আমাদের স্বাধীনতা দিবস

আজ ২৬ মার্চ, আমাদের ৫৪তম স্বাধীনতা দিবস বা ৫৩তম স্বাধীনতা বার্ষিকী। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস কেন, এ নিয়ে তর্ক হতেই পারে। একটু পেছন ফিরে যাওয়া যাক। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর যখন পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢাকায় ও অন্যান্য স্থানে আত্মসমর্পণ করে, তখন আমরা মুক্তির স্বাদ পেতে শুরু করি। ওই দিন থেকে মানুষ নিজেদের স্বাধীন ভাবতে শুরু থাকে। পরে অবশ্য ১৬ ডিসেম্বরকে বিজয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

আমরা যারা একাত্তরের ঘটনাবলির প্রত্যক্ষদর্শী, আমরা দেখেছি ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় গণপরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হলে জনতা ক্ষোভে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে, প্রকাশ্যে পাকিস্তানি পতাকা পোড়ায় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে দেয়। সাধারণ মানুষের কাছে পয়লা মার্চ থেকেই পাকিস্তান মৃত। পাকিস্তান সরকারের একতরফা ঘোষণার প্রতিবাদে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেন।

ছাত্ররা ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন প্রাঙ্গণে স্বাধীন বাংলার পতাকা তোলে। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে এক জনসমাবেশে শেখ মুজিবের উপস্থিতিতে ছাত্ররা স্বাধীন বাংলার ইশতেহার পাঠ করে রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে ঘোষণা দেয়। ৪ মার্চ শেখ মুজিবের আহ্বানে আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক লে জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান সেনাবাহিনীকে তখনকার মতো সেনানিবাসে ফিরিয়ে নিলে ঢাকার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় শেখ মুজিবের হাতে।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ নতুন করে গণপরিষদের অধিবেশন ডাকেন। ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) শেখ মুজিব স্মরণকালের বৃহত্তম জনসমাবেশে পাকিস্তান সরকারের কাছে চার দফা দাবি পেশ করে আলটিমেটাম দেন। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, এই দাবিগুলো না মানা হলে তিনি পরিষদের অধিবেশনে যাবেন না। তাঁর ভাষণের মাঝামাঝি এবং শেষে তিনি দুবার উচ্চারণ করেন: এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। তিনি প্রশাসন নিজের হাতে নিয়ে নেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলের প্রাদেশিক সাধারণ সম্পাদক নানান প্রশাসনিক বিধিবিধান জারি করতে থাকেন। দেশে পাকিস্তানের প্রশাসন অচল হয়ে যায়।

এরপর ইয়াহিয়া খান ও তাঁর উপদেষ্টারা একে একে ঢাকায় আসতে থাকেন। শুরু হয় মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক। সেখানে চলে দর-কষাকষি। এ সম্পর্কে ইয়াহিয়া খানের ভাষ্য পাওয়া যায়। শেখ মুজিবুর রহমানের কোনো লিখিত ভাষ্য পাওয়া যায় না।

২৫ মার্চ জনমনে ধারণা দেওয়া হয়, একটা সমঝোতা প্রায় হয়ে গেছে এবং ইয়াহিয়া খান একটি অধ্যাদেশ জারি করে সবকিছুর ফয়সালা করে দেবেন। সেটি হয়নি। ২৫ মার্চ রাতে ঘুমন্ত ঢাকা মেশিনগান আর কামানের আওয়াজে প্রকম্পিত হয়। ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনী পিলখানার সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর (ইপিআর) সদর দপ্তর, রাজারবাগে পুলিশের আস্তানা আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অতর্কিতে হামলা চালায়। রাত বারোটার আগেই ইপিআর আর পুলিশের প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। সে প্রতিরোধ বেশিক্ষণ টেকেনি। প্রায় বিনা বাধায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। গ্রেপ্তার হন শেখ মুজিবুর রহমান। অন্য রাজনৈতিক নেতারা আত্মগোপনে যান এবং একে একে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। ভারত সীমান্ত খুলে দিয়েছিল।

আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ ৩ এপ্রিল ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) সাহায্যে দিল্লি পৌঁছান। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে পরামর্শ করে তিনি গঠন করেন প্রবাসী সরকার। বিএসএফের মুখ্য আইন কর্মকর্তা কর্নেল এন এস বেইনস বাংলাদেশের জন্য একটি ‘সংক্ষিপ্ত সংবিধান’-এর খসড়া তৈরি করে দেন। এটি তাজউদ্দীন আহমদ ও তাঁর সহকর্মীরা চূড়ান্ত করেন। এটিই ছিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, যা ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা গ্রামে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠানে পাঠ করা হয়েছিল। ২৬ মার্চ বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করে বলে এই ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়।

চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী মেজর জিয়াউর রহমান ২৭ মার্চ বিকেলে নিজ হাতে একটি স্বাধীনতার ঘোষণা লিখে নিজেই পাঠ করেন। পরে অনেকেই তাঁকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে দাবি করেন। এ নিয়ে অনেক কুতর্ক-বিতর্ক হয়। ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি ঢাকায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভার উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু বিতর্কটির ইতি টানেন এই বলে; ‘ইতিহাস কখনো মিথ্যা করতে নাই।… ৭ মার্চ কি স্বাধীনতাসংগ্রামের কথা বলা বাকি ছিল? প্রকৃতপক্ষে ৭ মার্চই স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল। সেদিন পরিষ্কার বলা হয়েছিল, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

স্বাধীনতা দিবস ব্যাপারটি প্রতীকী। পয়লা মার্চ, ৭ মার্চ, ২৫ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর—যেকোনো একটি দিন বেছে নিলেও মহাভারত অশুদ্ধ হতো না। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস হিসেবে উদ্‌যাপন করার একটা আবেগপ্রবণ গুরুত্ব আছে। ১৯৭১ সালে প্রবাসে যে বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার আইনি ভিত্তি দেওয়া হয় স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে, যেখানে ২৬ মার্চের কথা বলা হয়েছে। এটা এখন মীমাংসিত সত্য। এ নিয়ে বাহাস করা অর্থহীন।

স্বাধীনতা দিবস আমাদের কলোনিয়াল লিগেসি বা ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারের কথা মনে করিয়ে দেয়। আমরা একদা পরাধীন ছিলাম। পরাধীন না থাকলে স্বাধীনতা দিবসের কোনো দরকার হয় না। আমাদের দরকার ছিল। এর আগে আমাদের স্বাধীনতা দিবস ছিল ১৪ আগস্ট, যেদিন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পাকিস্তান, এবং আমরা স্বেচ্ছায় ওই পাকিস্তানের অংশ হয়েছিলাম।

এখানে তারিখ গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো কেন আমাদের স্বাধীনতা চাইতে হলো। নিশ্চয়ই আমরা আগের অবস্থায় খুশি ছিলাম না। আমরা যাতে আরও ভালো থাকতে পারি, আমাদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে আমরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারি, সে জন্যই তো স্বাধীনতা।

আমরা একটা প্রতিরোধযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছি। আমরা এই যুদ্ধকে বলি মুক্তিযুদ্ধ। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া দেশের সবাই এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশ নিয়েছিলেন। আরেকটা কথা ভুলে গেলে চলবে না। এই স্বাধীনতার জন্য লাখ লাখ মানুষকে জীবন দিতে হয়েছিল। তাঁরা কেউ স্বাধীনতার ফল ভোগ করে যাননি। আমরা যেন তাঁদের কথা ভুলে না যাই।

আমাদের ভাগ্য আমরা গড়ব, আমাদের সিদ্ধান্ত আমরা নেব, এ জন্যই স্বাধীনতা চেয়েছিলাম, স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম, অকাতরে সম্পদ, সম্ভ্রম, প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলাম। এ ক্ষেত্রে আমাদের কতটুকু অর্জন, কতটুকু ঘাটতি, তা খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে আমরা আসলে কতটা স্বাধীন।

আমরা যদি সমষ্টিগতভাবে আগের চেয়ে ভালো থাকি, তাহলে বলব, স্বাধীনতার সুফল আমরা পাচ্ছি। যদি আমাদের অবস্থা আগের থেকে খারাপ, তাহলে বলব, এই স্বাধীনতা তো আমরা চাইনি। আমাদের যার যার অবস্থান থেকে বিবেচনা করে দেখতে হবে আমরা এখন কোথায় দাঁড়িয়ে আছি। দিবস উদ্‌যাপন একটা প্রথাগত অনুষ্ঠান মাত্র। আমাদের চাওয়া-পাওয়ার মধ্যকার ব্যবধান যত কমে আসবে, আমাদের স্বাধীনতার মাত্রা তত বেশি হবে।

  • মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক