রাশিয়ার ভেতরেই শক্ত অবস্থান গড়ার উদ্দেশ্য কী তুরস্কের?

গত বছরের আগস্ট মাসে সোচিতে পুতিন ও এরদোয়ান বৈঠকের পর তুরস্ক–চেচনিয়া উত্তেজনা স্তিমিত হয়
ছবি : রয়টার্স

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যত দিন গড়াচ্ছে, তুরস্ক ততই রাশিয়ার প্রভাবাধীন অঞ্চল, যেমন মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ ককেসাসে তাদের ভূরাজনৈতিক প্রভাব তৈরি করছে। এমনকি রাশিয়ান ফেডারেশনের ভেতর, যেখানে মস্কোর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, এমন অঞ্চলেও তুরস্ক ধীরে ধীরে অবস্থান শক্তিশালী করছে।

এটা অবশ্য কোনো গোপন বিষয় নয় যে তুরস্কের কিছু রাজনৈতিক গোষ্ঠী রাশিয়ান ভূখণ্ডের কিছু অংশকে ‘তুর্কি বিশ্ব’-এর অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তুরস্কের রক্ষণশীল সংবাদপত্র কারাক রাশিয়ার ১০টি অঞ্চলের তালিকা প্রকাশ করেছিল, যার মধ্যে তাতারিস্তান, চুভাশিয়ার নাম ছিল। এ অঞ্চলগুলোকে পত্রিকাটি ‘স্বায়ত্তশাসিত তুর্কি রিপাবলিক’ বলে আখ্যায়িত করেছিল।

তিন মাস আগে তুরস্কের ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির শরিক দল ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট পার্টির নেতা ডেভলেট বাচেলি ‘তুর্কি বিশ্ব’-এর একটি বিতর্কিত ম্যাপ প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইপে এরদোয়ানকে উপহার দেন। এই ম্যাপে রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের কুবান ও রসটভ এবং উত্তর ককেশাস, পূর্ব সার্বিয়া ও ২০১৪ সালে রাশিয়ার অধিকৃত ক্রিমিয়াও ছিল। প্রতিবাদ করার বদলে ক্রেমলিন বরং এ ঘটনায় তুরস্ককে তারিফ করেছে। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেন, বাচেলি যে এরদোয়ানকে উপহার দিয়েছেন, এর মধ্যে লজ্জাজনক কিছু নেই। তাঁর মত হলো, নিজ জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার প্রচেষ্টা করছে তুরস্ক।

কিন্তু এসব ঘটনা থেকে তুরস্কের নতুন পররাষ্ট্রনীতির গতিপথ সম্পর্কে স্পষ্ট করে জানা যাচ্ছে। ইউক্রেনে বেকায়দায় পড়ার পর রাশিয়া তুরস্কে অবস্থানরত রুশ নাগরিকদের স্বার্থরক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এদিকে তুরস্কে রুশ নাগরিকদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে গত বছরের সেপ্টেম্বরে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সেনাবাহিনীতে নতুন নিয়োগের ঘোষণা দেওয়ার পর এ সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। এসব রুশ নাগরিক তুরস্কে বসবাসের ক্ষেত্রে সমস্যার মুখে পড়ছেন। বৈধ কাগজপত্র ছাড়া তাঁরা তুরস্ক ছাড়তে পারছেন না।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ক্রেমলিনের অবস্থান দুর্বল হওয়ায় তুরস্ক এখন রাশিয়ান ফেডারেশনের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব বৃদ্ধি করছে। ইউক্রেন যুদ্ধের দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল হিসেবে রাশিয়ান ফেডারেশন যদি ভেঙে যায়, তাহলে তাতারিস্তান, দাগেস্তান, সাখা, ইঙ্গুশেতিয়া—এমনকি চেচনিয়াও তুরস্কের সঙ্গে জোট গড়তে ইচ্ছুক হবে।

একই সময়ে আবার এরদোয়ান সরকার ক্রিমিয়ার তাতার ও রাশিয়ার বিভিন্ন এলাকার তুর্কিভাষী মুসলমানদের তুরস্কে বসবাসের জন্য দীর্ঘমেয়াদি কার্ড দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আঙ্কারার বার্তা খুব পরিষ্কার—রাশিয়ান নাগরিকদের মধ্যে যাঁদের শিকড় তুর্কি জাতির সঙ্গে সংযুক্ত, রেসিডেন্ট কার্ড পাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁরা অগ্রাধিকার পাবেন। উত্তর ককেশাসে অবস্থিত রাশিয়া ফেডারেশনের অশান্ত অঞ্চল দাগেস্তান। এ অঞ্চলের সঙ্গে বছরের পর বছর ধরে সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলে তুরস্ক।তাতারিস্তানের প্রধান উন্নয়ন সহযোগী এখন তুরস্ক।

২০২১ সালে আঙ্কারা তাতারিস্তানে আড়াই বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে। ওই বছর রাশিয়াসহ ৭৯টি দেশকে পেছনে ফেলে সেখানকার শীর্ষ বিনিয়োগকারী দেশ হয়ে ওঠে তুরস্ক। তাতারিস্তানের প্রেসিডেন্ট রুস্তম মিনিখানভ আঙ্কারা সফরের পর এই বিনিয়োগ আছে। এরদোয়ানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে রুস্তম দুই অঞ্চলের সম্পর্ক গভীর করার ওপর জোর দেন। অর্থনৈতিক সহযোগিতায়, বিশেষ করে উৎপাদন খাতে বিনিয়োগের চুক্তি হয়।

গত বছরের মে মাসে তাতারিস্তানের রাজধানী কাজানে একটি আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সম্মেলনে তুরস্ক ও তাতারিস্তানের কর্মকর্তারা ব্যবসা-বাণিজ্যের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির প্রতিশ্রুতি দেন। রাশিয়ান বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ইসলামি বিশ্বের সঙ্গে অর্থনৈতিক সংযোগের প্রবেশদ্বার হিসেবে তাতারিস্তানকে বিবেচনা করে রাশিয়া। কিন্তু রাজনৈতিক দিক থেকে বিবেচনা করলে, ক্রেমলিন চেচনিয়া ও এর নেতা রমজান কাদিরভকে ইসলামি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বেশি উপযুক্ত মনে করে।

চেচেন নেতা কাদিরভের সঙ্গে তুরস্কের বাজে সম্পর্কের কারণে রাশিয়া অবধারিতভাবে একটি বাস্তব সমস্যার মুখে পড়েছে। তুরস্কে বসবাসরত একের পর এক চেচেন ভিন্নমতাবলম্বীকে হত্যার সঙ্গে কাদিরভের সম্পৃক্ততা ছিল। একই সঙ্গে তুরস্কের মাটিতে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কাদিরভ কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা আবদুল্লাহ অকালানের একটি ভাস্কর্য স্থাপনের হুমকি দেন। তুরস্ক তাঁকে চিরশত্রু বলে মনে করে। তুরস্কের একটি পার্কের নাম চেচেন বিদ্রোহী নেতা দুজোকার দুদায়েভে নামে করার পর হুমকিটি দিয়েছিলেন কাদিরভ। গত বছরের আগস্ট মাসে সোচিতে পুতিন ও এরদোয়ান বৈঠক করার পর সেই পরিকল্পনা এমনিতেই স্তিমিত হয়ে যায়। এরপর তুরস্ক চেচেন রিপাবলিকের সঙ্গে বিনিয়োগ, বাণিজ্যসহ নানা বিষয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে শুরু করে।

রাশিয়া-সংক্রান্ত বিষয়ে তুরস্কের নাকগলানোর সাম্প্রতিক ঘটনাটি গত মাসে ঘটেছে। উত্তর ককেশাসে অবস্থিত রাশিয়ান ফেডারেশনের অংশ ইঙ্গুশেতিয়ার নির্বাসিত নেতারা ইস্তাম্বুলে সমবেত হয়েছিলেন তাঁদের অঞ্চলের স্বাধীনতা ঘোষণার দাবি নিয়ে। ইঙ্গুশের নেতারা একটি বিবৃতি দেন, যেখানে স্বাধীনতার জন্য ইঙ্গুশ সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ায় এবং সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিচয় রক্ষার আহ্বান জানানো হয়।

এ ক্ষেত্রেও ক্রেমলিন এমন করে চোখ বন্ধ করে রেখেছে যে কিছুই ঘটেনি। তাতারিস্তান, দাগেস্তান ও অন্যান্য অঞ্চলের ব্যাপারে রাশিয়ার উদ্বেগ-সংক্রান্ত প্রশ্নে উত্তর দিতে এরদোয়ান তুরস্কের জাতীয় টেলিভিশনে উপস্থিত হন। রাশিয়ার যেসব অঞ্চলে তুর্কি ও মুসলমানেরা বাস করেন, সেসব অঞ্চলে আঙ্কারা তার উপস্থিতি বাড়ানো সত্ত্বেও ক্রেমলিন তুরস্কের সঙ্গে যেকোনো মূল্যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে ইচ্ছুক।

আরও পড়ুন

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ক্রেমলিনের অবস্থান দুর্বল হওয়ায় তুরস্ক এখন রাশিয়ান ফেডারেশনের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব বৃদ্ধি করছে। ইউক্রেন যুদ্ধের দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল হিসেবে রাশিয়ান ফেডারেশন যদি ভেঙে যায়, তাহলে তাতারিস্তান, দাগেস্তান, সাখা, ইঙ্গুশেতিয়া—এমনকি চেচনিয়াও তুরস্কের সঙ্গে জোট গড়তে ইচ্ছুক হবে।

ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া যেভাবে সমস্যায় পড়েছে, তাতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে তুরস্ক অনেক বেশি সুবিধা আদায় করতে পারছে।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ
নিকোলা মিকোভিচ সার্বীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক