কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শাসন কি সমাগত?

ধরা যাক, কোনো এক কোম্পানির একজন সিইও কোনো এক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, সংক্ষেপে এআই) তার সহকারী হিসেবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়ে তাকে ই-মেইল চেক করা বা কোনো ই–মেইলের উত্তরের খসড়া তৈরি করা অথবা কেনাকাটাবিষয়ক পরামর্শ দেওয়ার মতো সাধারণ কিছু কাজ দিল। কিছুদিন পর তিনি দেখলেন, এআই সেগুলো ভালোভাবেই করছে। ফলে সিইওর আস্থা বেড়ে গেল। এবার তিনি এআইকে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করা বা সরাসরি কেনাকাটা করার দায়িত্ব দেওয়ার সাহস করে ফেললেন।

প্রথম প্রথম সিইও হয়তো খুব সাবধান থাকবেন; এআই কী করছে না করছে, খুব ভালো করে খেয়াল করবেন। তারপর যখন দেখবেন, কোনো ভুল হচ্ছে না, তখন এআইকে তিনি আরও জটিল দায়িত্ব দেওয়ায় প্ররোচিত হবেন। যেমন পণ্যের নতুন কোনো মডেল তৈরি করা, বিপণন বাড়ানোর উদ্ভাবনী কৌশল বাতলে দেওয়া বা বাজারে অন্যান্য প্রতিযোগীর কোথায় কোন খুঁত বা দুর্বলতা আছে, সেগুলো খুঁজে বের করা ইত্যাদি। এবারও যখন এআই ভালো করতে থাকবে, তখন সিইওর মনে হবে, এআইকে যত স্বাধীনতা দেওয়া যাবে, তত লাভ। তারপর এমন একটা সময় আসবে যখন তিনি টের পাবেন, তিনি আসলে নামেই সিইও; সত্যিকারের নাটের গুরু হচ্ছে ওই এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।

বিবর্তনপ্রক্রিয়ার চাপেই এআই আত্মরক্ষার পথ বেছে নেবে। অনেকেই বলেন, যদি সমস্যা হয়, তাহলে আমরা এআইকে থামিয়ে দেব। কিন্তু সেটা পারা যাবে না। কারণ, এআই তো শুধু ভালো মানুষ বা ভালো দেশের হাতে থাকবে না। আর তা যদি থাকেও তো সেটা বিদ্যুৎ, ইন্টারনেটসহ অন্যান্য অবকাঠামোর সঙ্গে এমনভাবে মিশে থাকবে যে তাকে বাদ দিতে গেলে আমাদের পুরো জীবনযাত্রাই থমকে যাবে। আর প্রাকৃতিক নির্বাচনের চাপে আমরা সেই এআইকেই এড়িয়ে যাব যেটাকে আমরা সহজে বন্ধ করে দিতে পারি এবং সেই এআইর ওপরই বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ব যা বন্ধ করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব।

আমাদের মনে হয়, আমরা চাইলেই তো তার আগেই এআইর লাগাম টেনে ধরতে পারি। কিন্তু বিবর্তনের সূত্র মানলে দেখা যাবে, লাগামটা আসলে আমাদের হাতে নেই। বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী রিচার্ড লিওনটিন প্রাকৃতিক নির্বাচনের যে তিনটি পূর্বশর্তের কথা বলেছেন, সেগুলো খেয়াল করলে বোঝা যাবে, যেকোনো জীবন্ত জীবের মতো এআইরও বিবর্তন হতে পারে। শুধু তা–ই নয়, সেই বিবর্তনের গতি হতে পারে অনেক দ্রুত।

লিওনটিন বলেছেন, বিবর্তিত হতে হলে একটি বিষয়ের যে তিন শর্ত পূরণ করতে হয়, তার সব কটাই এআই পূরণ করে।

ক) তার আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে

খ) সেই বৈশিষ্ট্য সে তার পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চার করতে পারে

গ) সে দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে।

অন্যদিকে, আমরা যদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দিকে তাকাই তাহলে দেখব, যে অ্যালগরিদম মানুষকে নেশাগ্রস্ত করিয়ে যত বেশি স্ক্রিনে আটকে রাখতে পারছে, সেই অ্যালগরিদম টিকে থাকছে, অন্যগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। মোটা দাগে বললে, যে এআই যত বেশি মানুষের চিন্তা, আবেগ, ও বোধকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে, সেটাই টিকে থাকছে আর যে এআই মানুষকে যত বেশি স্বাধীনভাবে চিন্তা করার সুযোগ দিচ্ছে, সে হারিয়ে যাচ্ছে।

জীবজগতে বিবর্তনের জন্য অনেক সময় লাগে। যেমন একটা বাচ্চার জন্ম হতে সময় লাগে ৯ মাস। তারপর সেই বাচ্চাকে লেখাপড়া শিখিয়ে পূর্ণাঙ্গ মানুষ বানাতে প্রায় বিশ বছর লেগে যায়। তারপরও শুধু এক প্রজন্মে তো আর বিবর্তন হয় না। বিবর্তনের জন্য বেশ কয়েক প্রজন্ম লেগে যায়। জীবজগতে বিবর্তনের জন্য সবচেয়ে কম সময় লাগে ফ্রুট ফ্লাইদের। ১০ প্রজন্ম শেষ হওয়ার আগেই তাদের বিবর্তন দৃশ্যমান হয়। কিন্তু এআইর যেহেতু জৈব শরীর নেই, সেহেতু সে আরও অনেক কম সময়ে বিবর্তিত হতে পারে।

তিনটি কারণে আমাদের শঙ্কিত না হয়ে কোনো উপায় নেই। প্রথমত, একসময় এআইর স্রষ্টারা যদিও বলতেন যে এআইর নিয়ন্ত্রণ মানুষের হাতেই থাকবে, কিন্তু সেই নিয়ন্ত্রণ আর থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, এআই এখন নিজেই নিজেকে শেখাচ্ছে, কোনো মানুষের প্রয়োজন হচ্ছে না এবং সে এমনভাবে কাজ করছে যে তার স্রষ্টাও তার গতিবিধি ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারছে না। উন্নত কৃত্রিম নেটওয়ার্কে কী ইনপুট দেওয়া হয় সেটা আমরা বুঝি; কিন্তু ওখানকার ব্ল্যাক বক্স থেকে কী পদ্ধতিতে আউটপুট বের হয়ে আসে তার অনেকটাই আমাদের অজানা।

দ্বিতীয়ত, বিবর্তন স্বাভাবিকভাবেই স্বার্থপরতার জন্ম দেয়। ফলে এআইদের নিজেদের মধ্যে যে প্রতিযোগিতা হবে, সেটা স্বাভাবিকভাবেই অনৈতিক হয়ে উঠবে। একটি করপোরেশনের এআই যত বেশি আইনকে এড়িয়ে যেতে পারবে বা যত বেশি সে তার প্রতিযোগীর গোপন তথ্য চুরি করতে পারবে, সে তত সফল হবে। ফলে সবচেয়ে স্বার্থপর, অনৈতিক ও আইনভঙ্গকারী এআই টিকে থাকবে, অন্যগুলো লুপ্ত হবে। একটি এআই যখন এই সব কাজ করবে বা যখন সে মানুষের চাকরি ছিনিয়ে নেবে, তখন যে সে কারও ক্ষতি করার জন্য করবে তা নয়, সে তা করবে স্রেফ নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য।

তৃতীয়ত, বিবর্তনপ্রক্রিয়ার চাপেই এআই আত্মরক্ষার পথ বেছে নেবে। অনেকেই বলেন, যদি সমস্যা হয়, তাহলে আমরা এআইকে থামিয়ে দেব। কিন্তু সেটা পারা যাবে না। কারণ, এআই তো শুধু ভালো মানুষ বা ভালো দেশের হাতে থাকবে না। আর তা যদি থাকেও তো সেটা বিদ্যুৎ, ইন্টারনেটসহ অন্যান্য অবকাঠামোর সঙ্গে এমনভাবে মিশে থাকবে যে তাকে বাদ দিতে গেলে আমাদের পুরো জীবনযাত্রাই থমকে যাবে। আর প্রাকৃতিক নির্বাচনের চাপে আমরা সেই এআইকেই এড়িয়ে যাব যেটাকে আমরা সহজে বন্ধ করে দিতে পারি এবং সেই এআইর ওপরই বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ব যা বন্ধ করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব।

যা হোক, এখনো হয়তো সময় আছে। এখনো চাইলে এআইর নিয়ন্ত্রণটা আমরা আমাদের হাতেই রাখতে পারি। কিন্তু আমরা সেটা চাচ্ছি বলে তো মনে হচ্ছে না।

  • সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক পিএসসির বিজ্ঞ সদস্য এবং মাউশি ও নায়েমের সাবেক মহাপরিচালক