জাকাতের বিধিবিধান ও হিসাব–নিকাশ
ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত—এই সাক্ষ্য দেওয়া যে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ বা মাবুদ নেই, আর নিশ্চয় হজরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর প্রেরিত রাসুল, সালাত কায়েম করা, জাকাত প্রদান করা, হজ করা ও রমজান মাসে সিয়াম পালন করা। (বুখারি: ৭)
জাকাত শব্দের আভিধানিক অর্থ পবিত্রতা ও প্রবৃদ্ধি। জাকাত প্রদানের মাধ্যমে সম্পদ পবিত্র, আত্মা শুদ্ধ হয় এবং জাকাত প্রদানে সম্পদে বরকত হয়। জাকাত শব্দটি পবিত্র কোরআনে আছে ৩৪ বার; নামাজের সঙ্গে জোড়া শব্দ হিসেবে রয়েছে ২৬ বার।
জাকাত শব্দের আভিধানিক অর্থ পবিত্রতা ও প্রবৃদ্ধি। জাকাত প্রদানের মাধ্যমে সম্পদ পবিত্র, আত্মা শুদ্ধ হয় এবং জাকাত প্রদানে সম্পদে বরকত হয়
এ ছাড়া জাকাতের সমার্থক হিসেবে এসেছে ‘ইনফাক’ ও ‘সদাকা’। ইনফাক অর্থ আল্লাহর পথে ব্যয় করা বা আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায় ব্যয় করা। সদাকা অর্থ সততা বা সত্যবাদিতা। সদাকা প্রদানের মাধ্যমে ইমানের দাবির সত্যতা ও অন্তরের সততার প্রমাণ হয়। ‘জাকাত’, ‘ইনফাক’ ও ‘সদাকাত’—এই তিন শব্দে জাকাত বিষয়টি কোরআনে করিমে রয়েছে ৮২ বার, যা সালাত বা নামাজের সংখ্যার সমান।
মুসলিম ব্যক্তি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে সেদিন থেকে এক চান্দ্রবর্ষ (৩৫৪-৩৫৫ দিন) পূর্ণ হলে তাঁকে জাকাত প্রদান করতে হয়। এরপর তিনি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক থাকলে প্রতি চান্দ্রবর্ষে একবার জাকাত প্রদান করতে হয়। জাকাত প্রদান না করলে হালাল বা বৈধ সম্পদও হারাম মিশ্রিত হয়ে যায়। হালাল উপার্জন, হালাল সম্পদ ও হালাল খাদ্য ছাড়া নামাজ, রোজা, হজসহ কোনো ইবাদতই কবুল হয় না।
জাকাতের নিসাব হলো, সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা অথবা এর কোনো একটির সমমূল্যের নগদ টাকা বা ব্যবসার পণ্য। নিসাব পরিমাণ ও তদূর্ধ্ব সম্পদের মালিক তাঁর জাকাতযোগ্য সব সম্পদের জাকাত প্রতিবছর ২.৫% (চল্লিশ ভাগের এক ভাগ) হারে প্রদান করতে হয়।
চান্দ্রবর্ষ ৩৫৪ বা ৩৫৫ দিনে হয়, যেহেতু সৌরবর্ষ ৩৬৫ দিনে বা ৩৬৬ দিনে হয়, তাই সৌরবর্ষ অপেক্ষা চান্দ্রবর্ষ ১০ বা ১১ দিন কম। সৌরবর্ষ হিসেবে জাকাত প্রদান করতে চাইলে শতকরা ২.৫%–এর পরিবর্তে ২.৫৮% দিতে হবে, অর্থাৎ মূল জাকাতের সঙ্গে অতিরিক্ত ১১ দিনের হিসাব যোগ করতে হবে। অনুরূপ কারও জাকাত সমাপনী হিসাব তারিখ রমজানে না হলে তিনি অতিরিক্ত সময়ের জাকাত সমন্বয় করে জাকাত হিসাব তারিখ রমজানে নিয়ে আসতে পারেন।
স্বর্ণ-রুপা, নগদ অর্থ ও ব্যবসাপণ্য—এই তিন খাতে জাকাতবর্ষ পূর্তি বা জাকাত হিসাব সমাপনী দিনে যত সম্পদ থাকবে, তার পুরোটারই জাকাত দিতে হবে। জাকাতবর্ষের মধ্যে যেকোনো সময় অর্থাগম ঘটলে বছর শেষে মোট সম্পদের সঙ্গে তারও জাকাত প্রদান করতে হবে। স্বর্ণের জাকাত হলো স্বর্ণ। যেমন ৪০ ভরি স্বর্ণ থাকলে তার জাকাত হলো ১ ভরি স্বর্ণ। টাকা দিয়ে স্বর্ণের জাকাত দেওয়ার মানে হলো ওই স্বর্ণ নিজে কিনে রাখা। এ ক্ষেত্রে নতুন ওই মানের স্বর্ণের বর্তমান ক্রয়মূল্য ধরে হিসাব করে প্রদান করতে হবে।
প্রতিবছর একই তারিখে ও একই সময়ে জাকাতের হিসাব করতে হয়। যেমন ১ রমজান সন্ধ্যা ৬টা। এই সময়ের ১ সেকেন্ড আগে যে সম্পদ আসবে, তা এ বছরের জাকাত হিসাবের অন্তর্ভুক্ত হবে। এই সময়ের ১ সেকেন্ড পরে যে সম্পদ আসবে, তা পরবর্তী বছরের জাকাতের হিসাবে যাবে। জমি, বাড়ি ও গাড়ি যা বিক্রয়ের জন্য রাখা হয়নি, তা জাকাত হিসাবের অন্তর্ভুক্ত হবে না। গাড়ি, বাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট ও জমি যেগুলো বিক্রয়ের জন্য রাখা হয়েছে, সেগুলোর বর্তমান বিক্রয়মূল্য (বাজারদর) জাকাতের হিসাবে আসবে এবং এর মূল্য হিসাব করে প্রতিবছর জাকাত দিতে হবে।
জাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে তাৎক্ষণিক পরিশোধযোগ্য ঋণ এবং কিস্তিতে পরিশোধযোগ্য ঋণের চলমান কিস্তির পরিমাণ অর্থ বাদ রেখে অবশিষ্ট সম্পদের জাকাত দিতে হবে। যেসব ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা সরকারি–বেসরকারি বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণ করে থাকেন। কখনো দেখা যায়, তাঁদের সম্পদ অপেক্ষা ঋণের পরিমাণ বেশি। এ অবস্থায়ও তাঁদের ঋণ ধর্তব্য হবে না; বরং তাঁর ওই তিন খাতের সমুদয় সম্পদেরই জাকাত প্রদান করতে হবে।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম