মোদি কোন বিশ্বাসে চীনের দিকে ঝুঁকলেন

সি চিনপিং, নরেন্দ্র মোদি ও ডোনাল্ড ট্রাম্পফাইল ছবি: রয়টার্স

সাত বছর পর চীন সফরে গিয়ে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠকের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, পৃথিবীর ২৮০ কোটি মানুষ যে দুই দেশের বাসিন্দা, তাঁদের সহযোগিতা ও একসঙ্গে পথচলা মানবজাতির পক্ষে কল্যাণকর। প্রত্যুত্তরে সি চিন পিংয়ের বার্তা, দুই প্রাচীনতম সভ্যতা ও সবচেয়ে জনবহুল রাষ্ট্রকে বন্ধু ও সৎ প্রতিবেশী হয়ে থাকতে হবে। ড্রাগন ও হাতি একসঙ্গে এগোক—এটিই সময়ের দাবি।

ভারত ও চীন প্রতিবেশী হলেও একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। সম্পর্কও আমে-দুধে নয়; ১৯৬২ সালে দেশ দুটি যুদ্ধ করেছিল। সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তবিরোধ আজও অমীমাংসিত। সেই বিরোধেরই পরিণতি ২০২০ সালের গালওয়ান সংঘর্ষ। অরুণাচল প্রদেশকে চীন এখনো তাদের অংশ মনে করে। ৬৬ বছর কেটে গেলেও দালাই লামার আচরণ নিয়ে এখনো আপত্তি জানায়।

দুই প্রতিবেশীর সহযোগিতা যত, রেষারেষিও ততটাই। কেউই প্রকৃত অর্থে পরস্পরের বন্ধু নয়। বরং ভারতের যে চিরকালীন শত্রু, দেশভাগের পর যার সঙ্গে চারবার যুদ্ধে জড়িয়েছে, সাড়ে তিন দশক ধরে জম্মু-কাশ্মীরে যাদের রপ্তানি করা সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে, সেই পাকিস্তানের সর্বঋতুর অকৃত্রিম বন্ধু চীন।

আরও পড়ুন

বন্ধু বলেই অপারেশন সিঁদুরের সময় পাকিস্তানকে তারা ‘স্যাটেলাইট ইন্টেলিজেন্স ইনপুট’ বিরামহীন সরবরাহ করেছে, যা তাদের দেওয়া জে-৩৫ ফাইটার বিমান ও পিএল ১৫ ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা কার্যকর করতে উপযোগী। কাজেই চীনকে ভারত কখনোই বিশ্বস্ত মনে করে না; কিন্তু তা সত্ত্বেও চীনকে উপেক্ষা করার ধৃষ্টতা ভারতের নেই তার সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তির কারণে। নেই বলেই এত কিছুর পরও চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্ক ভারত অটুট রেখেছে। পাকিস্তানের জন্য সব দরজা বন্ধ করলেও চীনের জন্য সব বাতায়ন খোলা।

এই সম্পর্ককে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে তিয়ানজিনে সির সঙ্গে হাত মেলালেন মোদি। দুজনের দোসর হিসেবে হাজির ছিলেন ভারতের চিরকালের বন্ধু রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।

এই নতুন অক্ষ তৈরির অনুঘটক অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ইদানীং যিনি আধুনিক যুগের ‘মোহাম্মদ বিন তুঘলক’। তাঁর অভিনব শুল্কযুদ্ধের সম্ভাব্য পরিণতি এখনো অজানা। কিন্তু মোদি, সি ও পুতিনকে তিনিই কাছাকাছি এনেছেন। এতে আখেরে লাভ চীনের এবং চীনের লাভ মানে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতি—এই উপলব্ধি তাঁকে সতর্ক করলে ও দ্রুত বোধোদয় ঘটালে আগামী দিনে শুল্ক রেষারেষির ক্যানভাস বদলে যেতে পারে। ট্রাম্পের মনে রাখা উচিত যুক্তরাষ্ট্রের বিপদ ভারত নয়, শত্রু তো নয়ই। এমন কিছু করা তাই ঠিক নয়, যা ভারতকে কোণঠাসা ও চীনকে উৎফুল্ল করে তোলে।

‘হিন্দি চীনি ভাই ভাই’ স্লোগানের পরিণতি কী হয়েছিল, ১৯৬২ সালে জওহরলাল নেহরু তা বুঝেছিলেন। বাজপেয়ী মন্ত্রিসভার প্রতিরক্ষামন্ত্রী জর্জ ফার্নান্দেজ ১৯৯৮ সালে বলেছিলেন, ভারতের ১ নম্বর শত্রু চীন। ‘এনিমি নাম্বার ওয়ান’কে বিশ্বাসের মাশুল নরেন্দ্র মোদি দিয়েছেন। গালওয়ানে।

অর্থনৈতিক প্রশ্নে ভারত এখনই কোণঠাসা। অর্থনীতির অতিরিক্ত চীননির্ভরতা সেই অবস্থার কারণ। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চীন যদি গালিভার হয়, ভারত তা হলে লিলিপুট। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ ১২৭ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। এই বাণিজ্য প্রায় পুরোটাই একপক্ষীয়। কেননা, চীনে ভারতের রপ্তানি মাত্র ১৪ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার, আমদানি যেখানে ১১৩ দশমিক ৫০ বিলিয়ন। বাণিজ্যঘাটতির পরিমাণ প্রায় ১০০ বিলিয়ন! ট্রাম্পের খামখেয়ালিপনা থেকে মোদিকে বাঁচাতে সি চিন পিংয়ের হাত বাড়ানোর অর্থ ভারতকে আরও বেশি চীননির্ভর করে তোলা। চীনও তা–ই চায়। সেটিই প্রধান লক্ষ্য।

গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ (জিটিআরআই) ভারতের অতিনির্ভরতার নমুনাগুলো তুলে ধরেছে। যাবতীয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেশিনারি, ইলেকট্রনিক, ফার্মাসিউটিক্যালস, কেমিক্যালস, সিলিকন ওয়েফার্স, অ্যান্টিবায়োটিক, ল্যাপটপ, মুঠোফোন, সেমিকন্ডাক্টর, টেলিকম, সোলার প্যানেলের মতো নবায়নযোগ্য শক্তি, লিথিয়াম ব্যাটারি সেল ও বিরল খনিজ পদার্থের জন্য চীনের দিকে হাপিত্যেশ চেয়ে থাকা ছাড়া ভারতের উপায় নেই।

গত ১১ বছরে আরও বেশি করে চীন হয়ে উঠেছে সেই মাচা, যেখানে লতিয়ে বেড়ে চলেছে ভারতের অর্থনীতি। এই পরমুখাপেক্ষী থেকে আত্মনির্ভর হওয়ার জন্য যে নীতি গ্রহণ আবশ্যক ছিল, দুঃখের বিষয় সেদিকে নজর দেওয়া হয়নি।

আরও পড়ুন

একসময় যেসব পণ্য ভারতে তৈরি হতো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের যে রমরমা অবস্থা ছিল, আজ তা অন্তর্হিত। ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক পণ্যের বাজারের ৯৭ ভাগ আজ চীনের দখলে। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কিংবা ‘ভোকাল ফর লোকাল’ নিতান্তই স্লোগান হয়ে থেকেছে।

মোদির কণ্ঠে এখন স্বদেশিয়ানার যে মন্ত্র উচ্চারিত, বাস্তব অর্থে সেটিও ছেলেভোলানো গীত। চীনা অক্টোপাসের বন্ধনে জড়িয়ে পড়েছে ভারত। ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধ ও মোদির তিয়ানজিন সফর তাই একজনেরই হাসি আকর্ণ বিস্তৃত করেছে। সি চিন পিং।

এটা ঠিক, গত অর্থবছরেও যুক্তরাষ্ট্র ছিল ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যসঙ্গী। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ১৩১ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ভারতের রপ্তানি প্রায় ৮৭ বিলিয়ন, আমদানি ৪৫ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার। ভারতের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত প্রায় ৪২ বিলিয়ন ডলার।

শুল্কযুদ্ধের দরুন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি অর্ধেক কমে গেলে আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থা মুডিসের মতে ভারতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের নিচে চলে যাবে; কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, কর্মহীন হবে অন্তত ৫০ লাখ মানুষ। সেই সুযোগে চীনের থাবা আরও গেড়ে বসবে। মার্কিন মুলুকেই বলাবলি শুরু হয়েছে, ভারতের দুর্বল হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ক্ষতিকর। কারণ, তাতে চীনের ক্ষমতা, প্রতিপত্তি ও শক্তি আরও বাড়বে।

আরও পড়ুন

ট্রাম্প এই সহজ সত্যটুকু কেন বুঝছেন না, সেই প্রশ্ন তাঁর দেশেই উঠছে। যা নিয়ে তাঁর জেদ, বাণিজ্যচুক্তি আলোচনা প্রধানত যে কারণে থমকে গেছে, সেই কৃষি ও ডেইরি ক্ষেত্র উন্মুক্ত করা নরেন্দ্র মোদি কেন; ভারতের কোনো নেতার পক্ষেই সম্ভবপর নয়। ভারতের জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান প্রায় ২০ শতাংশ, ডেইরি খাতের ৫ শতাংশ। সরকারি হিসাবে ২০২৩-২৪ সালে কৃষিতে নিযুক্ত মানুষের সংখ্যা ছিল ৫২ শতাংশ। ডেইরি খাতে সরাসরি নিযুক্ত আট কোটি। ক্ষেত্র দুটি উন্মুক্ত হলে ৭০ কোটি গ্রামীণ মানুষের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার রিপোর্ট, ডেইরি খাত উন্মুক্ত হলে ২৫ মিলিয়ন টন দুধ আমদানি হবে। ভারতীয় দুধের দাম কমে যাবে ১৫ শতাংশ।

অনুগত গণমাধ্যম মোদির দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতায় গদগদ। তারা উৎফুল্ল, ট্রাম্পের পাগলপনা ও চাপের কাছে মাথা না নুইয়ে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়ে মোদি পাল্টা চাপ সৃষ্টি করতে পেরেছেন বলে। বিরোধীরা মুখর মোদির ১৮০ ডিগ্রি ভোল বদলে।

গালওয়ানের দখল চীনা ফৌজ এখনো ছাড়েনি, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় স্থিতাবস্থা ফেরেনি, ‘বাফার জোন’ এখনো মেষপালকদের কাছে ‘নো এন্ট্রি’, অপারেশন সিঁদুরের সময় চীন-পাকিস্তান যুগলবন্দীর রেশও টাটকা। সব বেমালুম ভুলে সি চিন পিং বরণে আখেরে ভারতের লাভ না লোকসান, বিরোধীদের প্রশ্ন সেটিই।

‘হিন্দি চীনি ভাই ভাই’ স্লোগানের পরিণতি কী হয়েছিল, ১৯৬২ সালে জওহরলাল নেহরু তা বুঝেছিলেন। বাজপেয়ী মন্ত্রিসভার প্রতিরক্ষামন্ত্রী জর্জ ফার্নান্দেজ ১৯৯৮ সালে বলেছিলেন, ভারতের ১ নম্বর শত্রু চীন। ‘এনিমি নাম্বার ওয়ান’কে বিশ্বাসের মাশুল নরেন্দ্র মোদি দিয়েছেন। গালওয়ানে। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সূক্ষ্ম বিচার মোদির মতো ট্রাম্পেরও করা উচিত।

  • সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি

    *মতামত লেখকের নিজস্ব

[৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ প্রথম আলোর ছাপা সংস্করণে এ লেখাটি ‘প্রশ্নটা বিশ্বাস–অবিশ্বাসের, মোদি-ট্রাম্প কি তা বুঝবেন’ এ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে]