বিশ্বের সেরা শিল্প–চোর নিজেকে ভাবতেন ‘শিল্পের মুক্তিদাতা’

ম্যাডেলিন ডি ফ্রান্সের প্রতিকৃতি (১৪৪৩–১৪৯৫) ফ্রাঙ্কোইস প্রথম–এর জ্যেষ্ঠ কন্যা, স্কটসের রানী, জ্যাক ভি এর প্রথম স্ত্রী। এ শিল্পকর্মটি আঁকেন কর্নেইল ডি লিয়ন (১৫০০/১৫১০–১৫৭৪)। ক্যাসেল মিউজিয়াম, ভার্সাই, ফ্রান্স

‘প্রথমেই যা করবেন, তা হলো, জাদুঘর থেকে শিল্পকর্ম চুরির যত সিনেমা দেখেছেন, সেগুলো ভুলে যাবেন।’ শিল্প–চোরের প্রথম টিপস ছিল এটা। ‘ছাদের জানালা, ধুম্রবোমা কিংবা গোলাগুলি খুব সিনেম্যাটিক মনে হতে পারে। কিন্তু আপনি যদি জেলে যেতে না চান, তাহলে এসব পদ্ধতি হলো শিল্পকর্ম চুরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে অকার্যকর ও ভয়ানক পদ্ধতি।’

শিল্পকর্ম চুরির ইতিহাসে স্টেফান ব্রেইটউইজার (৫২) সর্বকালের সেরা চোর। ইউরোপের অসংখ্য জাদুঘর ও গির্জা থেকে তিনি প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার মূল্যের শিল্পকর্ম চুরি করেন।

আমি যখন ব্রেইটউইজারকে নিয়ে বই লেখার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, তিনি আমাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তাঁর অপরাধী মনের নাগালও পাই সে সময়। তিনি নিজেই তাঁর চরিত্রের এই অংশ প্রকাশ করেন।

জোর করে জাদুঘরের দরজা খোলা, জানালা দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে জাদুঘরে ঢোকা অথবা ছাদের জানালা থেকে দড়ি বেয়ে নিচে নামার কোনো প্রয়োজন নেই। এমনকি জাদুঘর যখন বন্ধ, তখনো আসার দরকার নেই।

সাধারণত চুরির জন্য সবচেয়ে ভালো সময় হলো দুপুরের খাবার সময়। এ সময় ভিড় কিছুটা পাতলা হয়ে আসে, নিরাপত্তারক্ষীরাও পালাক্রমে খেতে যান।

গাড়ি কোথায় পার্ক করবেন, তা নিয়েও খুব বিচলিত হওয়ার দরকার নেই। জাদুঘরের কাছাকাছি কোনো একটা জায়গায় পার্ক করলেই হলো।

একা আসবেন না। চারদিকে নজর রাখার জন্য বিশ্বস্ত কাউকে সঙ্গে নিন। ব্রেইটউইজারের সঙ্গে থাকতেন তাঁর পুরোনো বান্ধবী অ্যান-ক্যাথরিন ক্লাইনক্লাউজ।

এমন পোশাক পছন্দ করবেন যা তাঁদের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যায় এবং ভিড়ের সঙ্গে মিশে যেতে পারেন এমন কিছু।

শীতল আবহাওয়া ব্রেইটউইজারের মতে চুরির জন্য উপযুক্ত। কারণ, এমন আবহাওয়ায় আপনি ওভারকোট গায়ে দিতে পারবেন। শুধু দুটো জিনিস খেয়াল রাখতে হবে। যে কোট পরে আপনি চুরি করতে যাচ্ছেন, সেটা যেন এক সাইজ বড় হয় আর প্যান্টটাও যেন কোমরের কাছে একটু ঢিলা হয়।

সুইস আর্মি নাইফ ছাড়া আর কিছু সঙ্গে নিতে হবে না। আর এটা রাখতে হবে কোটের পকেটে।

সবচেয়ে ভালো হয়, আপনি যদি জাদুঘরে ঢোকার জন্য নির্ধারিত ফটক দিয়ে ঢোকেন। আর হ্যাঁ, আপনার ও আপনার সঙ্গীর জন্য টিকিট কাটবেন। কার্ড ব্যবহার করবেন না, নগদ অর্থে পরিশোধ করবেন টিকিটের দাম।

ভেতরে ঢোকার পর দর্শনার্থীদের ঘোরাফেরা ও সার্ভেইল্যান্স ক্যামেরাগুলো শনাক্ত করা হলো প্রথম কাজ। নিরাপত্তারক্ষীরা কি বসে আছেন, নাকি টহল দিচ্ছেন?

যে কক্ষে দর্শনার্থীর ভিড় কিছুটা কম, সে রকম একটি কক্ষ বেছে নিন। সবচেয়ে ভালো হয়, একটি মাত্র প্রবেশপথ আছে, এমন একটি গ্যালারি বেছে নিলে। আর হ্যাঁ, কক্ষটি যেন ক্যামেরা বা স্থায়ী কোনো নিরাপত্তারক্ষীর নজরদারির মধ্যে না থাকে। এমন জায়গা জাদুঘরের মধ্যে খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন নয়। বিশেষ করে ছোটখাটো জাদুঘরে।

চুরির জন্য যে শিল্পকর্ম বাছাই করবেন, সেটিকে হতে হবে ছোট। যেমন কোনো ভাস্কর্য যদি পছন্দ হয়, তাহলে সেটিকে সর্বোচ্চ একটি ইটের সমান হতে হবে। পিৎজার বাক্সের চেয়ে বড় তো কোনোভাবেই নয়।

তবে তার চেয়ে বড় কথা, শিল্পকর্মটির নন্দনতাত্ত্বিক গুরুত্ব থাকতে হবে। এত ঝুঁকি নিয়ে এমন একটা শিল্পকর্ম আপনি নিলেন, যা আপনার ঠিক পছন্দসই হলো না, তাহলে ধরে নিতে হবে, আপনি যথেষ্ট বুদ্ধিমান নন।

আপনার সঙ্গীকে কক্ষের একদম প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে বলবেন। সতর্কসংকেত কী হবে, তা আগেই ঠিক করে নিন। ব্রেইটউইজার ও ক্লাইনক্লাউজের জন্য গলা ঝাড়া ছিল সতর্কসংকেত।

যদি কক্ষে দর্শনার্থী থাকেন, তাহলে তাঁদের বেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। তারপর খুব দ্রুত আপনার কাঙ্ক্ষিত শিল্পকর্মটির দিকে এগিয়ে যান। যদি এটি কোনো একটি ডিসপ্লে-কেসের মধ্যে থাকে, তাহলে ধরে নিতে হবে, এটি তালাবদ্ধ অবস্থায় আছে। সমস্যা নেই। কারণ, আপনি এটি ডিসপ্লে-কেসের তালা খুলে বের করে আনবেন না। ওটা বেশ কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ হবে। তালা খোলার দরকার নেই, ব্রেইটউইজার যাকে বলছেন ‘সিলিকন স্লাইস’, সেই পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে।

জাদুঘরের ডিসপ্লে-কেস সাধারণত টেম্পার্ড গ্লাস (সাধারণ কাচের চেয়ে শক্তিশালী, নিরাপদ এবং তাপমাত্রাসহনশীল) বা স্বচ্ছ অ্যাক্রিলিক যেমন প্লেক্সিগ্লাস অথবা লুসাইটে তৈরি হয়। এর কোনার দিকটা সাঁটা থাকে সিলিকন আঠা দিয়ে।

একজন শল্যচিকিৎসক যেভাবে কাটেন, ঠিক সেভাবে কোনার দিকে একটা ‘অস্ত্রোপচার’ করতে হবে আপনার সঙ্গে থাকা সুইস আর্মি নাইফ দিয়ে। চুলের মতো সরু করে লম্বালম্বি ও আড়াআড়ি কাটলে প্যানেলটা খুলে আসবে।

যদি আপনার সঙ্গী যদি কাশি দেন, তাহলে কাটাকাটি বন্ধ করে প্যানেলে ধাক্কা দিয়ে বন্ধ করে ফেলুন। প্যানেলটা ঠিকঠাক লেগে যাওয়ার কথা। যদি কোনো নিরাপত্তারক্ষী বা পর্যটক ঢুকে পড়েন, তাহলে আপনার জায়গা পরিবর্তন করুন এবং খুব মনোযোগ দিয়ে ওই কক্ষের শিল্পকর্মগুলো পর্যবেক্ষণের ভান ধরুন। গ্যালারি ছেড়ে সবাই চলে গেলে আবারও কাজে ফিরে যান।

কখনো কখনো দুই থেকে তিনবার কাজ থামাতে হতে পারে আপনাকে। একটি কক্ষে বেশি সময় ব্যয় করবেন না। সর্বোচ্চ ১৫ মিনিট। যদি দেখেন, যে কক্ষ থেকে আপনি শিল্পকর্মটি সরাতে চাইছেন সেখানে প্রচুর ভিড়, তাহলে চুরির পরিকল্পনা বাদ দিন। অন্য একটি কক্ষ, অন্য একদিন বা অন্য একটা জাদুঘর বেছে নিন।

‘সিলিকন স্লাইসের’ সৌন্দর্য হলো, প্যানেলটা এমনভাবে খোলে যে আপনি স্বচ্ছন্দে আপনার হাত ঢুকিয়ে শিল্পকর্মটি বের করে আনতে পারবেন। আপনার পছন্দের শিল্পকর্মটি প্যানেলের ফাঁকা জায়গা থেকে বের করে নিন। তারপর ওভারকোট সরিয়ে প্যান্টের কোমরের দিকে পাচার করে দিন। তারপর আপনার কোটটি ঠিকঠাক করে নিন। এমনভাবে কাজটি করুন যেন শিল্পকর্মটি ঢাকা থাকে। একটুখানি ফুলে থাকতে পারে, তবে ব্রেইটউইজার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে ওটুকু ফোলায় কারও চোখ পড়বে না।

শিল্পকর্ম চুরিতে নামার আগে বিবেকটাকে ছুটি দিতে হবে। আর নয়তো চুরিটাকে জায়েজ করতে মনগড়া যুক্তি দাঁড় করাতে হবে। ব্রেইটউজার নিজেকে শিল্প–চোরের বদলে শিল্পের মুক্তিদাতা হিসেবে প্রচার করতে বেশি ভালোবাসতেন। এর পেছনে তাঁর যুক্তি হলো, তিনি এসব মাস্টারপিসকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করছেন।

আপনি যদি ছবি চুরি করতে চান, তাহলে সহজ পন্থা হলো, দেয়াল থেকে তা নামিয়ে নেওয়া। তবে এখানে সমস্যা হলো ছবি যত ছোটই হোক না কেন, সেটিরও ফ্রেম সাধারণত ভারী হবে। তাই কক্ষ যত বড়ই হোক না কেন, ছবি ওভারকোটের নিচে লুকিয়ে বের করে আনা কঠিন।

ব্রেইটউইজারের সমাধান হলো, আপনি ছবিটা উল্টো করে একটি ডিসপ্লে কেস বা মেঝেতে রাখুন। ফ্রেম থেকে ছবি বের করে আনার আগে তিনি তাঁর সুইস আর্মি নাইফ দিয়ে পেরেক-টেরেকগুলো সরিয়ে নিতেন। এতটা সময় নিয়ে সূক্ষ্মভাবে কাজটি করার সুযোগ না হলে ব্রেইটউইজার ছবি দেয়ালে ঝুলিয়ে খালি হাতে ফিরে আসতেন। ফ্রেম সরিয়ে নেওয়ার পর ব্রেইটউইজার সেটিকে গ্যালারির জানালার পেছনে স্তূপ করে অথবা কোনো একটা আসবাবপত্রের নিচে রেখে আসতেন।

ফ্রেম সরানোর দক্ষতা অর্জন করতে তিনি একটি অত্যন্ত মানসম্পন্ন ফ্রেম বাঁধানোর দোকানে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করেছেন। নিরাপত্তারক্ষীদের কাজের ধরন ও মনস্তত্ত্ব বুঝতে এক গ্রীষ্মে নিরাপত্তারক্ষীর কাজও করেছেন। তাঁর মতে, যেকোনো ভালো চোরের প্রস্তুতিটা হতে হয় একদম পাক্কা।

জাদুঘরে ফ্রেম ছাড়া ছবিও থাকে। ব্রেইটউইজারের মতে, এসব ছবি একদম নবজাতকের মতো ভঙ্গুর। খুব সাবধানে শার্ট ও ওভারকোটের নিচে পিঠের দিকে এগুলোকে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

এখন জাদুঘর থেকে বেরিয়ে আসার পালা। আপনি যতই কুশলী হোন না কেন, শিল্পকর্ম খোয়া যাওয়ার খবর চাউর হতে খুব বেশি সময় লাগে না। আর জানার সঙ্গে সঙ্গেই জরুরি ভিত্তিতে সাড়া দেয় কর্তৃপক্ষ। পুলিশ হাজির হয়। জাদুঘরের দরজা বন্ধ করে পর্যটকদের তল্লাশি করা হয়।

কাজ সেরে দ্রুত জাদুঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রধান ফটকে চলে যেতে হবে। কিন্তু দৌড়ানো যাবে না, এমনকি পুলিশের গাড়ির সাইরেন কানে গেলেও না। আপনি হেঁটে আপনার গাড়ির দিকে যান। চুরি করা শিল্পকর্মটি সিন্দুকে ঢোকান এবং ঘটনাস্থল ত্যাগ করুন।

জোরে গাড়ি চালাবেন না। বাড়ি পৌঁছানোর আগে রাস্তায় পুলিশ থামালে ঝামেলায় পড়তে পারেন। একবার বাড়ি পৌঁছে শিল্পকর্মটি এমন জায়গায় রাখুন, যেখানে কেউ ভুলেও ঢুকবে না। ব্রেইটউইজার ও ক্লাইনক্লাউজ লুট করা জিনিসপত্র তাঁদের শোবার ঘরে রাখতেন। এই ঘরটা সব সময় তালাবদ্ধ থাকত।

ব্রেইটউইজার বলেন, ‘আপনার চুরি করা শিল্পকর্মকে মন থেকে ভালোবাসুন। কিন্তু একটা ভুল কখনোই করবেন না। সেটা হলো, টাকার অভাবে শিল্পকর্ম বিক্রি করবেন না। শিল্পকর্ম চুরির তদন্তকারী পুলিশ সদস্যরা বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত। তাঁরা কেনাবেচার খোঁজখবর রাখেন সব সময়।’

ব্রেইটউইজার বলেন, ‘যদি আপনার টাকার দরকার হয়, তাহলে কাজ খুঁজে নিন।’ শিল্পকর্ম চুরির চেয়ে টাকা কামানো তাঁর ভাষায় অনেক সহজ।

যত খুশি শিল্পকর্ম চুরি করুন। ১৯৯৫ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী সাত বছর প্রতি দুই সপ্তাহে একবার ব্রেইটউইজার ও ক্লাইনকাউজ চুরি করেছেন।

তবে এ কাজে নামার আগে বিবেকটাকে ছুটি দিতে হবে। আর নয়তো চুরিটাকে জায়েজ করতে মনগড়া যুক্তি দাঁড় করাতে হবে। ব্রেইটউজার নিজেকে শিল্প–চোরের বদলে শিল্পের মুক্তিদাতা হিসেবে প্রচার করতে বেশি ভালোবাসতেন। এর পেছনে তাঁর যুক্তি হলো, তিনি এসব মাস্টারপিসকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করছেন।

আর সবচেয়ে ভালো হয়, আপনার যদি কোনো বন্ধু বা স্বজন না থাকেন, কিংবা আপনার যদি কখনো ঘরের জিনিসপত্র মেরামত করার কোনো প্রয়োজন না পড়ে। তাহলে কখনো কাউকে আপনার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানানোর দরকার হবে না।

সব শেষ কথা হলো, শিল্পকর্ম চুরি বা লুকানোর সময় কোনো ভুল করা চলবে না। যেহেতু আপনি মানুষ, ভুল না করাটাই অসম্ভব। তাই কারাগারে যাওয়া ও থাকার জন্য প্রস্তুত থাকুন। ব্রেইটউজারকেও বছরের পর বছর জেলে থাকতে হয়েছে। মেনে নিন যে অপরাধীর খাতায় আপনার নাম উঠবে।

অথবা জাদুঘরের কাজটা ছেড়ে দিন। যখন মন চাইবে, গিয়ে নাহয় শিল্পকর্মগুলো দেখেই আসবেন।

  • মাইকেল ফিনকেল ‘দ্য আর্ট থিফ: আ ট্রু স্টোরি অব লাভ, ক্রাইম অ্যান্ড আ ডেঞ্জারাস প্যাশন’ বইয়ের লেখক

টাইম ম্যাগাজিন থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: শেখ সাবিহা আলম