্ষা করছেন।

তবে চীন রাশিয়াকে কোনো সহায়তা করছে না বলে দাবি করলেও চীনের কাস্টমসের তথ্য–উপাত্ত উল্টো কথা বলছে। সেখানকার নথিতে দেখা যাচ্ছে, চীনের স্থানীয় কোম্পানিগুলো রাশিয়ায় চিপ রপ্তানি ১০ গুণ বাড়িয়েছে; ড্রোন রপ্তানিও বহুগুণ বেড়েছে আর অস্ত্র উৎপাদনে অত্যাবশ্যকীয় অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড রপ্তানি ৪০০ গুণ বাড়িয়েছে।

আরও পড়ুন

এসব হিসাব যদি না-ও ধরি, তাহলেও দেখা যাচ্ছে গত বছরে চীন ও রাশিয়ার মধ্যে ১৯ হাজার কোটি ডলারের ব্যবসা হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি। ইউরোপীয় দেশগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কারণে চীন কম দামে রাশিয়ার কাছ থেকে কম দামে জ্বালানি কেনার সুযোগ পায়। অন্যদিকে একই সময়ে, কিয়েভে বেইজিংয়ের মানবিক সহায়তা ছিল শূন্যের কোঠায়।

দে স্পাইজেল পত্রিকা গত সপ্তাহে একটি প্রতিবেদনে বলেছে, ইরান থেকে আমদানি করা শাহেদ-১৩৬ নামের মনুষ্যবিহীন যে ড্রোন ব্যবহার করে রুশ সেনারা কিয়েভে বেসামরিক লোক মারছেন, সেই ধরনের এক হাজার ড্রোন চীনের একটি অস্ত্র কোম্পানি আগামী এপ্রিল নাগাদ রাশিয়ায় সরবরাহ করবে। চীন অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করে যাচ্ছে। কিন্তু পরে যদি দেখা যায়, প্রাণঘাতী চীনা অস্ত্র ইউক্রেনের বাড়িঘর ধ্বংস করছে, তাহলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিষয়ে ঝৌ বোর ভবিষ্যদ্বাণীকে নিছক কথার কথা মনে হবে।

দিন শেষে এটিই প্রতীয়মান হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের মধ্যে কথোপকথন থেকে দৃষ্টি সরানোর একটি ধোঁয়াশা-পর্দা হিসেবে চীনের এই শান্তি পরিকল্পনা। চীন শুরু থেকেই বস্তুনিষ্ঠতা ও নিরপেক্ষতার কথা বলে এলেও গত এক বছরে তার কাজকারবারে স্পষ্ট হয়েছে, বিশ্বসভায় নিজের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করতে ‘দায়িত্বশীল পরাশক্তি’র মতো আচরণ না করে চীন সংকীর্ণজাতীয় স্বার্থকেই প্রাধান্য দিচ্ছে।

এখন অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, চীন যতক্ষণ না ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে সমর্থন করার দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত দেশটির শান্তি পরিকল্পনা বাকোয়াজ হিসেবে থেকে যাবে।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

  •  তুভিয়া গেরিং ইসরায়েলের ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজ (আইএনএসএস) ডায়ান অ্যান্ড গিলফোর্ড গ্লেজার ফাউন্ডেশনের ইসরায়েল-চীন পলিসি সেন্টারের একজন গবেষক