মানবজাতির শ্রেষ্ঠত্বের প্রকৃষ্ট প্রমাণ পরোপকার। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরাই সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির (সর্বাত্মক কল্যাণের) জন্য তোমাদের আবির্ভূত করা হয়েছে। তোমরা সৎকাজের আদেশ দাও এবং অসৎ কাজে নিষেধ করো ও আল্লাহর প্রতি ইমান রক্ষা করে চলো।’ (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ১১০) মহানবী (সা.) বলেন, ‘তোমরা জগদ্বাসীর প্রতি দয়া করো, তাহলে আসমানওয়ালা আল্লাহ তাআলা তোমাদের প্রতি করুণা করবেন।’ (তিরমিজি: ১৮৪৭)
মানুষ সামাজিক জীব। একে অপরের সহযোগিতা ছাড়া জীবনযাপন করা কঠিন। পরোপকার মানুষের গুণাবলির অন্যতম। যখন কোনো সমাজে একে অপরের প্রতি সহযোগিতা হ্রাস পায়, সে সমাজের মানুষ সব দিক দিয়েই পিছিয়ে পড়ে। সে সমাজে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়, শান্তি বিলুপ্ত হয়, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা তিরোহিত হয়।
পারস্পরিক ভালোবাসা ও সহযোগিতা ইসলামের অন্যতম বিষয়। রাসুলে করিম (সা.) বলেছেন, সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহর পরিবার। তাই পরোপকারের চেতনায় কোনো শ্রেণিভেদ নেই। বড়-ছোট, ধনী-গরিব, আত্মীয়-অনাত্মীয়, স্বজাতি-বিজাতি, মুসলিম-অমুসলিম—এসব ব্যবধানের ঊর্ধ্বে উঠে ইসলাম শান্তি ও সৌহার্দ্যের সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মুমিন মিলেমিশে থাকে। যে মিলেমিশে থাকতে পারে না, তার মধ্যে ভালো কিছু নেই। সে-ই শ্রেষ্ঠ মানুষ, যে ব্যক্তি মানুষের বেশি উপকার করে।’ (মুজামুল আওসাত: ৫৭৮৭)
পৃথিবীর ইতিহাসে যেসব মনীষী স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন, তাঁদের প্রত্যেকেই ছিলেন পরোপকারী। রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রথম ওহিপ্রাপ্তির পর ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বাড়িতে ফিরে খাদিজা (রা.)-কে বললেন, ‘আমাকে কম্বল দিয়ে জড়িয়ে দাও, আমি আমার জীবনের আশঙ্কা করছি।’ তখন খাদিজা (রা.) নবীজি (সা.)-কে অভয় দিয়ে বলেছিলেন, ‘আল্লাহ কখনোই আপনার অমঙ্গল করবেন না। কারণ, আপনি মানুষের সেবা করেন, গরিব-দুঃখীর জন্য কাজ করেন, অসহায় এতিমের ভার বহন করেন, তাদের কল্যাণের জন্য নিজেকে নিয়োজিত রাখেন।’ (বুখারি: ৪৫৭)
আমরা ভুলতে বসেছি যে আমরা মানুষ। ইসলামের চেতনা, আদর্শ ও শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাওয়ায় আজ আমাদের সমাজ হিংসা, হানাহানি, অপমৃত্যু, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নৈরাজ্যে জর্জরিত। তাই সমাজ আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এর থেকে উত্তরণের পথ হচ্ছে ইসলামে পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ করা। কোরআনের বাণী, ‘তোমরা পরিপূর্ণরূপে ইসলামে প্রবেশ করো আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না; নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২০৮)
আমাদের জীবন, সম্পদ ও সময় আল্লাহর পথে, অর্থাৎ আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত পন্থায় ব্যয় বা বিনিয়োগ করতে হবে। কোরআন কারিমে আছে, ‘আল্লাহ মুমিনদের কাছ থেকে তাদের জীবন ও তাদের সম্পদ খরিদ করে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে।’ (সুরা-৯ তাওবা, আয়াত: ১১১) যারা আল্লাহর পথে নিজেদের ধনসম্পদ ব্যয় করে, কিন্তু তা প্রচার করে না, খোঁটা দেয় না, কষ্টও দেয় না; এর প্রতিদান তাদের প্রতিপালকের কাছে রয়েছে। পরকালে তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না। ‘হে মুমিনগণ! তোমরা তোমাদের দান–সদকাকে পণ্ড করো না খোঁটা ও কষ্ট দেওয়ার মাধ্যমে।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২৬২-২৬৪) ‘নিশ্চয় দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী, যে ক্ষেত্রে তারা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দান করে তাদের প্রতিদান বৃদ্ধি করা হবে এবং তাদের জন্য রয়েছে সম্মানজনক পুরস্কার।’ (সুরা-৫৭ হাদিদ, আয়াত: ১৮)
জীবনে সমস্যা সমাধানে পরোপকার অত্যন্ত কার্যকর ব্যবস্থা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের দুনিয়াবি সমস্যাগুলোর একটি সমাধান করে দেয়, আল্লাহ তাআলা তার আখিরাতের সংকটগুলোর একটি মোচন করেন। যে ব্যক্তি কোনো অভাবগ্রস্তের অভাব মোচনে সাহায্য করবে, আল্লাহ তাআলাও তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে স্বাচ্ছন্দ্য দান করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ–গুণ গোপন করবে, আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন। আল্লাহ তাআলা ততক্ষণ বান্দার সাহায্য করেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে নিয়োজিত থাকে।’ (মুসলিম: ২৬৯৯)
কারও ক্ষতি না করাও একধরনের পরোপকার। পরোপকারে নিজের কল্যাণ সাধিত হয়। হাদিস শরিফে রয়েছে, ‘অবশ্যই দান–সদকা মানুষের হায়াত বৃদ্ধি করে। অপমৃত্যু থেকে বাঁচায় এবং অহমিকা দূর করে।’ (আল মুজামুল কাবির: ১৩৫০৮)
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম